Tuesday, May 19, 2009

পাট, আবার সুদিন আসুক

১৯.০৫.০৯
।। ডেসটিনি ।। মকবুলা পারভীন

স্যার মোহাম্মদ আজিজুল হক ছিলেন একজন যশস্বী আইনবিদ, ১৯৩৭ সালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য ও পরে স্পিকার, অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যায়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং সি,আই,ই,কে,সি,এস,আই ও স্যার উপাধিপ্রাপ্ত। রাজনীতি ও সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। এই যশস্বী ব্যক্তির প্রকাশিত বেশ কয়েকটি মূল্যবান বইয়ের অন্যতম হচ্ছে ‘দি ম্যান বিহাইন্ড দি প্লাউ।’
এই বইয়ের একটি অংশে বাংলাদেশের মাটি সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ প্রধানত পলিমাটির দেশ। অসংখ্য নদী-নালা এই পলিমাটি বয়ে আনে। পাহাড়ে ও পাহাড়ি অঞ্চলে যখন বৃষ্টি হয়, তখন সেই পানি প্রবল বেগে নিচে নেমে আসে; সেই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে মাটিও কেটে আসে। সমতল ভূমিতে আসার পর এই স্রোতধারাগুলো একত্রে মিলিত হয়ে নদীতে পরিণত হয়। সমতল ভূমিতে এই নদীর গতিমন্থর হয়ে যাওয়ায় বয়ে আনা মাটি তলদেশে ও দুই পাশে জমতে থাকে। তারপর সাগরে মিলিত হওয়ার সময় বদ্বীপ সৃষ্টি হয় এবং এইরূপে জমির পরিমাণ বেড়ে যায়। ... পানির এই স্রোতধারা নিজের গতিপথ সম্প্রসারণ ও ভরাট করে, কখনো গতি পরিবর্তন করে দ্বীপ সৃষ্টি করে, কখনো এক পাড় ভেঙে অন্য পাড় গড়ে তোলে। হাজার হাজার বছর যাবত এই প্রক্রিয়া চলে আসছে। বালু, কাদা, পলি, কাঁকর একত্রে জমে গিয়ে মাটি প্রস্তুত হয় এবং এক সময় হয়ত নতুন প্লাবন এসে সব ধুয়ে-মুছে নিয়ে যায়। ... এই ভাঙাগড়ার খেলা অনন্তকাল ধরে চলে আসছে। বাংলার মাটি এই ভাঙাগড়া ও গঠন পুনর্গঠনেরই ফল, তার উর্বরা শক্তির মূল উৎস হচ্ছে পলিমাটি।’
সাধারণভাবে বলা হয়, ‘মাছের রাজা ইলিশ।’ পদ্মা নদীর ইলিশ মাছের স্বাদ তুলনাহীন। এই মাছ নিয়ে গবেষণাকারীদের মত হচ্ছে, পদ্মার ইলিশের তুলনাহীন স্বাদের অন্যতম কারণ পদ্মার ভেসে বেড়ানো পলি। এই পলি খেয়েই নাকি ইলিশ সুস্বাদু হয়ে ওঠে। তেমনি একসময় বলা হতো, পাটের রাজা পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এই উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ পাট উৎপাদনে রেকর্ডও করেছে বারবার। কেন? গবেষকদের মতে, পাটের আবাদে জমির অধিক উর্বরা শক্তির প্রয়োজন হয়। বন্যার সময় নদীর পানিতে যে উর্বর পলিমাটি ভেসে আসে একমাত্র তার ফলেই পাট চাষ সম্ভব হতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে কোনো সার প্রয়োগেরও দরকার নেই।
বিশ্বে এরকম একটি ভূমির একমাত্র অধিকারী বাংলাদেশ। আবহাওয়া বৈরী আচরণ না করলে বাংলাদেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পাট উৎপাদনে সক্ষম।
ব্রিটিশ শাসিত ভারতে এক জরিপে জানা গিয়েছিল, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, কুচবিহার ও ত্রিপুরা রাজ্যে সামান্য কিছু চাষ হলেও মূলত পাটের আবাদ ছিল একচেটিয়া বাংলাদেশের। পৃথিবীর আর কোনো দেশে তখন পাটের আবাদ ছিল না কিন্তু পাট ও পাটজাত দ্রব্যের আন্তর্জাতিক চাহিদা ছিল। পাট খুব উপকারী এবং সস্তা হিসাবে তখনও গণ্য ছিল। এর কোনো বিকল্প ছিল না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছিল ব্রিটিশরা। তারা অবিভক্ত ভারতে বহু পাটকল স্থাপন করেছিল। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি।
