Tuesday, May 19, 2009

গুমাই বিলের ১০ লাখ বর্গা চাষীর স্বপ্নভঙ্গ ।। গোলা ভরেছে মহাজনের

১৯.০৫.০৯

ইত্তেফাক ।। চট্টগ্রাম অফিস ।।

গুমাই বিলের বর্গা চাষী হরিপদের ৪ একর জমিতে এবার ধান হয়েছে সাড়ে ৩২ মণ। নিজের কুঁড়ে ঘরটা তাই এবার টিন দিয়ে বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। কিন্তু পাকা ধান কাটার আগেই ভেঙ্গে গেছে হরিপদের স্বপ্ন। কারণ জমির ব্যবহারিক দাম ও একর প্রতি উৎপাদন খরচ ধান কাটার পর পরই বুঝে নিয়েছেন তার মহাজন। ৪ একর জমিতে উৎপাদিত সাড়ে ৩২ মণ ধান থেকে মহাজনের ঘরে গেছে ৩০ মণ ধান। আর ছয় মাসের শ্রম হিসাবে হরিপদ পেয়েছে আড়াই মণ, সরকারি হিসাবে যার দাম মাত্র ১ হাজার ৪০০ টাকা!

মহাজনের হিসাব ও সরকারি দামের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে চট্টগ্রামে হরিপদের মত স্বপ্নভঙ্গের কষ্টে পুড়ছে প্রায় ১০ লাখ বর্গা চাষী। কারণ সব হিসাব চুকিয়ে যে ধান আছে কৃষকের ভাগে, তা দিয়ে সংসারের খরপোষ হবে না আগামী ছয় মাস। আবার ধান বিক্রি করলেও পাওয়া যাচ্ছে না ন্যায্য দাম। সরকার প্রতি কেজি ধান ১৪ টাকা ও চাল কিনছে ২২ টাকা দরে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক আবুল কালাম আজাদ ইত্তেফাককে বলেন, ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাঁচ জেলায় ২ লাখ ৩২ হাজার ৮১৫ হেক্টর জমিতে এবার বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৯ লাখ ৩৮ হাজার ২৭০ মেট্রিক টন। ১৬ লাখ ৬৩ হাজার কৃষক পরিবারের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রত্যাশিত টার্গেট অর্জিত হয়েছে আমাদের। কিন্তু বাম্পার ফলন হলেও মহাজনদের চাহিদা মিটিয়ে বেশি কিছু অবশিষ্ট থাকছে না বর্গাচাষীদের ভাগ্যে।

দেশের অন্যতম বৃহত্তম শস্য ভান্ডার গুমাই বিলের কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এবার তাদের প্রতি একর জমিতে হাইব্রিড ধান হয়েছে ৮ মণ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ মণ পর্যন্ত। আর উচ্চ ফলনশীল (উফশী) ধান হয়েছে একরপ্রতি সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৬ মণ। স্থানীয় হিসাবে প্রতি কানি জমিতে ১২৫ থেকে ১৩০ আড়ি (১০ কেজিতে এক আড়ি) হাইব্রিড ধান হয়েছে। আর উফশী ধান হয়েছে কানিপ্রতি ৯০ থেকে ১০০ আড়ি পর্যন্ত। প্রতি কানি জমিতে এই ফসল পেতে সার, কীটনাশক, সেচ ও রোপণসহ বিভিন্ন খাতে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে কৃষককে। আর একরপ্রতি (আড়াই কানিতে এক একর) এই খরচের পরিমাণ গড়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা।

মহাজনদের কানিপ্রতি ১২০ থেকে ১২৫ আড়ি হাইব্রিড ধান দেয়ার শর্তে বোরো ধানের জমি বর্গা চাষ করেছে এ অঞ্চলের কৃষকরা। নিজের জমি না থাকায় হতদরিদ্র কৃষকরা এমন কঠিন শর্তে অন্যের জমিতে ধান ফলিয়েছে। চট্টগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, এ অঞ্চলে এমন হতদরিদ্র কৃষকের সংখ্যা মোট কৃষকের প্রায় ৮০ শতাংশ। উল্লেখ্য, এ অঞ্চলের ৫ জেলায় ১৬ লাখ ৬৩ হাজার ১১২ জন কৃষকের মধ্যে চট্টগ্রাম জেলায় আছে ৬ লাখ ১৯ হাজার, কক্সবাজারে আছে ১ লাখ ৭৭ হাজার, নোয়াখালীতে আছে ৩ লাখ ৭৬ হাজার, ফেনীতে আছে ১ লাখ ৮৩ হাজার ও লক্ষ্মীপুরে আছে ৩ লাখ সাড়ে ৮ হাজার কৃষি পরিবার।

গুমাই বিলের বর্গা চাষী জীবন নাথ ইত্তেফাক প্রতিনিধিকে বলেন, সাত কানি জমি বর্গা নিয়ে ধান রোপণ করেছি গত পৌষ মাসের শেষে। গত পাঁচ মাস শ্রম দিয়ে এসব জমি থেকে যে ধান পেয়েছি তার ৮০ শতাংশই দিতে হচ্ছে জমির মালিককে। অবশিষ্ট যে ধান আছে তা সরকারি দামে বিক্রি করলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পাবো আমি। গত পাঁচ মাস জমিতে শ্রম না দিয়ে যদি অন্যকিছু করতাম তবে সাত সদস্যের পরিবারটা অন্তত আরো ভালভাবে চলতো।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলার গুমাই বিলে এবার বোরো আবাদ হয়েছে ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। ৯ হাজার ৫৫৫ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এসব জমি চাষ করে প্রায় ১০ হাজার কৃষক। স্থানীয় ভারপ্রাপ্ত উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা একরাম উদ্দিনের তথ্যানুযায়ী, এদের মধ্যে ৮ হাজার কৃষকেরই নিজস্ব জমি নেই। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে ফসল ফলিয়েছে তারা। তাই পুরো বিলে এবার বাম্পার ফলন হলেও সুখের দেখা পায়নি বর্গা চাষীরা। মহাজনের ধান বুঝিয়ে দিতে গিয়ে নিজের গোলা ভরাতে পারেনি এসব বর্গা চাষী।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।