Thursday, June 11, 2009

কৃষিতে আট হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি

ডেসটিনি- ০১.০৫.০৯
শফিকুল ইসলাম : আসন্ন বাজেটে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি রাখার প্রস্তাব থাকছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পাশাপাশি কৃষকের স্বার্থসংরক্ষণ এবং আমদানি নির্ভরতা কমাতে সরকার যুগান্তকারী এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। ৮ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকির এ প্রস্তাব কার্যকরি হলে কৃষিতে এবারের ভর্তুকি হবে গত বছরের তিনগুণ। একইসঙ্গে সারাদেশের কৃষকদের জন্য কার্ড চালুর প্রস্তাবনা রাখা হবে বাজেটে। এ কার্ড দিয়ে সার, সেচ ও ডিজেলের ভর্তুকির টাকা বিতরণ করা হবে কৃষকদের মধ্যে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী জানান, বিগত বছরগুলোয় বিশ্বব্যাংক ও দাতা সংস্থাগুলো কৃষিখাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও ভর্তুকি কমানোর জন্য সরকারের ওপর চাপ দিয়ে থাকলেও বর্তমানে কোনো চাপ নেই। তিনি জানান, বিশ্বমন্দার কারণে আমেরিকার সরকারও সেদেশে ভর্তুকি বাড়িয়েছে। আর এ কারণে তারা এ নিয়ে এবার কোনো বাধা দিচ্ছে না। আর এ সুযোগটি আমরা কৃষির উন্নয়নে কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছি। উৎপাদন হলে আমদানি নির্ভরশীলতা কমিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যাবে বলে তিনি জানান।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি কৃষি খাতে ভর্তুকির জন্য হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে ৮ হাজার কোটি টাকার চাহিদা পেশ করা হয়েছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এ খাতে ভর্তুকি রাখা হয় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা ৪ হাজার ২৮৫ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। চলতি বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলনের প্রেক্ষাপটে কড়া নজরদারি ও ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রাখার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সরকার এরই মধ্যে মন্দা মোকাবিলায় বিশেষ প্যাকেজে কৃষিখাতে ভর্তুকি বর্তমানের ৪ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৫ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এবং কৃষিঋণ (পুনঃমূলধনীকরণ) খাতে ভর্তুকি ১ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা
(খাদ্য) খাতে বর্তমান ভর্তুকি ৪ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা থেকে ৩৭৪ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা করা হয়েছে। এতে বর্তমানে বরাদ্দ ১১ হাজার ১৩০ কোটি টাকা থেকে ৩ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা বেড়ে সংশোধিত বাজেটে এসব খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৪ হাজার ৫৫৪ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত বলেন, কৃষিতে বাজেটের প্রায় ৮০ ভাগই হচ্ছে অনুন্নয়ন ব্যয়। গত এক দশকে জিডিপিতে কৃষির অবদান কমে বর্তমানে ২১ দশমিক ১১ ভাগে উপনীত হয়েছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার শর্তানুযায়ী কৃষিতে ১০ ভাগ ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের চাপে বাংলাদেশে গত তিন বছর ধরে এ হার মাত্র শূন্য দশমিক ৩ ভাগ। এ বছর যা শূন্য দশমিক দুই ভাগে নেমে এসেছে।
চলতি অর্থবছরে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ভর্তুকির সিংহভাগ ব্যয় হয়েছে সারের পেছনে। ইউরিয়া, নন-ইউরিয়া, পটাশ, টিএসপি উৎপাদন ও আমদানির বিপরীতে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে ১ হাজার কোটি টাকারও বেশি। সরকারি ও বেসরকারি আমদানিকারকরা উৎপাদন ও আমদানির তুলনায় অনেক কম দামে কৃষকদের হাতে সার তুলে দিচ্ছেন। আমদানিকারকরা সরকারের তরফ থেকে ভর্তুকি পাচ্ছেন ১৫ শতাংশ হারে। ভবিষ্যতে এর পরিমাণ বাড়ানো হতে পারে। কৃষকদের উন্নততর বীজ সরবরাহ করতে বিএডিসিকে থোক বরাদ্দ দেয়া হয় দেড়শো কোটি টাকা। ডিজেল ও বিদ্যুৎচালিত পাম্পের বিপরীতে ৩০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়। আখ উৎপাদনে ভর্তুকি দেয়া হয় সাত কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া আখের দুটি অর্থবছরের ভর্তুকির বকেয়া বাবদ সরকার ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৯০০ টাকার সংশোধিত ভর্তুকি নির্ধারণ করা হয়। নতুন অর্থবছরে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলে অতিরিক্ত ব্যয় ভর্তুকিতে সমন্বয় করা হবে। সব মিলিয়ে আগামী বছরে তা হবে ৮ হাজার কোটি টাকার মতো।
সিপিডির প্রধান গবেষক ড. উত্তম কুমার দেব বলেন, বাজেটে কৃষি উৎপাদন ও গণমানুষের আয় বাড়নোর ব্যাপারটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, কৃষি ব্যয় কমানোর জন্য সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিতে হবে। কৃষি যন্ত্রাংশ, সেচের খরচ, বীজপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা ও নতুন প্রযুক্তি বিষয়ে সরকারকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার দাবি জানান তিনি।

লাউয়াছড়ায় বিলীন হচ্ছে জীব-বৈচিত্র

নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, কমলগঞ্জ সংবাদদাতা : দেশের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ জীববৈচিত্রময় একমাত্র বন গবেষণা কেন্দ্র সম্বলিত লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক। ন্যাশনাল পার্কসহ কমলগঞ্জের সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলের সবুজ নিসর্গ ক্রমেই ধ্বংস করা হচ্ছে। বিরামহীনভাবে এই নিসর্গ থেকে মূল্যবান প্রজাতির বৃক্ষ নিধনের ফলে বনাঞ্চল এর সাথে সাথে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ন্যাশনাল পার্কে অবস্থানরত জীব বৈচিত্র। পশু-পাখিরা হারিয়ে ফেলছে নির্ঝঞ্জাট জীবন যাপনের পরিবেশ। জঙ্গলের দূর্লভ প্রাণীগুলো জনপদে ছুটে এসে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মারা যাচ্ছে।

সবুজ প্রকৃতি ঘেরা অত্যন্ত সুন্দর পরিচ্ছন্ন লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক দেশ বিদেশের পর্যটকদের কাছে ব্যাপক সমাধিত। লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক ছাড়াও এখানে হাজার হাজার একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলার সংরক্ষিত এই বনের বেহাল অবস্থা। ক্রমাশুয়ে বিপন্ন হচ্ছে বন। নিঃশষ হচ্ছে জীব বৈচিত্র। সংরক্ষিত বনের বিশাল এলাকা থেকে সেগুনকাঠসহ বিরল প্রজাতির মুল্যবান গাছগাছালি চোরাই কাঠ পাচারকারীরা হরদম পাচার করছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস হতে হতে এখন পুরোপুরি নিঃশষ হওয়ার উপক্রম। বনাঞ্চল ও আশপাশ এলাকার বেকার লোকজন ছাড়াও কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ কাঠ পাচার পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এভাবে কাঠ পাচার হতে হতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের এখন যে অবশিষ্ট বন রয়েছে সেগুলো পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে সব রকম কার্যক্রম চালাচ্ছে কাঠ পাচারকারী ও বন রক্ষক বলে অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে বন্য প্রাণীরা। লোকালয়ে বেরিয়ে আসা এসব বন্য প্রাণী বিভিন্ন সময়ে মারা যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে জঙ্গলের শতাধিক প্রাণীর প্রাণ হারানোর অভিযোগ রয়েছে। এরমধ্যে বিগত ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীমঙ্গল শহরতলীর হবিগঞ্জ রোডের ভৈরবতলী নামক স্থানে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে ৪ ফুট লম্বা ২৬ কেজি ওজনের একটি বাঘ মারা যায়। একই বছরে নভেম্বর মাসে শ্রীমঙ্গল শীতেশ বাবুর ফিসারীতে পাহাড়ারত দুটি কুকুরের কাছে প্রাণ হারায় ৪ ফুট লম্বা ২০ কেজি ওজনের আরেকটি বাঘ। ২০০৫ সালের জানুয়ারী মাসে লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক থেকে বেরিয়ে আসা ১৩ ফুট লম্বা প্রায় ১০০ কেজি ওজনের ১ টি ওজগর সাপ জনপদে চলে আসলে চা শ্রমিকরা দড়ি দিয়ে বেধে সাপটিকে ৪ দিন আটকে রাখে। যার প্রতিবেদন তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ২০০৫ সালের ২৩ জানুয়ারী কমলগঞ্জের খাসিয়াদের হাতে ধরা পড়ে বিরল প্রজাতির একটি ধূমকল, একই বছরের নভেম্বর মাসে লাউয়াছড়ার গভীর জঙ্গল থেকে ৩১ কেজি ওজনের ৩ ফুট লম্বা মেছো বাঘ বেরিয়ে আসলে ২ টি কুকুরের হাতে প্রাণ হারায়। ৭ ই নভেম্বর তারিখে সাড়ে ৩ ফুট লম্বা আরেকটি মেছো বাঘ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসলে লোকজন তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। একই বছরের জানুয়ারী মাসে শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভৈরববাজারের লামুয়া নামক স্থানে গাড়ীর ধাক্কায় মারা যায় ৩ ফুট লম্বা একটি গন্ধগোকুল। এই বছরে ডিসেম্বর মাসে খাদ্যের অভাবে পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা বিরল প্রজাতির ১ টি হনুমান জনতার হাতে ধরা পড়ে। ২১ ডিসেম্বর তারিখে শ্রীমঙ্গল এলাকায় আহত অবস্থায় ধরা পড়ে ১ টি বন মানুষ। ২০০৮ সালের ১৩ এপ্রিল পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা একটি লজ্জাবতী বানর কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছে ধরা পড়ে জনতার হতে। পরে বানরটিকে বন বিভাগের সহায়তায় পৌছে দেয়া হয় শ্রীমঙ্গলের শীতেষ বাবুর চিড়িয়াখানায়। পরিবেশ সংরক্ষণবিদ সীতেশ রঞ্জন দেব জানান, গত এক মাসে কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে আহত অবস্থায় বিরল প্রজাতির একটি মেছো বাঘ, একটি সোনালী বাঘ, একটি গন্ধ গকুল ও একটি ধনেশ পাখি উদ্ধার করে তার পারিবারিক চিড়িয়াখানায় পাঠালে সেখানে সেবা প্রদান করা হয়। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বিকাল ৪ টায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকিছড়া বনাঞ্চলের ভিতর মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মফিজুল ইসলাম বিরল প্রজাতির এই ৪ টি প্রাণী অবমুক্ত করেন। সম্প্রতি এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বনাঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসা একটি মায়া হরিণের মৃত্যু হয় শমশেরনগরে। এভাবেই প্রতিনিয়ত জঙ্গল থেকে ছুটে আসা প্রাণীগুলো মানুষের হাতে কখনও বা যানবাহনের নিচে, আবার কখনও অপর কোন প্রাণীর হাতে প্রাণ হারাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মানুষের হাতে জীবিত ধৃত প্রাণীগুলোকে বন বিভাগ, বিডিআর ও পশুবিদ শীতেশ রঞ্জন দেব অবমুক্ত করে থাকেন। সরকার বিরল প্রজাতির পশু পাখীর আবাসস্থল এই লাউয়াছড়ার জৈব বৈচিত্র রক্ষায় লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কে সকল প্রকার আহরন নিষিদ্দ করেছে। কিন্তু কিছুতেই তা মানা হচ্ছে না। পার্কের ভেতর দিয়ে রয়েছে বিভিন্ন লেবু, আনারস বাগান ও পান পুঞ্জির রাচ্চা, যার জন্য পশু পাখীর নিচ্চব্ধ পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।