বাংলাদেশের কৃষকরা প্রাচীনকাল থেকে পাটের আবাদ করে আসছে। ঘর-সংসারের কাজে যেমন পাটের প্রয়োজন তেমনি অর্থকরী ফসল হিসেবে তখনও এর মূল্য ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্যের চাহিদা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে ধানের আবাদী জমি বাকি রেখে কৃষক পাটের আবাদ করতেন। এরপরও পাটই একসময় ছিল প্রধান অর্থকরী ফসল। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে কৃষকরা মুনাফার জন্য ফসল আবাদ করতেন না। সারা বছরের খাদ্য রেখে উদ্বৃত্ত ফসল সম্পন্ন কৃষকরা বাজারে বিক্রি করতেন। কিন্তু পাটের ক্ষেত্রে কথাটা খাটে না। বছরে একবার নগদ টাকা পাওয়ার প্রয়োজনে কৃষক পাট চাষে মনোযোগী হতেন। তবে সব সময় একটা সমস্যা ছিল বা আছে তা হচ্ছে, কৃষক পাট লাগিয়ে উৎপান খরচ, মজুরি খরচ করে কেটে, ধুয়ে, শুকিয়ে, বাজারে বিক্রি করে যে অর্থ আয় করতেন তাতে উৎপাদন ও অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে খুব একটা লাভ থাকত না বা থাকে না। তবে কমবেশি আজও কৃষক পাট বিক্রি করার টাকায় মেয়ের বিয়ে, যৌতুক, পরিবারের নগদ অর্থের চাহিদা ও মহাজনী ঋণ শোধসহ অন্যান্য প্রয়োজন পূরণ করার স্বপ্ন দেখেন।
বহুকাল আগে থেকেই কৃষকের পাটের একটি বড় অংশ লাভ করে মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারা কৃষকের কাছ থেকে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে পাট কিনে তা আরো উচ্চমূল্যে বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা লাভ করে।
ব্রিটিশ আমলে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের আন্তর্জাতিক চাহিদা সামনে রেখে শাসকরা তৎকালীন বাংলার রাজধানী কলকাতা ও এর আশপাশে পাটকল গড়ে তোলে। অথচ তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ছিল বৃহত্তর পাট উৎপাদনকারী অংশ। এ দেশে একটিও পাটকল তারা স্থাপন করেনি। ফলে এ বঙ্গের কৃষকের উৎপাদনের পাটে চলত কলকাতা ও তার আশপাশের পাটকলের তাঁত। সে সময়ও পাট ও পাটজাত দ্রব্য দিয়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে তা রফতানি হতো আন্তর্জাতিক বাজারে। এটিই ছিল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী প্রধান খাত। এই খাতটি পাটের বিকল্প বস্তু না আসা পর্যন্ত অত্যন্ত লাভজনক ছিল।
ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটার পর সাতচল্লিশ-উত্তর বাংলাদেশে ছোট-বড় বহু পাটকল স্থাপিত হয়। উপমহাদেশের বিখ্যাত আদমজী জুটমিল সাতচল্লিশ-উত্তর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। এর সঙ্গে পাট উৎপাদনকারী জেলাগুলোতে স্থাপিত মিলগুলোতে পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হলে অর্থনীতিতে সূচিত হয় সাফল্যের ধারা। এ দেশে পাট উৎপাদনে ঘটে উল্লেখযোগ্য বিপ্লব। ১৯৬৯-৭০ সালে এ দেশে উৎপাদিত হয় ৭০ লাখ বেল পাট। বলতে গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের একচেটিয়া বাজার দখল করে পলিমাটির গড়া এ ভূমি।
এরপর এ দেশের পাটশিল্প ক্রমশ নিম্নমুখী হতে থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে পাটের বিকল্প নাইলন এবং প্লাস্টিক যেমন এ শিল্পকে আঘাত করে তেমনি এ শিল্পের বিষয়ে উদাসীনতা, সরকারিকরণের সুযোগে মিলগুলোতে ব্যাপক লুটপাট, পাট গুদামে পরিকল্পিত অগ্নিকা- ঘটতে থাকায় পাটশিল্প প্রায় পড়ে যায়। কিন্তু বিশ্ববাজারে পাট বা পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা কমে এলেও বাজার একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। বাংলাদেশের পাট শিল্পে অব্যবস্থা বিরাজ করায় এ সুযোগকে কাজে লাগায় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। তারা নতুন করে মিল-কারখানা তৈরি এবং পরিকল্পিত পাটের আবাদ করে সাফল্য লাভ করে। তারা পাট ও পাটজাত দ্রব্যের অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরিতে সফল হয় এবং এতে ব্যাপক মুনাফা অর্জন করতে থাকে। অভ্যন্তরীণ বাজার চাহিদা মিটিয়েও তারা পাটজাতদ্রব্য বিদেশে সাফল্যজনকভাবে রফতানি করছে। অথচ পাশাপাশি দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের ঊর্ধ্বতন মহল এ বিষয়টিকে উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করে