সিলেট বন বিভাগের অধীনে এই বনাঞ্চলে আছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। ১৯২৭ সালের বন আইনের আওতায় ১৯৯৬ সালে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে প্রতিষ্টা করা হয়েছিল এই জাতীয় উদ্যান। ১২৫০ হেক্টর জমিতে পশ্চিম ভানুগাছের রিজার্ভ ফরেস্টের অংশ বিশেষ নিয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান গঠিত হয়েছে। উদ্যান প্রতিষ্টার এক বছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে মার্কিন অক্সিডেন্টাল কোম্পানী পার্শ্ববর্তী মাগুরছড়ায় গ্যাস উত্তোলনকালে অগ্নিকান্ডে ক্ষতবিক্ষত হয় বন, মাটি, মানুষ ও প্রাণীজগতের। পরবর্তী ২০০৮ সালে শেভরনের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ কার্যক্রমে মাগুরছড়ার নিকটবর্তী লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও আশপাশ এলাকায় মাটিতে ফাটল দেখা দেয় এবং বন্য প্রাণীরা ছোটাছুটি শুরু করে। বনাঞ্চল এলাকায় বেকারত্ব, রাজনৈতিক দলের প্রভাব, কৃষি জমির সম্প্রসারন, বসত বাড়ি স্থাপনা, জ্বালানী হিসাবে কাঠের ব্যাপক ব্যবহার, বন বিভাগের কম জনবল, চোরাই কাঠ পাচারকারীর সাথে অসাধু বনকর্মকর্তা ও পুলিশের যোগসাজস সর্বোপরি অসচেতনতার কারণেই সংরক্ষিত বনাঞ্চলসহ জীব-বৈচিত্রের আশ্রয়স্থল বিলিন হওয়ার কারন বলে স্থানীয় সচেতন মহল ধারনা করছেন। বনাঞ্চল এলাকার স্থানীয় খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন জানান, কমলগঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কাঠ পাচারের ফলে এখানকার বিরল প্রজাতির বৃক্ষ ও প্রাণী সমূহ বিলুপ্ত হওয়ার অপেক্ষায়। মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির হেড মিঃ জিডিসন প্রধান সুচিয়ান বলেন, ‘বিগত বছর শেভরনের কার্যক্রমের সময় এখানে বন্য প্রাণীর তৎপরতা দেখা যায়নি। তাছাড়া বনাঞ্চলের বাঁশে বাঁশে ফুল আসায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এখানকার বাঁশঝাড়। সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলে বহু প্রজাতির জীব-জন্তু বন থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে ও বনে আশ্রয় নেয় এবং বনেই বংশ বিচ্চার করে। কিন্তু বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় বন্য প্রাণীরা ও হুমকীর মুখে রয়েছে।

চা শিল্পের উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়াতে ৯১৭ কোটি টাকার প্রকল্প বছরে আয় হবে, ৫শ’ কোটি টাকা

ইত্তফোক-১০.০৫.০৯

মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন, চট্টগ্রাম অফিস ।।
চা শিল্পের উন্নয়ন ও উৎপাদন বাড়াতে ৯১৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে চা বোর্ড। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বছরে চা উৎপাদন বাড়বে ৪০ মিলিয়ন কেজি। আর এ থেকে বছরে রাজস্ব আয় হবে ৫০০ কোটি টাকা ।

এ প্রসঙ্গে চা বোর্ডের সদস্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) মোহাম্মদ আবুল কাশেম ইত্তেফাককে বলেন, ‘আমরা চা শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে পরামর্শ করে প্রকল্পটি সরকারের কাছে পাঠাবো। দেশের চা শিল্পের মতো লাভজনক অন্য কোনো ব্যবসা নেই। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে বছরে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে।’

দেশে বর্তমানে ১৬৩টি চা বাগান রয়েছে। এসব বাগান থেকে বর্তমানে প্রায় ৬০ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ৭৪টি চা বাগান রুগ্ন। দেশের চাহিদা মিটাতে প্রায় ৫০ মিলিয়ন কেজি চায়ের প্রয়োজন হয়। বাকি চা বিদেশে রপ্তানি করা হয়। চা বোর্ড জানায়, দেশের চা বাগানগুলোতে উন্নয়নমূলক কোনো কাজ না হওয়ায় এবং বিরূপ আবহাওয়ার কারণে ক্রমেই চা উৎপাদন কমে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পর থেকে চা শিল্পের উন্নয়নে সরকারিভাবে কোনো আর্থিক বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।

চা বোর্ড সূত্রে জানা যায়, চা শিল্পের উৎপাদন বাড়াতে একটি ৫ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির নাম দেয়া হয়েছে ‘স্ট্র্যাটেজিক ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান্ট ফর টি ইন্ডাস্ট্রি অব বাংলাদেশ ভিশন ২০২১’। ২০২১ সালে চায়ের উৎপাদন ১০০ মিলিয়ন কেজিতে উন্নীত করতে এ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। দুই বছরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে যে ব্যয় হবে তা উঠে আসবে। প্রকল্পে অর্থায়ন সরকারের পক্ষে সম্ভব না হলে দাতাদেশ ও সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

আরো জানা যায়, ৫ বছর মেয়াদি এ প্রকল্প তিন দফায় বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। প্রথম দফায় ৩৬৬.৯৬ কোটি টাকা, দ্বিতীয় দফায় ৩৯৭.২২ কোটি টাকা ও তৃতীয় দফায় ১৫৪.৯৯ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে। আর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চা শিল্পের উন্নয়নে ১২ দফা সুপারিশ করা হয়েছে প্রণীত এ পরিকল্পনায়। এসব সুপারিশের মধ্যে রয়েছে উন্নয়নমুখী চা বাগানগুলোর উন্নয়ন করা, রুগ্ন বাগানের যতœ নিতে ঋণ সুবিধা প্রদান, ছোট বাগান সম্প্রসারণ, চা ফ্যাক্টরির উন্নয়ন, টি এস্টেটে গাছ লাগানো, চা ছাড়া বাগানের অন্য ফসলের উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ, চা শিল্প কম্পিউটারাইজড, শ্রমিকদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ, পিডিইউ ও বিডিআরআই শক্তিশালী করা ও শ্রমিক ওয়েলফেয়ার ফান্ড গঠন করা।

চা বোর্ড সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার কৃষিখাতে ঋণ দিতে পারলে চা শিল্পে ঋণ দিতে সমস্যা কোথায়? ইতিপূর্বে চা শিল্পে যে ঋণ দেয়া হয়েছে তা ব্যাংকের মাধ্যমে সুবিধাভোগীদের দেয়া হয়েছে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে চা বোর্ডের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। চা বোর্ডের মাধ্যমে সরকার ঋণ সুবিধা প্রদান করলে চা শিল্পে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। গৃহীত প্রকল্পের আওতায় স্মল হোল্ডিং টি চাষের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। বর্তমানে ২৯৬টি স্মল হোল্ডিং টি বাগান রয়েছে। নতুন প্রকল্পের আওতায় এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে ৫ হাজারে উন্নীত করা হবে। এতে সাড়ে ৭ হাজার হেক্টর জমিতে নতুনভাবে আবাদ হবে। প্রকল্পে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পঞ্চগড় এলাকায় এসব বাগান বাস্তবায়ন করা হবে। একটি চা গাছ লাগানোর তিন বছর পর চা উৎপাদিত হয়। বাগানগুলো থেকে ৬০ বছরের পুরনো রুগ্ন চা গাছগুলো সরিয়ে নতুনভাবে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। চা বাগানগুলোতে রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট উন্নয়নে কোনো বরাদ্দ নেই। এসব বাগানের রাস্তাগুলোর অবস্থা অত্যন্ত করুণ। বর্তমানে চা বাগানগুলোতে দেড় লাখ শ্রমিক কাজ করছে। বাগানগুলোর যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য ইতিমধ্যে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ চেয়ে একটি প্রকল্প সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে।

তথ্য-প্রযুক্তি ও কৃষি

ইত্তফোক-০৯/০৫/০৯

বর্তমান বিশ্ব তথ্য-প্রযুক্তির বিশ্ব। জীবন উন্নয়ন ও টেকসই বিশ্ব গড়তে তথ্য প্রযুক্তির সেবা আবশ্যক। বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর। সে কারণে গ্রামীণ জনগোষ্ঠির জীবনযাত্রা উন্নয়নে তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক ই-কৃষি এনে দিতে পারে নতুন সম্ভাবনা। কৃষকের চাহিদা মাফিক, সঠিক সময়োপযোগী ও আধুনিক তথ্য, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ প্রযুক্তি ইন্টারনেট, মোবাইল -এর মাধ্যমে সরবরাহ করলে তা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

কৃষি তথ্য প্রযুক্তি কেন?
পরিবর্তিত জলবায়ু ও বাজার অর্থনীতির প্রভাবে কৃষি এখন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। আš-র্জাতিক বাজারনীতি, অর্থনীতি, বিপণন অবকাঠামো, জীব-বৈচিত্রের পরিবর্তন কৃষিকে সত্যিকার অর্থেই হুমকির মুখে পড়েছে। কৃষিক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যা হচ্ছে-

গ্রামীণ পর্যায়ে কোন তথ্য কেন্দ্র নেই। কৃষকবান্ধব তথ্য-প্রযুক্তির ডিজিটাইজেশন অপ্রতুল। কৃষক সংগঠন ও সমবায় ব্যবস্থার অভাব। বাজার অবকাঠামো ও বিপণন ব্যবস্থার সাপ¬াই চেইন ব্যবস্থাপনার অভাব। উৎপাদক ও ভোক্তাবান্ধব কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন অসম

কৃষিঋণ ও কৃষি ভর্তূকির সরকারি তথ্য সরবরাহ সম্প্রচার অপর্যাপ্ত। সময়োপযোগী ও চাহিদাভিত্তিক তথ্যের বি¯-ার কম।

এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধান ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ই-কৃষির ব্যবহার আনতে পারে কাক্সিক্ষত সাফল্য।

তথ্য প্রযুক্তির বা¯-বায়নের কৌশল :

ই-কৃষি : জাতীয় কৃষি নীতিতে ই-কৃষি অšর্-ভূক্তকরণ। ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি তথ্য কেন্দ্র সম্প্রসারণ। কৃষি সংশি¬ষ্ট ব্যক্তিদের আইসিটি বিষয়ে উৎসাহী ও প্রশিক্ষিতকরণ। কৃষকবান্ধব ই-কৃষি কনটেন্ট তৈরি ও ব্যবহার। ওয়েব টিভি, ওয়েব বেতার চালু করা। কমিউনিটি বেতার চালুকরণ। পূর্ণাঙ্গ কৃষি চ্যানেল প্রতিষ্ঠা ও সম্প্রচার। টেরিস্ট্রিয়াল ও স্যাটেলাইট চ্যানেলে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠানের সম্প্রচার সময় বৃদ্ধি।

কমিউনিটি পর্যায়ে কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন : আধুনিক কৃষি তথ্য সেবা প্রদানের জন্য কমিউনিটি পর্যায়ে ওয়ানস্টপ সার্ভিসের আদলে কৃষিভিত্তিক যাবতীয় তথ্য প্রদানের ব্যবস্থা করা। আর এ তথ্য কেন্দ্র থেকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠি পেতে পারে কৃষি, মৎস্য, পশুসম্পদ এবং সরকারে নীতি বা¯-বায়ন কৌশলসহ স্বাস্থ্য, বাজারদর, কৃষি বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র। তাছাড়া কৃষি বিষয়ক মুদ্রণ সামগ্রী- বুকলেট, লিফলেট, ও প্রশিক্ষণ সুবিধা এবং ফোন ইন প্রোগ্রামের সুবিধা।

কমিউনিটি বেতার : রেডিও ছোট, সহজে বহনযোগ্য ও দামেও স¯-া। সেদিক দিয়ে এটি বেশ সহজলভ্য। কমিউনিটি উন্নয়ন কনসেপ্টকে ব্যবহার করে কমিউনিটি বেতার এর মাধ্যমে সুবিধা বঞ্চিত এলাকার জনগণের চাহিদামাফিক তথ্য সরবরাহ করা সম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এলাকাভিত্তিক লাগসই ও টেকসই কৃষিপ্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও স্থানীয় উন্নয়নের মাত্রিক পরিবর্তন আনয়ন করা সম্ভব।

কৃষি সেবা লাইন/ ফোন ইন সুবিধা : বর্তমানে মুঠোফোনের জোয়ারে ভাসছে এদেশ। সেই মুঠোফোন হতে পারে কৃষির একটি হেল্প লাইন। এতে ইন্টার অ্যাকটিভ ভয়েস রেকর্ড, মেসেজ, বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ও বিরূপ আবহাওয়ায় করণীয় বার্তা প্রদান এনে দিতে পারে কৃষিষেত্রে তাৎক্ষণিক গতি ও সাফল্য।

তথ্য-প্রযুক্তির অফুরš- ভাণ্ডার থেকে ই-কৃষির সফল বা¯-বায়ন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং কৃষি ও কৃষকের ভাগ্যোন্নয়নের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে এগিয়ে নিবে অনেক দূর।

আমন মৌসুমে ভাল একটি ধানের জাত চাই

মোঃ রফিকুল ইসলাম, কৃষক ও কৃষক সংগঠক, নাটোর

আমাদের দেশে ধানের মৌসুম বলতে আগে আউশ-আমন মৌসুমকেই বোঝাতো। আমাদের বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটাতে বেরো মৌসুম ধান উৎপাদনে যোগ হয়েছে। আউশ মৌসুমে পরিমাণে খুব কম এবং আমন মৌসুমে বেশি ধান হয়। যুগ যুগ ধরে দেশি ধানই আমাদের খাদ্যের চাহিদা মেটাত। জনসংখ্যা বাড়ার কারণে দেখা দেয় অধিক ফলনশীল ধানের জাত।

আমাদের দেশে সর্বপ্রথম ধান গবেষণা শুরু হয় ১৯১০ সালে ঢাকা সংসদ ভবন এলাকায় যা ঢাকা ফার্ম বা মণিপুরি ফার্ম হিসেবে পরিচিত। তখন থেকে ১৯৬০ সাল পর্যš- অর্ধ শতাব্দীব্যাপী গবেষণায় উদ্ভাবিত হয় ৬০টি স্থানীয় উন্নত ধানের জাত। এটা আমাদের ধান গবেষণার ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়। দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ষাট দশকের মাঝামাঝি থেকে উফশী ধান উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে। ১৯৬০ সালে ফিলিপাইনে আš-র্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরি উষ্ণমণ্ডলীয় জলবায়ু অঞ্চলের জন্য উফশী ধানের প্রবর্তক। বাংলাদেশে ধান আইআর-৮ সংগ্রহ করা হয় এবং উচ্চ ফলন দেখে ১৯৬৭ সালে মাঠ পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য জাতটি অনুমোদন দেয়া হয়। এ খাটো আকৃতির উফশী ধান থেকে বিঘাপ্রতি ১৮-২১ মণ ফলন পাওয়া যায়। প্রচলিত ধানের চেয়ে এর ফলন দেড় থেকে দুইগুণ বেশি। তখন থেকে লোকমুখে ‘ইরি ধান’ এ দেশে পরিচিত লাভ করে। ঢাকা ফার্মের আদি ধান গবেষণা থেকে সময়ের পরিক্রমায় ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) প্রতিষ্ঠিত হয়। গত ৩৭ বছরে ব্রি-র বিজ্ঞানীগণ নিরলস গবেষণা করে মৌসুম ও পরিবেশ উপযোগী একটি হাইব্রিডসহ ৫০টি উফশী ধানের জাত আবিষ্কার করেছেন। বর্তমানে ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাত দেশের মোট ধানি জমির শতকরা ৭৫ ভাগে চাষাবাদ করা হচ্ছে এবং এ থেকে পাওয়া যাচ্ছে মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৮৭ ভাগ। তাই ব্রি-ধান ইরি ধানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। যে ধান গাছের সার গ্রহণ ক্ষমতা অধিক এবং ফলন বেশি তাকেই উফশী ধান বলা হয়। আমন মৌসুমে বি আর-১১ জাত ১৯৮০ সালে চাষের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট আই আর -২০ এবং আই আর-৫-৪৭-২ জাতের মধ্যে শংকরায়ন করে বি আর-১১ উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ ধানের কৌলিক সারির নম্বর করা হয়েছে। এ ধানের কৌলিক সারির নম্বর-৫২, ৮৭-১ এইচ আর ৮৮। এ ধানের জনপ্রিয় নাম মুক্তা।

আমন মৌসুমে এ জাতটি সারা দেশে জনপ্রিয় ছিল। আš-র্জাতিক ফলন প্রতিযোগিতায় এ ধান ভাল ফলন দিয়েছে। মুক্তা ধান স্বল্প আলোক সংবেদনশীল। স্বল্প আলোক সংবেদনশীলতার জন্য এ জাত জ্যৈষ্ঠর ২০-২৫ তারিখে বপন করলে কার্তিকের মাঝামাঝি সময়ে ফসল কাটা যায়। ফলে ওই জমিতে সময় মত গম, ডাল ও তেল ফসল করা যায়। দুই যুগেরও বেশি সময় মুক্তাধান এদেশে মুক্তার মতই উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে ১৯৮৭ সালে ৩৩ শতাংশ এক বিঘা জমি থেকে আমি শুকনা ২৪ মন মুক্তাধান পেয়েছিলাম কিন্তু গত বছর বিঘাপ্রতি হয়েছে ১২ মণ। সময়ের পরিবর্তনে দেশের জনপ্রিয় আমন মৌসুমের সর্বোচ্চ ফলনশীল বি আর-১১ বা মুক্তা ধানের উৎপাদনে এখন ভাটা পড়েছে। অনেক এলাকায় বি আর-১১ ধান লাগালে উৎপাদন খরচই উঠছে না। কিন্তু দুই যুগ এই বি আরÑ১১ ধান আমন মৌসুমে সর্বোচ্চ ফলন দিয়েছে। মুক্তা ধানের এই ফলনের কারণে অনেকে আমন মৌসুমকে বি আর-১১-র মৌসুম বলত। এই ধানে মুড়ি ভাল হয়। ভাত মোটা হলেও খেতে সুস্বাদু। আমন মৌসুমের জন্য যতগুলো জাত আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে মুক্তার ফলন সবচেয়ে বেশি ছিল। আমাদের মধ্যে আর্শীবাদ স্বরূপ এই ধান এসেছিল।