এ শিল্পের উজ্জীবন ঘটাতে চেষ্টা করেনি। উপরন্তু উপমহাদেশের বিখ্যাত আদমজী জুটমিলসহ বেশ কটি জুটমিল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, দক্ষ শ্রমিকদের বেকার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এ দেশের বৃহত্তর পাটকল আদমজী বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কলকাতায় আরও চার-পাঁচটি মিল স্থাপিত হয়েছে, উৎপাদন হচ্ছে দিন-রাত। প্রতিবেশী একটি দেশ যদি পাটশিল্পের প্রতি এত মনোযোগ প্রদান করে তাহলে আমাদের দেশে কেন এ শিল্পের প্রতি এত অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করা হচ্ছে-এ প্রশ্ন তোলা সঙ্গত।
আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের দেশের পাট পণ্যের চাহিদা এখনো রয়েছে। এক সংবাদে প্রকাশ, গতমাসে থাইল্যান্ড সরকার বাংলাদেশ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টন পাটের ব্যাগ আমদানির জন্য কয়েক দফায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হয়েছে। এর আগে জানা গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকা আগাম টাকা দিয়েও পাটপণ্য ও পাটের সুতার অর্ডার করাতে পারেনি। গত বছর নাকি সিরিয়া ও আফ্রিকা এ দেশ থেকে পাটজাত পণ্য কিনতে চেয়ে বিফল হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছেÑ বাংলাদেশে পাটজাত দ্রব্যের উৎপাদন কমে যাওয়া। উল্লেখ্য, সিরিয়া, সুদান, ইরান, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশী মোটা চট, ছালা বা বস্তা এবং সিবিসির চাহিদা আছে। এ দেশগুলো এসব পণ্য বাংলাদেশ থেকে কিনতে আগ্রহী। বর্তমানে পাট শিল্পের অবস্থা নাকি এমন যে, এসব পণ্য পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদিত হচ্ছে না, ফলে এক দেশের কাছে এসব পণ্য বিক্রি করলে অন্য দেশে সরবরাহ করার মতো পণ্য আর থাকে না। এটা কি একটা যুক্তি হলো? শিল্প কি অবহেলার বিষয়?
পলিমাটির দেশের উৎপাদিত পাট দিয়ে পরিবেশবান্ধক অনেক কিছু তৈরি করা সম্ভব। যে বিশ্ব একদিন পাটকে পাশকাটিয়ে কৃত্রিম আঁশের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল সেই বিশ্ব এখন কৃত্রিম আঁশের কুফল সম্পর্কে সচেতন হয়ে আবার পরিবেশবান্ধব পাটজাত পণ্যের দিকে ঝুঁকে আসছে। বিশ্বব্যাপী বাড়ছে এর চাহিদা। এ সময় বাংলাদেশের এ শিল্পকে রাশটেনে ধরার অর্থ হচ্ছে ইচ্ছা করে নিজেদের পিছিয়ে রাখা। বিশ্বব্যাপী পাট শিল্পের চাহিদা বাড়ছে বলে বাংলাদেশে ও পাটের বাজার আবার চাঙ্গা হয়ে উঠছে। গত দু’বছর বাংলাদেশের কৃষক পাটের মূল্য পেয়ে খুশি হয়েছেন। এখন দরকার আবার পাটশিল্পের পুনরুজ্জীবন ঘটানো। উল্লেখ্য, পাট দিয়ে কাপড়, ফিল্ম, কাগজ, জিন্সের কাপড় ছাড়াও আরও অনেক কিছু তৈরি হচ্ছে। এ সুযোগ হাতছাড়া করার সুযোগ নেই। পাট শিল্পকে চাঙ্গা করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য দরকার দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাহিদা অনুযায়ী পাট উৎপাদন করা, প্রচলিত চট, থলে, কার্পেট ও সিবিসির মানোন্নয়ন করা, এ শিল্পে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন করা, চাহিদা অনুযায়ী পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন, রফতানির পরিমাণ ও উৎপাদন মান বজায় রেখে বাজার সম্প্রসারণ ও চোরাচালান প্রতিরোধ, পাট উৎপাদনে কৃষককে উন্নতমানের পাটবীজ সরবরাহ ও কৃষি সহায়তা প্রদান করা। একই সঙ্গে এ শিল্পে অসন্তোষ ও দুর্নীতি দূর করতে হবে- বন্ধ পাটকলগুলো পুনরায় চালু করতে হবে। তবেই পাট হয়ে উঠবে আমাদের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি।
আমাদের উর্বরা ভূমির পাট এবং আমাদেরই কলকারখানায় উৎপাদিত পাটজাত দ্রব্যের সুনাম আবার তার হৃত গৌরব ফিরে পাক।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।