এমন একটি জাত আবিষ্কারের জন্য ধানবিজ্ঞানীদের কৃষকদের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাই। কালের পরিবর্তনে নানা রোগ-বালাই ও ফলন কমে যাওয়ার কারণে বি আর-১১ ধানের স্থান দখল করে নিচ্ছে ইন্ডিয়ান স্বর্ণা, লাল স্বর্ণা, গুটি স্বর্ণা ইত্যাদি। যা রোগ-বালাই সহনশীল নয় ও সরকার কর্তৃক অনুমোদিতও নয়। অনুমোদন বিহীন উক্তজাতগুলোর চাষাবাদ কৃষির জন্য হুমকি স্বরূপ। বি আর-১১ ধানের যে ফলন কৃষকেরা পেয়েছে ওই রকম ফলন এখন কোন জাতের ধানের আর হচ্ছে না। আমন মৌসুমের জাতগুলো কম ফলনশীল হওয়ায় কৃষকদের এখন আমন ধান করে আনুপাতিক হারে লাভবান হতে পারছে না। আমরা জানি, আমাদের ধানবিজ্ঞানীরা অক্লাš- পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ফলনশীল জাতের জন্য। আমাদের যত কষ্টই হোক বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটাতে মুক্তার অনুরূপ ফলনশীল জাতের বিকল্প নেই। যত কষ্টই হোক বা যেভাবেই হোক মুক্তার অনুরূপ জাত আমাদের আবিষ্কার করতেই হবে। তাই বিধাতার কাছে প্রার্থনা করি মুক্তার অনুরূপ জাত আমাদের আরও দরকার।

এবার বাজারবান্ধব বাজেট চাই

ইত্তফোক-০৬.০৫.০৯
এবার বাজারবান্ধব বাজেট চাই
ড. শামসুল আলম মোহন

বাজার অর্থনীতিতেও বার্ষিক, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করা হয় না। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে এবং একটি বাস্তবায়নযোগ্য প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত থাকতে হয়, যার ভিত্তিতে মধ্যমেয়াদী এবং বার্ষিক পরিকল্পনার ছক আঁকতে হবে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, দাতাদের পরামর্শে, পাঁচ বছর মেয়াদী লক্ষ্য মাত্রার ভিত্তিতে যে বাৎসরিক পরিকল্পনা হত তা ছেড়ে দিয়ে বিগত জোট সরকারের আমল থেকে পিআরএসপি নামীয় দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির নামে বার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন শুরু করেছিলাম। আমার মনে হয়, জাতিগতভাবে এতে আমরা বড় কিছু অর্জনে লক্ষ্যচ্যুত হয়েছি। আমাদের উন্নয়ন প্রয়াস সবকিছু খুবই স্বল্পমেয়াদী কিংবা এডহক ভিত্তিতে চলছিল। উন্নয়নকে বেগবান করতে জাতির একটি স্বপ্ন চাই। স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা চাই। তেমন একটি প্রেক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ২০০৮-এ পেশ করা হয়েছে। ২০২১ পর্যন্ত দিনবদল নামীয় যে রূপকল্প (ভিশন) প্রণীত হয়েছে যে সনদে, সেটাই হতে হবে আগামী পঞ্চ-বার্ষিক পরিকল্পনার উন্নয়ন ও বাজেট যোজনার ভিত্তি। ২০২১ সাল পর্যন্ত সে প্রেক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাৎসরিক পরিকল্পনায় থাকবে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি। আমরা যখন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পথ ছাড়লাম তখন থেকে পরিকল্পনা কমিশনও গুরুত্ব হারিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। বার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যেন ফাইন্যান্স মিনিষ্ট্রির রুটিন একাউন্টিং দলিল প্রণয়ন। এরকম কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এক সময় বাজেট আসছে বলে, নতুন ট্যাক্সও আসছে, বাড়বে জিনিসপত্রের দর-দাম-বাজেট ঘোষণার প্রাক্কালে জনগণ এমন ভীতিতে আক্রান্ত হত। এরকম অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। বাজেট হবে প্রেক্ষিত পরিকল্পনার রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে বাৎসরিক উন্নয়ন কর্মসূচির সুনির্দিষ্ট ঘোষণা। থাকবে দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মসূচি, শ্রেণীতে শ্রেণীতে ও অঞ্চলে অঞ্চলে আয় বৈষম্য হ্রাসের স্পষ্ট নির্দেশনা। বাজেট একাউন্টিং দলিল না হয়ে সে কারণেই হতে হবে রাজনৈতিক লক্ষ্যাদর্শ বাস্তবায়নের, জাতিকে উজ্জীবিত করার দলিল। সে কারণেই ‘পরিকল্পনা কমিশন’কে দেখতে চাই একটি শক্তিশালী, প্রফেশনালদের সমন্বয়ে গঠিত ‘জাতির পরিকল্পনার থিংকট্যাঙ্ক’ হিসেবে, আমলা পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে নয়। আশা করি সরকার পরিকল্পনা কমিশনকে শক্তিশালীকরণে দ্রুত পদক্ষেপ নিবেন।
জাতীয় পরিকল্পনা হওয়া উচিত একটি সমন্বিত পরিকল্পনা অর্থাৎ যতটি উপজেলা তার প্রতিটিতেই থাকবে বাৎসরিক পরিকল্পনা, জাতীয় দলিলটি হবে সে সবের একটি সমন্বিত চিত্র। এমন সমন্বিত জাতীয় পরিকল্পনাই জাতির সঠিক ক্ষমতা ও সম্ভাব্য কর্মযজ্ঞের একটি প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে পারে। বাৎসরিক যে বাজেট দলিল প্রণীত হচ্ছিল তা উপর থেকে চাপিয়ে দেয়ায় বলা যায় একটি সুপারফিসিয়েল দলিল। এর থেকেও আমাদের বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। দেশের প্রতিটি এলাকায় কর্মযজ্ঞের পরিকল্পনা ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে উন্নয়ন হয় ভারসাম্যহীন কিংবা উপর থেকে চাপিয়ে দেয়ায় যা যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানে হয়তো তাই গড়ে উঠে, শেষ পর্যন্ত বহু প্রকল্পই হয় অপচয়ের শামিল। আমাদের দেশে প্রকল্প অপচয়ের উদাহরণ অসংখ্য।
আসন্ন বার্ষিক বাজেটটি (যা জুন মাসের প্রথমার্ধে ঘোষিত হবার কথা রয়েছে) আমরা চাই দেশের সর্বাধিক কল্যাণে হোক একটি বাজারবান্ধব দলিল অর্থাৎ উৎপাদক কিংবা ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সবার জন্যই এটি যেন সমান সুযোগের সৃষ্টি করতে পারে, কাউকে সমর্থন করতে গিয়ে অন্য কোন উৎপাদক গোষ্ঠী যেন অতিরিক্ত খরচের সম্মুখিন না হয়। আমাদের ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করার প্রবণতা বেশ জোরদার। বিগত কয়েক বছর যাবৎ আমাদের ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ বাড়ছেই। এর কুফলটা পড়ে ব্যক্তিখাতের উৎপাদক শ্রেণীর উপর। কেননা, সরকারের ঘাটতি বাজেটের প্রধান উৎস ব্যাংক ঋণ অথবা অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপানো। সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অত্যধিক ঋণ গ্রহণ করলে ব্যক্তিখাতে ব্যাংক প্রদেয় ঋণ কমতে থাকে (অর্থনীতির ভাষায় ক্রাউডিং আউট)। সরকারি ঋণের অত্যধিক চাহিদার ফলে, সুদের হার বেড়ে গিয়েও, ব্যক্তি বিনিয়োগের খরচ বাড়িয়ে দেয়। সরকারি ব্যয়ের অদক্ষতা সর্বজন বিদিত। সরকারি ঘাটতি বাজেটের অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেতে পারে। এসব কারণে, যুদ্ধকালিন সময়, প্রাকৃতিক কারণে বিপর্যয় মোকাবেলা ব্যতীত ঘাটতি বাজেটকে কখনেই বাজার বান্ধব বাজেট ভাবা যায় না। আমরা সর্বান্তকরণে চাইবো, একটি বিশাল ঘাটতি বাজেট না হোক। আমরা যেন প্রায় ব্যালান্সড বাজেট প্রণয়নে সক্ষম হই। বিশাল আকারের ঘাটতি বাজেট আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য আত্মপরাজয়ী। যেখানে বাৎসরিক উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ৪০-৪৫% শতাংশ বাস্তবায়নে আমরা সক্ষম হই সেখানে বাজেটের হিসেবে বড় বড় অংক দেখিয়ে লাভ কি? ষাট হাজার কোটি টাকা আমাদের রাজস্ব আয়, অথচ বাজেট করা হয় এক লক্ষ হাজার কোটি টাকার উপর, এটা অনেকটা পরিকল্পনাহীনতার নামান্তর।

একটা সাধারণ মাইন্ড-সেট এরকম যে, ভর্তুকি শুনলেই আমরা খুব খুশি হই। ভর্তুকির সুবিধা সরাসরি কতটা কৃষকের হাতে পৌঁছে, এসব ক্ষেত্রে অনেক দুর্নীতির কাহিনী রয়েছে। ভর্তুকি মানে একখাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয় করা। ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষক উপকৃত হলে দরিদ্রের নিকট আয় হস্তান্তরে হয়তো একটা ভূমিকা থাকে। ভর্তুকি দেয়া উপকরণ যথা সার, ডিজেল বর্ডারের ওপাড়ের তুলনায় অনেক সস্তা হয়ে গেলে, স্মাগলিং এর ব্যাপকতা বেড়ে যেতে পারে। পণ্যের বাজার দাম, পণ্যের প্রকৃত মূল্যকে প্রতিফলিত না করলে, সেই পণ্যের ব্যবহারে অপচয়, অত্যধিক ব্যবহার কিংবা চোরাচালানকে উৎসাহিত করতেই পারে। এসব কারণে ভর্তুকি দেয়ার ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক এবং লাভ লোকসানের হিসেবটা খুব ভালভাবেই করতে হবে। ঢালাও ভর্তুকি অপচয়ের শামিল। ভর্তুকি দেয়া কিংবা মূল্য সমর্থন দেয়ার ক্ষেত্রে যত সমাদর কেবল ধান ফসলই পেয়েছে। সে কারণেই আমাদের শস্যখাত বিবেচনায়, আমাদের কৃষিকে বলা যায়, ‘মনো-ক্রপ’ এগ্রিকালচার বা প্রায় এক ফসলের প্রাধান্যের কৃষি। দেশের ৭৬ শতাংশ জমিই ধান চাষে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অন্যান্য সব ফসলই প্রায় অবহেলিত। মশলা ফসল, তেলবীজ, ডাল ফসলে আমাদের কোন উন্নয়ন অগ্রগতি নেই বললেই চলে। আমাদের পেঁয়াজ, রসুন, আদা এখনো খুবই ক্ষুদ্রাকৃতি আকারের এবং বিঘাপ্রতি ফলনও সামান্য। এসব ফসলে আমরা প্রায় পুরোটাই আমদানী নির্ভর। গবেষণার ক্ষেত্রে এসব গুরুত্বপূর্ণ ফসল এখনো খুবই অবহেলিত। ভর্তুকি ও মূল্য সমর্থন দিয়ে আমরা আমাদের কৃষিকে বাস্তবে ‘ধানের কৃষি’ করে ফেলেছি। সর্বতোভাবে কৃষিকে বহুমুখি করার প্রণোদনা থাকতে হবে বাজেট পরিকল্পনায়।

আসন্ন বাজেটে কৃষি গবেষণা ক্ষেত্রে, বিশেষভাবে বীজ উন্নয়ন ও উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি, জৈব প্রযুক্তি, টিস্যু কালচার ইত্যাদি বিষয়ে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও বিশেষ থোক বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, কৃষি গবেষণায় বিনিয়োগ উচ্চ প্রতিদান দিয়ে থাকে। গবেষণায় সফলভাবে বিনিয়োগে ১ টাকা ব্যয়ে ১০ টাকার প্রতিদান পাওয়া যায়। কৃষি গবেষণার জন্য ‘নার্স’ ভুক্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জোরদার করা প্রয়োজন। পূর্বে কৃষি গবেষণায় থোক বরাদ্দ অব্যবহৃত কেন থেকেছে তা অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। গবেষণা কাজের মূল্যায়ন ও মনিটরিং এর জন্য কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। মূল্যায়ন ব্যবস্থা জবাবদিহিতা তৈরী করে। কৃষি জমিও খুব আশংকাজনকহারে কমছে। জনসংখ্যা কমছে বলে আমরা খুব তৃপ্তি অনুভব করতাম, অথচ বাংলাদেশে জনসংখ্যা এখনো যে অপরিকল্পিতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আগামী এক দশকেই দেশ একটি ভয়ংকর জনসংখ্যা বিস্ফোরণের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। এতদবিষয়ে এখনই সরকারকে আরো সতর্ক এবং কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। চীন, সিকি শতাব্দী পূর্ব থেকেই খুব কঠোর নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে এক দম্পত্তি এক সন্তান নীতি বাস্তবায়ন করে চলেছে। চীনের অবস্থার চেয়ে আমাদের জনসংখ্যা পরিস্থিতি খুবই গুরুতর। অথচ আমাদের এ বিষয়ে পদক্ষেপ খুব জোরালো নয় এবং বলা যায় খুবই বিচ্ছিন্ন ও হতাশাব্যঞ্জক।
দেশীয় শিল্প-কারখানা রক্ষার নামে কর কাঠামোর মাধ্যমে কোন অদক্ষতাকে লালন ও পোষণের ব্যবস্থা যাতে না করি। লোকসান হতে হতে বন্ধ হয়ে যাওয়া কল-কারখানা আমরা পুনরায় চালু করার কথা বলছি কার স্বার্থে? এসবের লোকসানের টাকা কার পকেট থেকে আসবে? দেশীয় শিল্পের নামে অত্যধিক চড়া দামে আমাদেরকে কেন চিনি খেতে হবে? দেশীয় শিল্প এমনভাবেই রক্ষা করতে হবে যাতে; আমদানী পণ্যের চেয়েও কম দামে ভাল মানের পণ্য ভোক্তার হাতে পৌঁছাতে পারে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা করতেই হবে। শিল্পায়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের এটাই হবে সর্বোত্তম উপায়। আমদানী যতটা সম্ভব উন্মুক্ত রাখুন। আমদানীর ক্ষেত্রে মূলধন যন্ত্রপাতি প্রযুক্তিকে যতটা সম্ভব সহজলভ্য করে দিন। এতে দেশে শিল্পায়নের গতি বৃদ্ধি পাবে। দেশে তৈরী হয় না এমন কৃষি যন্ত্রপাতি, প্রক্রিয়াজাতকরণ যন্ত্রপাতি নিম্নতম ‘আমদানী করে দেশে আসতে দিন। সব মিলিয়ে বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় আমাদের সংযুক্তিকে ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে। আন্তঃ দেশীয়, আন্তঃ মহাদেশীয় যোগাযোগ, স্থলপথে, আকাশপথে, নৌপথে যতশীঘ্র সম্ভব উন্মুক্ত করে পণ্য চলাচলকে অবাধ করে দেয়ার পদক্ষেপ দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। প্রতিযোগিতায় আমাদের উৎপাদক, ব্যবসায়ীরা, আরো দক্ষ হয়ে উঠবে। দক্ষতার সংগে পণ্য উৎপাদিত না হলে ভোক্তা কখনো কম দামে পণ্য পেতে পারে না।
আমাদের দেশে আয়-বৈষম্য এখন উৎকটভাবে দৃষ্টিকটূ। আয় বৈষম্য কমিয়ে আনতে বাজেটে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ চাই। যেসব ব্যাংকিং বা শিল্পগোষ্ঠী সমাজ কল্যাণে, যেমন দরিদ্রের জন্য বৃত্তি, হাসপাতালে অনুদান, পাবলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষণা মূলধন প্রদান ইত্যাদিতে মুনাফার পঞ্চাশ শতাংশের অধিক ব্যয় করে, সে সব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে এনে উৎসাহ প্রদান করা যেতে পারে। এসব ব্যয়ের সবটাই কর অবকাশের আওতায় আসতে পারে।

সর্বোপরি জনকল্যাণমুখি এই সরকারের কাছে আমাদের প্রস্তাবনা থাকবে, দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক নিরাপত্তা জাল আরো বিস্তৃত করতে হবে, যেমন বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, সন্তান-সন্ততিহীন দুস্থ পরিবারের জন্য ভাতা ইত্যাদি। এক সন্তানের জন্য দরিদ্র পরিবার ভিত্তিক মাতৃত্বকালীন ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি করে প্রতিটি উপজেলায় এর বিস্তৃতি ঘটাতে হবে। স্পেনীয় সরকারের সহায়তায় জনাব এ,এইচ,এম নোমান সাহেবের এনজিও ‘ডরপ’ এক্ষেত্রে পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চমৎকার দৃষ্টান্ত রেখেছেন। সেই অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৪ হাজার ইউনিয়নের প্রতিটিতে মাত্র ১৫ জন করে ষাট হাজার গর্ভবতী দরিদ্র মাকে বিগত অর্থবছরে ২৪ মাসের জন্য প্রতিমাসে ৩০০ টাকা করে মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা রেখেছিলেন, যা সন্তান ধারণ ও লালন পালনে রাষ্ট্রের এই সহায়তা যথেষ্ট প্রভাব রেখেছে। এই কর্মসূচিটি সারা দেশে বিস্তৃত হওয়া প্রয়োজন, মাসিক ভাতার পরিমাণকেও অবশ্যই দ্বিগুণ করতে হবে। সর্বতোভাবে বাজেটের দর্শন স্থিরকৃত হবে দারিদ্র্য বিমোচনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে এবং বাস্তবায়নে এটি হতে হবে সার্বিকভাবে বাজার বান্ধব। সমষ্টিকে নিয়ে সব ব্যক্তি উদ্যোগ কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনই হবে বাজেটের শেষ কথা। প্রবৃদ্ধি হলেই খাদ্যসহ জীবনের সব নিরাপত্তাই অর্জিত হতে পারে। সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হলে এবং প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় যথাযথ এগিয়ে যেতে পারলে বর্তমানের ৪০ শতাংশ বেকারত্বের হার ২০২১ সালে অবশ্যই ১০ শতাংশের নিচে নেমে আসবে। বাংলাদেশ পরিণত হবে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে।


[লেখক: কৃষি অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ ও প্রফেসর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়]

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ

ইত্তফোক- ০১.০৫.০৯
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ
প্রফেসর নজরুল ইসলাম, পরিবেশবিদ ও চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের উপর বিরাট প্রভাব পড়তেই পারে। বলা উচিত ইতিমধ্যেই এর প্রভাব পড়তে শুরু হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন বলতে প্রথমেই বুঝবো জলবায়ুর যে মূল উপাদানগুলো রয়েছে অর্থাৎ তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ুর আর্দ্রতা, এবং বায়ুপ্রবাহের গতিবিধি ও বেগ। এগুলোর পরিবর্তনশীলতা আর পরিবর্তন আমরা পরিমাপ করি একটা দীর্ঘ সময়ে। তবে কমপক্ষে বিশ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে এই উপাদানগুলোর পরিবর্তন হতে পারে। আরও হয়তো সঠিক হবে যদি আরও দীর্ঘ সময়ের পরিবর্তন ধরি। অর্থাৎ চল্লিশ বছর ধরে যদি জলবায়ুর এই পরিবর্তন ধরি। সে হিসেবে যদি আমরা সাম্প্রতিক সময়ের হিসেবটাও দেখি- তাহলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে তাপমাত্রার এই পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে উচ্চ তাপমাত্রা যেমন বর্তমান সময়েই আমরা দেখতে পাই ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্যান্য শহরে উচ্চ তাপমাত্রা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কালবৈশাখীর সময় যে বৃষ্টিপাত হয় তা হচ্ছে না বলে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বৈশ্বিক যে জলবায়ু পরিবর্তন তা থেকে সারা বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। যদি এক ডিগ্রি বা দুই ডিগ্রি বাড়ে তবে বাংলাদেশেও তার মাত্রা বাড়তে থাকবে। বৃষ্টির পরিমাণ ও বৃষ্টির সময় কখনো বৃষ্টি ঠিক সময়ে হবে না, যার ফলে এর প্রভাব বা মূল যে কাঠামো তা কৃষির উপর বিরাট ভূমিকা রাখে।
দুর্যোগ যেমন সাইক্লোন, টর্নেডো ইত্যাদির প্রকোপটাও দিন দিন বাড়ছে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন যে সাইক্লোন বলা চলে তার তীব্রতা বাড়ছে। তাতে করে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রচণ্ড আঘাতে বিধ্বস্ত হচ্ছে ঘর-বাড়ি, নষ্ট হচ্ছে ফসলের ক্ষেত। বন্যাও আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে বেড়ে যায়। আগে যেখানে দশ বছর অন্তর অন্তর বন্যা হতো, তা এখন দুই বছর পর পর হয়ে যায়। এই ভিন্নতা বৈশ্বিক জলবায়ুর জন্যেই হচ্ছে। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় নদী ভাঙ্গনের বিষয়টি। এতে অসংখ্য পরিবার বাড়ি-ঘর হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষির তো আর পরিবর্তন করা যায় না। যার ফলে কৃষিরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্বাস্থ্য সমস্যারও প্রকোপ বাড়ে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে চারদিকে অসুখ-বিসুখ ছড়িয়ে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্থাবর সম্পত্তির ক্ষতি হয়। এ কথাগুলো বলছি এজন্যে যে, ইদানীংকালে শিল্পায়নের কারণে এই পরিবর্তনটা আসছে। শিল্পায়নের কারণে রাষ্ট্রীয় দূষণ হয়। এটি হচ্ছে পরিকল্পনার ও বাস্তবায়নের দুর্বলতার কারণে। নগরায়ন যদি অপরিকল্পিতভাবে দ্রুততার সঙ্গে হয় তাহলে ক্ষতি বেশি হবেই। আমার মতে বৈশ্বিক পরিবর্তনটা স্থানীয় উন্নয়নের কারণেই ঘটছে। উন্নয়নটা যদি পরিকল্পনা মাফিক ও পরিবেশ সমন্বিতভাবে হতো তাহলে এর প্রভাবটা সারা বিশ্বে পড়তো না, তা না হলে যেভাবে অপরিকল্পিতভাবে এবং পরিবেশকে বিনষ্ট করে উন্নয়ন হচ্ছে তাতে জলবায়ুর পরিবর্তনটা তীব্রভাবে অনুভূত হবে- এটাই স্বাভাবিক।


প্রফেসর ড. এম. নজরুল ইসলাম, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এই নদী ভরাট সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য যে প্রযুক্তি ও অর্থের প্রয়োজন তা কি আদৌ বাংলাদেশের রয়েছে? বাংলাদেশে জলবায়ুর অনেক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। দিনদিন গড় তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি শীতকালে তাপমাত্রা দিনদিন কমে যাচ্ছে। সাধারণত মে-জুন মাসে গড় তাপমাত্রা থাকার কথা ৩০-৩৬ সে.গ্রেড, কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ৩৮-৪২৭ পর্যন্ত উঠানামা করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের অনেক নদী-নালা শুকিয়ে যাচ্ছে, ফলে জীববৈচিত্র্য ও কৃষি কাজের সেচের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে ভূ-গর্ভস্থ পানির অভাব ঘটবে এবং কৃষি কাজে সেচের মারাত্মক সমস্যা দেখা দিবে। কারণ বর্তমানে যেভাবে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে তা যদি ত্বরিত বন্ধ করা না হয় তবে এর বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশের জলবায়ুকে আরো অসহিষ্ণু করে ফেলবে বলেই পরিবেশবিদ ও জলবায়ু বৈজ্ঞানিকদের অভিমত। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের পরিবেশগত বিপর্যয়ের জন্য বাংলাদেশের যতটা না ভূমিকা রয়েছে তার চেয়ে বেশী ভূমিকা রয়েছে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে পানিচুক্তি থাকলেও অনেক সময় তার সুষম বন্টন সম্ভব হচ্ছে না। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিপর্যয় রক্ষার জন্য আাঞ্চলিকভাবে তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে না। আমরা পশ্চিমা দেশের দিকে দেখতে পাই সুইডেনে এসিড রেইন হতো, সংগে সংগে পশ্চিমা দেশগুলো এটা মোকাবিলার জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা তৈরী করেছিল সালফার প্রটোকল-১ ও পরবর্তীতে সালফার প্রটোকল-২ নীতিমালা। এই নীতিমালার মাধ্যমে সালফার ডাই অক্সাইড ও কার্বণ মনোঅক্সাইড অপেক্ষাকৃত ধনী রাষ্ট্রগুলো প্রয়োজনীয় মাত্রায় উভয়-দূষক ৩০% এবং পরবর্তীতে ৬০% হারে কমিয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে সালফার প্রটোকলকে ত্বরান্বিত করার জন্য যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে অপেক্ষাকৃত কম অর্থনীতিক উন্নত দেশগুলো যেমন: সুইডেন, পোল্যান্ড এবং স্পেনকে ভর্তুকি দিতে থাকে। বর্তমানে পশ্চিম ইউরোপের এসিডিফিকেশন এন্ড ইউট্রোফিকেশন-এর মাত্রা আগের তুলনায় অনেকাংশে কমে এসেছে। এতকিছুর পরও উন্নত পশ্চিমা দেশগুলো অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ন ও ফিটনেস বিহীন স্থলজ ও সামুদ্রিক পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করে থাকেন। নর্থ-সাউথ কনফ্লিক্টের নামে তারা পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য অনুন্নত ও উন্নয়নকামী দেশগুলোকে ব্যাপকভাবে চাপ দিয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে শিল্পোন্নত দেশগুলো অতিরিক্ত মাত্রায় শিল্পায়ন ও ভোগের ফলে পরিবেশের উপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। ক্লাব অব রোম রিপোর্ট ১৯৭৩ এবং কমন ফিউচার অব আর্থ রিপোর্টে পশ্চিমা দেশগুলোর অতিরিক্ত মাত্রায় উন্নয়ন ও ভোগবাদী সমাজের স্বেচ্ছাচারিতাকে পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য হুমকি হিসাবে দেখানো হলেও পশ্চিমা বিশ্ব বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গঠিত রিওডিও সামিট, কিয়োটো প্রটোকল এবং জোহানেসবার্গ সামিটের মাধ্যমে অনুন্নত ও উন্নয়নকামী দেশগুলোকে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে তাগিদ দেন। তারা মিলেনিয়াম গোল ও এজেন্ডা-২১ ঘোষণা করলেও তার বাস্তবায়নে আমাদের মত উন্নয়নকামী দেশে এর প্রভাব খুব কমই পড়েছে। বিশ্ব জলবায়ু সমস্যা একটি দেশের পক্ষে এককভাবে মোকাবিলা করা খুবই দুরূহ। কারণ দূষক ও দূষণ ট্রান্স বাউন্ডারী সমস্যা। যেমন: ভারতে কোন দূষণ ঘটলে বাংলাদেশের পক্ষে কি তা আটকিয়ে রাখা সম্ভব? তাই আজ সময় এসেছে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব থেকে বরফ ও গ্লেসিয়ার রক্ষা করা। তা না হলে দিন দিন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং বরফ গলতে থাকবে। ফলে সমুদ্র সমতলের উচ্চতা অনেকগুণ বেড়ে যাবে একথা আর কারো কাছেই অজানা নয়। সুখের কথা হলো দেরীতে হলেও পশ্চিমা দেশগুলো তাদের শিল্প কারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড নিয়ন্ত্রণের জন্য উট- (ঊট-ঊঞঝ)কার্বন মার্কেট তৈরী করেছেন। প্রত্যেকটা শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ইমিশনের মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যদি কেউ এর চেয়ে বেশী ইমিট করে তাহলে তাকে অন্য জায়গা থেকে কোটা ক্রয় করে আনতে হবে। আর যদি কম ইমিট করে তাহলে অতিরিক্ত কোটা কার্বন মার্কেটে বিক্রি করতে পারবে। এতসব আশার আলোর মাঝেও পশ্চিমা দেশগুলোর বাংলাদেশসহ অনুন্নত দেশগুলোর পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ে তেমন কোন পরিকল্পনা নেই বললেই চলে। তাই স্বল্প পরিসরে হলেও বাংলাদেশের জলবায়ু ও জলবায়ুগত বিপর্যয় রোধের জন্য বনভূমি রক্ষা থেকে শুরু করে জীববৈচিত্র্য নীতিমালা, জলমহাল নীতিমালা এবং পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনকে জোরদার করা প্রয়োজন। এ জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর সহযোগিতা নিয়ে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভিন্ন এজেন্ডা, প্রটোকল ও পারস্পরিক প্রযুক্তি আদান-প্রদান করা যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে কৃষিনির্ভর বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সমস্যা সমাধানের জন্য নেগোসিয়েশন টেবিলে বসার বিকল্প নেই।


ওয়ালিউর রহমান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত
আইপিসিএস ৪ নম্বর রিপোর্টে গত বছর যে কিছু সিদ্ধান্ত এসেছিল তার মধ্যে একটি হলো বাংলাদেশের মতো দেশ সমুদ্র থেকে তাদের উচ্চতা অনেক কম, তারা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সর্বপ্রথম আঘাতপ্রাপ্ত হবে। এছাড়াও বিভিন্ন জলবায়ু সংক্রান্ত বায়ু পরিবর্তনের ফলে সাইক্লোন ও অন্যান্য ধরনের দুর্যোগের সম্মুখীন হবে। সেখানে বেশ কয়েকটি দেশকে তারা চিহ্নিত করেছে। সিডরের আঘাত আমরা গত বছর যে পেলাম সেটা তারই একটি অংশ। ব্লক সুয়ান সিনড্রম-এ যতগুলো আঘাত আসতে পারে তার ভেতরে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং জাপান পর্যন্ত সেটা আঘাতপ্রাপ্ত হবে। এ সমস্ত দুর্যোগের ব্যাপারে কোন রকমের পূর্ব পূর্বাভাস থাকবে না। যেমন- ইপি-থ্রির-মতো ঘটনা, সুনামি, এভিএন্টফ্লো বা অন্য রকমের ফ্লোর আক্রমণ এসবই থাইওয়ান ও চীনের ভিতরে এই সিনড্রমের কারণে পরিলক্ষিত হবে আগামী পঞ্চাশ বছরের ভিতরে।
কুপেন হেগেনে যে মিটিংটা গত পরশু শেষ হলো তাতে করে দেখা যাচ্ছে যে এই শতাব্দির শেষ পর্যন্ত হিমালয় এবং আর্থটিক অঞ্চলে বরফের যে গলন ধরেছে সি-নিকোশনের ফলে তা যদি বন্ধ না করা যায় তাহলে এই শতাব্দির শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের পানি ১ মিটার ওপরে ওঠে যাবে।
এই প্রেক্ষিতে আমাদের চেষ্টা করতে হবে সে সমস্ত দুর্যোগের ব্যাপারে আমরা যেনো প্রস্তুত থাকি এবং এ ব্যাপারে নেদারল্যান্ডের এবং অন্যান্য দেশের কারিগরি সহায়তা নিতে পারি। এছাড়াও আমরা উপকূলে বাঁধগুলোকে আরও সংরক্ষিত করতে পারি এবং সাইক্লোন শেল্টারগুলোকে আরও অনেক বেশি মজবুত করে তুলতে পারি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে সজাগ এবং আশা করি আমাদের নিকটতম দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি রিজন্যাল ফোরামে সবার সুবিধার্থে এবং সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমাদের দেশকে বাঁচাতে সচেষ্ট হবো।

অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন একটি বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার অবস্থায় বিরাজ করছে। পৃথিবীর বহু বিজ্ঞানী যারা বিশেষ করে আবহাওয়া ও জলবায়ু সংক্রান্ত এবং পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন, তাদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো কি হতে পারে সেটা নিয়ে একটা চিন্তা-ভাবনা চলছে। আগামী ডিসেম্বরে কুপেন হেগেনে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের উপর যে সম্মেলনটি হবে সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব ও করণীয় সম্পর্কে বিশদ আলোচনা হবে। বলা হয়ে থাকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিম্ন সমভূমিগুলো যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা কম সেসব অঞ্চলে সমুদ্র পৃথিবীর উচ্চতা বাড়ার কারণে জলমগ্ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করে অনেকেই। এবং এর ফলশ্রুতিতে বিশ্বের প্রায় ১০ কোটি লোকের বাস্তুবিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমি মনে করি জলবায়ু পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিশ্ব সৃষ্টির সময়কাল থেকেই এই পরিবর্তন মাঝে-মাঝেই সংগঠিত হয়ে আসছে। এবং এর কিছু প্রভাব বিশ্বের বাস্তব্য ব্যবস্থাপনায় কখনো কখনো কিছু কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু খারাপ প্রভাব জনমানুষের উপরে পড়বে বলে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন। এর কারণ হিসেবে তারা বলেছেন যে, গ্রীন হাউস গ্যাস উদ্গীরণের কারণে কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রাচুর্য মানব জীবনে একটা দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। গ্রীন হাউস গ্যাস উদ্গীরণের প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রায় ৩ ডিগ্রী বেড়ে যাওয়ার কারণে মেরু অঞ্চলীয় এবং হিমালয় অধ্যুষিত জমানো বরফ গলে বিপর্যয় সৃষ্টি করার সম্ভাবনা রয়েছে এবং বর্তমানে বরফ গলার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। যার ফলশ্রুতিতে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে পৃথিবীর কিছু কিছু অঞ্চলে এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষি, জনস্বাস্থ্য এবং ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুগত বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও এই জলবায়ুগত পরিবর্তনের প্রভাবে বেশকিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। এবং যার কারণে আমি মনে করি যে এ ধরনের পরিবর্তনের প্রভাব ঘটার আগেই বাংলাদেশের ব্যাপারে পূর্ব থেকেই কিছু পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার চিন্তা-ভাবনা করা উচিত হবে। বিশেষ করে কৃষি, জনস্বাস্থ্য, অবকাঠামোগত দিকগুলো সম্পর্কে কি ধরনের প্রভাব প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা উচিত এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা জরুরী বলে মনে করি।
যেমন কৃষিতে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা এবং সেচ ব্যবস্থায় এই পানির ব্যবহারের উপযুক্ত কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। সুপেয় পানির ব্যবস্থা গ্রহণও এই কর্মপদ্ধতির একটি অংশ হওয়া উচিত বলে মনে করি। বৈশ্বির উষ্ণতার কারণে বাংলাদেশে বিভিন্ন জলবায়ুগত রোগ-ব্যাধি বিস্তারের সম্ভাবনা বেশি বলেই অনেকে ধারণা করছেন। ডায়রিয়া, কলেরা, জলবসন্ত এবং বিভিন্ন ধরনের ক্রান্তি অঞ্চলের ফ্লু জনস্বাস্থ্যের অবণতি ঘটতে পারে। এ বিষয়েও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া দরকার পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করার জন্য বাংলাদেশের নদীগুলোকে আরো সচল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং এজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বৃষ্টি এবং নদীর পানি ধরে রাখার জন্য কি ধরনের অবকাঠামোগত ব্যবস্থা নেয়া যায় সে দিকটাও পরিকল্পনাবিদদের চিন্তা করতে হবে। বিশেষ করে পদ্মার ড্যাম তৈরি করা উচিত। বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগণকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করে তোলাও উচিত বলে আমি মনে করি। ঝড়, ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস এবং লবণাক্ততা সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে সতর্কতামূলক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা এখনই উচিত বলে মনে করি।
জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবিলায় তখন থেকে সরকারের একটা বিশেষ তহবিল গঠন প্রয়োজন বলে মনে করি এবং উন্নত দেশগুলো যাদের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারায় বিরূপ প্রভাব ফেলেছে তাদের কাছ থেকে এই তহবিলের মোটা অংশ আদায় করা উচিত বলে মনে করি। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। হাজার লক্ষ বছরে এই ধরনের এক একটি পরিবর্তন দেখা যায় বর্তমান বিশ্বের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানে উচ্চতর ব্যবহার এই পরিবর্তনের সঙ্গে সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব মানবের কল্যাণ সংগঠিত হবে বলেই বিশ্বাস রাখি।
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিরূপ হতে পারে সে সম্পর্কে আরো বিষদ গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।

ড. আমানত উল্লাহ খান, পরিচালক, দুর্যোগ গবেষণা প্রশিক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জলবায়ুর যে সমস্ত প্রজেকশন করা হয়েছে তার উপাত্তের ভিত্তি যথেষ্ট নয় বলে আমার মনে হয়েছে। এর কারণ হলো বায়ুমন্ডলের গভীরতা কয়েক হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে আমাদের উপাত্ত রয়েছে কয়েকশ’ কিলোমিটার। তাও আবার অনেক ছড়ানো-ছিটানো ওয়েদার স্টেশনগুলো থেকে। এই সব উপাত্তে গত ৫০/১০০ বছরের ডাটা নেই। অথচ পৃথিবীর বয়স কোটি বছরেরও বেশি এবং এই কোটি বছরে বায়ুমন্ডলের নানান পরিবর্তনের অভিযোগ রয়েছে। তবুও গত লক্ষ লক্ষ বছরের মধ্যেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে লক্ষ্য করা গেছে। সেজন্যে এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলা সমীচীন হবে না।আমরা প্রায়সই ‘সি’ লেভেলের কথা শুনি। কিন্তু ‘সি’ লেভেলটা কখনো লেভেল নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠে সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ লেভেলের মধ্যে প্রায় ১২০ মিটারের ব্যবধান রয়েছে। মালদ্বীপ এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠ সর্বনিম্ন। এবং এর কারণ হলো মালদ্বীপ এলাকার লিথলজিক অবস্থা। এখানে মধ্যাকর্ষণ শক্তি সমুদ্রপৃষ্ঠকে নিচে নামিয়ে রাখছে। সে রকমই হালকা রগ ফরমিশন সমুদ্রপৃষ্ঠকে এতোটা আকর্ষণ করতে পারে না, ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ অনেক জায়গায় উঁচু।
সেজন্যই বাংলাদেশে যে অনেক সময় মানচিত্র এঁকে দেখানো হয় যে, এক তৃতীয়াংশ সমুদ্রপৃষ্ঠে চলে যাবে- এটা বিশ্বাসযোগ্য অনেকাংশে মনে হয় না। যেদিন থেকে তারা একথাগুলো বলে আসছে এতোদিনে এক তৃতীয়াংশ চলে যেতে পারতো। যে হারে বরফগলা শুরু হয়েছে তাতে চলে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু আমরা দেখছি এর উল্টোটা। বাংলাদেশের মধ্যে হাওর এলাকাটা অনেকটা নিচু। বদ্বীপ অঞ্চলগুলো অনেকাংশে উঁচু। তাই সবকিছু নিয়ে গবেষণা করতে হবে। শুধু সেমিনার করলেই তো হবে না, পুরো বিষয়টি গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে, বাংলাদেশেও জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। তবে ঘটছে যে না সেটা কিন্তু আমি বলছি না।
আমার কথা হলো এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করা উচিত এবং এটা হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবে। এটা যতটা সাইন্টিফিক থিউরি তার চেয়ে বেশি পলিটিক্যাল থিউরি। পৃথিবীকে যে দু’টি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে, যার কারণেই তো তথ্যানুসন্ধান মার খাচ্ছে। তাই আমার কথা হলো শুধু জলবায়ু পরিবর্তন নয়, এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু যুক্ত রয়েছে। যেমন পরিবেশ। এই পরিবেশের ভারসাম্যের কারণেই বাংলাদেশে এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এটাকে শুধু জলবায়ুর জন্য বলা যাবে না। উন্নয়নের নামে কংক্রিটের জংগল বানিয়ে ফেলা হয়েছে। কোন পরিকল্পনা নেই, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে ইমারতের পর ইমারত। ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।


ড. আইনুন নিশাত
পানি বিশেষজ্ঞ

বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধি বিষয়ে পৃথিবীর সব দেশের মনেই এখন আর কোন সন্দেহ নেই। ২০০৭ সালে এ বিষয়টি পর্যালোচিত হয়েছিল এবং ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক কর্মসূচিগুলোকে ঢেলে সাজানো হবে। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দর কষাকষি চলছে। বাংলাদেশ এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। এই পরিবর্তনের বিষয়ে চারটি লক্ষ্যে কাজ হচ্ছে। প্রথমত, যে কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে তা কমালে অর্থাৎ কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাস উৎপাদন কমালে। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের ভূমিকা নগণ্য বলা চলে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে সমস্ত বিরূপ আবহাওয়ার সম্মুখীন হবো সেগুলোর মোকাবিলা করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তৃতীয় হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। চতুর্থত হলো, সকল কাজে অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিতকরণ।
আমরা মনে করি বাংলাদেশ এই বিষয়টি মোকাবিলা করার জন্যে তার পরিকল্পনা সাফল্যের সঙ্গে তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে যা ঘটতে পারে তার মধ্যে রয়েছে অসময়ে বৃষ্টি, বৃষ্টির অনিশ্চয়তা, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙ্গন, সাইক্লোন, টর্নেডো ইত্যাদির প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়া।
বাংলাদেশ ক্লাইমেক্স চেঞ্জ বিষয়ক যে একশন প্লেন তৈরি করেছে তাতে সর্বপ্রথম দৃষ্টি দেয়া হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের বিষয়ে। তার সঙ্গে জোর দেয়া হয়েছে জীবিকার নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তা। এরপর জোর দেয়া হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থার উপর। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়েছে। বলা প্রয়োজন যে, এ কাজে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। এছাড়া গবেষণা, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যতে যেকোন প্রকল্প হাতে নিলেই যেন বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়টি যেভাবে বিবেচিত হয় সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ বৈশ্বিক উষ্ণতায় বিপর্যস্ত হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ কেবল অন্যতমই নয় বরং বলা যেতে পারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এজন্যে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে নিজস্ব অর্থ থেকে তিনশত কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করেছে। তবে আমার ধারণা, এ কাজে কয়েক হাজার কোটি টাকার মতো প্রয়োজন হতে পারে। কাজেই অর্থ সংগ্রহের বিষয়ে বাংলাদেশকে সচেষ্ট থাকতে হবে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : সৌরভ জাহাঙ্গীর

ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপের উদ্যোগ , বদলে যাচ্ছে সনাতনি ধারা

ইত্তেফাক- ০৩.০৫.০৯
।। মনির হায়দার ।। বদলে যাচ্ছে ভূমি জরিপের সনাতনী ধারা। বর্তমান মহাজোট সরকার ভূমি জরিপের ক্ষেত্রে প্রচলিত প্রাচীন ও জটিল পদ্ধতির পরিবর্তে ডিজিটাল জরিপ পদ্ধতি প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যেই রাজধানীর অদূরে সাভারের ৫টি মৌজায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পাইলট প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ আগামী ৩০ জুনের মধ্যে শেষ করার কথা। এই প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপের কার্যক্রম হাতে নেয়া হবে। এই লক্ষ্যে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের একটি প্রকল্প প্রস্তাব সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইত্তেফাককে এসব তথ্য জানান।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সর্বপ্রথম ভূমি জরিপের কাজ শুরু হয় ১৮৮৭ সালে, যা ক্যাডাস্ট্রাল সার্ভে বা সিএস রেকর্ড নামে পরিচিত। টানা প্রায় ৫৪ বছর ধরে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত এই জরিপ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সিএস রেকর্ডকে এখনো পর্যন্ত জমির মালিকানা নির্ণয়ের মূল ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পটভূমিতে ১৯৫৫ সালে স্টেট এক্যুইজিশন অপারেশনের আওতায় নতুন জরিপ কার্যক্রম শুরু হয়, যা এসএ রেকর্ড নামে পরিচিত। তবে এটি কোন সরেজমিন জরিপ ছিল না। জমিদারদের আওতাধীন প্রজা বা মালিকদের নামে মালিকানা স্বত্ব এবং খাস জমির তালিকা প্রস্তুত করাই ছিল এই জরিপের উদ্দেশ্য। এসএ রেকর্ড প্রণয়নের কাজ শেষ হয় ১৯৬২ সালে।

অন্যদিকে সিএস জরিপের সমাপ্তি লগ্নে জমির মালিকানা ও প্রকৃতি পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪০ সালে বৃহত্তর ফরিদপুর ও বৃহত্তর বরিশাল জেলায় শুরু হয় রিভিশনাল সার্ভে বা সংশোধনী জরিপ, যা আরএস রেকর্ড নামে পরিচিত। বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় আরএস রেকর্ড প্রণয়নের কাজ ১৯৪৫ সালের মধ্যে শেষ হলেও দেশ ভাগের কারণে বৃহত্তর বরিশাল জেলার জরিপ কাজ অসম্পন্ন থেকে যায়। পরবর্তীকালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের আওতায় ১৯৫২ সালে বরিশাল জেলার আরএস জরিপ সম্পন্ন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে বৃহত্তর ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলায় আরএস জরিপ পরিচালনা করা হয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার আরএস জরিপ আজও শেষ হয়নি।

১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকারের আমলে ভূমি সংস্কার অধ্যাদেশের আওতায় দেশের সবকটি জেলায় ভূমি জরিপের জন্য স্থায়ী কাঠামো স্থাপন ও চলমান রেকর্ড হালনাগাদকরণের লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ১০টি জোনাল অফিসের মাধ্যমে জরিপ কার্যক্রম শুরু করা হয়। পাশাপাশি একটি বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা মহানগরী এলাকায় ভূমি জরিপের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। এছাড়া নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী ও সমুদ্র-উপকূলবর্তী অঞ্চলে জেগে উঠা চর বা নতুন ভূখণ্ড জরিপের জন্য ‘দিয়ারা সেটেলমেন্ট অপারেশন ’ নামে পৃথক একটি জরিপ কার্যক্রম চালু রয়েছে।
ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, ভূমি জরিপের প্রচলিত পদ্ধতি একেবারেই সনাতনী এবং অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ। ভূমি সম্পর্কিত অধিকাংশ মামলা-মোকদ্দমার অন্যতম প্রধান কারণ হলো রেকর্ড জটিলতা। সনাতনী পদ্ধতির জরিপের নানা ত্রুটির কারণে একজনের জমি আরেকজনের নামে রেকর্ড হওয়ার ঘটনা হর-হামেশাই ঘটে থাকে। জমির পর্চা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক বিলম্ব জনসাধারণকে সীমাহীন ভোগান্তির মুখে ঠেলে দেয়। এসব কারণে বর্তমান সরকার স্বল্পতম সময়ে ভূমি জরিপের কাজ সম্পন্ন করে নিখুঁত পর্চা প্রকাশের লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে ডিজিটাল জরিপ পদ্ধতি প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে সাভার উপজেলার ৫টি মৌজায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে একটি পাইলট প্রকল্প। সাভারের কলমা, আউকপাড়া, জিঞ্জিরা, আরকান ও খাগান মৌজায় পরীক্ষামূলক ডিজিটাল জরিপ কার্যক্রম শেষ হবে আগামী ৩০ জুন।
এই কর্মকর্তা বলেন, সাভারের পাইলট প্রকল্পটি সফল হলে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে এই পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ কার্যক্রম হাতে নেয়া হবে। সেই ক্ষেত্রে প্রতি ৫ বছর অন্তর নতুন পর্চা ও মৌজা নকশা প্রণয়নের নিয়মিত ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। তিনি জানান, ডিজিটাল জরিপের মাধ্যমে মাত্র ৬ মাসের মধ্যে ভূমির অবস্থান ম্যাপসহ পর্চা প্রকাশ করা সম্ভব হবে এবং এই পদ্ধতিতে জমির দাগের মাপ ৯৫ শতাংশ নিখুঁত হবে। এর ফলে ভূমি সম্পর্কিত মামলা-মোকদ্দমার হার ৮০ শতাংশ কমে যাবে এবং ভূমি বিষয়ক রেকর্ড ও তথ্যাদি আরও নিরাপদভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরও জানান, ২০১৪ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৩ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে ইত্তেফাক প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে ভূমি মন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা বলেন, বর্তমান সরকার তার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ ’শ্লোগানের আলোকে ভূমি জরিপ ও সামগ্রিক ভূমি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে সম্পূর্ণরূপে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই ‘সাভার ডিজিটাল জরিপ’ শীর্ষক পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারাদেশে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।