Thursday, June 11, 2009

আমন মৌসুমে ভাল একটি ধানের জাত চাই

মোঃ রফিকুল ইসলাম, কৃষক ও কৃষক সংগঠক, নাটোর

আমাদের দেশে ধানের মৌসুম বলতে আগে আউশ-আমন মৌসুমকেই বোঝাতো। আমাদের বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটাতে বেরো মৌসুম ধান উৎপাদনে যোগ হয়েছে। আউশ মৌসুমে পরিমাণে খুব কম এবং আমন মৌসুমে বেশি ধান হয়। যুগ যুগ ধরে দেশি ধানই আমাদের খাদ্যের চাহিদা মেটাত। জনসংখ্যা বাড়ার কারণে দেখা দেয় অধিক ফলনশীল ধানের জাত।

আমাদের দেশে সর্বপ্রথম ধান গবেষণা শুরু হয় ১৯১০ সালে ঢাকা সংসদ ভবন এলাকায় যা ঢাকা ফার্ম বা মণিপুরি ফার্ম হিসেবে পরিচিত। তখন থেকে ১৯৬০ সাল পর্যš- অর্ধ শতাব্দীব্যাপী গবেষণায় উদ্ভাবিত হয় ৬০টি স্থানীয় উন্নত ধানের জাত। এটা আমাদের ধান গবেষণার ক্ষেত্রে প্রথম পর্যায়। দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ষাট দশকের মাঝামাঝি থেকে উফশী ধান উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে। ১৯৬০ সালে ফিলিপাইনে আš-র্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরি উষ্ণমণ্ডলীয় জলবায়ু অঞ্চলের জন্য উফশী ধানের প্রবর্তক। বাংলাদেশে ধান আইআর-৮ সংগ্রহ করা হয় এবং উচ্চ ফলন দেখে ১৯৬৭ সালে মাঠ পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য জাতটি অনুমোদন দেয়া হয়। এ খাটো আকৃতির উফশী ধান থেকে বিঘাপ্রতি ১৮-২১ মণ ফলন পাওয়া যায়। প্রচলিত ধানের চেয়ে এর ফলন দেড় থেকে দুইগুণ বেশি। তখন থেকে লোকমুখে ‘ইরি ধান’ এ দেশে পরিচিত লাভ করে। ঢাকা ফার্মের আদি ধান গবেষণা থেকে সময়ের পরিক্রমায় ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) প্রতিষ্ঠিত হয়। গত ৩৭ বছরে ব্রি-র বিজ্ঞানীগণ নিরলস গবেষণা করে মৌসুম ও পরিবেশ উপযোগী একটি হাইব্রিডসহ ৫০টি উফশী ধানের জাত আবিষ্কার করেছেন। বর্তমানে ব্রি উদ্ভাবিত ধানের জাত দেশের মোট ধানি জমির শতকরা ৭৫ ভাগে চাষাবাদ করা হচ্ছে এবং এ থেকে পাওয়া যাচ্ছে মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৮৭ ভাগ। তাই ব্রি-ধান ইরি ধানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। যে ধান গাছের সার গ্রহণ ক্ষমতা অধিক এবং ফলন বেশি তাকেই উফশী ধান বলা হয়। আমন মৌসুমে বি আর-১১ জাত ১৯৮০ সালে চাষের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট আই আর -২০ এবং আই আর-৫-৪৭-২ জাতের মধ্যে শংকরায়ন করে বি আর-১১ উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ ধানের কৌলিক সারির নম্বর করা হয়েছে। এ ধানের কৌলিক সারির নম্বর-৫২, ৮৭-১ এইচ আর ৮৮। এ ধানের জনপ্রিয় নাম মুক্তা।

আমন মৌসুমে এ জাতটি সারা দেশে জনপ্রিয় ছিল। আš-র্জাতিক ফলন প্রতিযোগিতায় এ ধান ভাল ফলন দিয়েছে। মুক্তা ধান স্বল্প আলোক সংবেদনশীল। স্বল্প আলোক সংবেদনশীলতার জন্য এ জাত জ্যৈষ্ঠর ২০-২৫ তারিখে বপন করলে কার্তিকের মাঝামাঝি সময়ে ফসল কাটা যায়। ফলে ওই জমিতে সময় মত গম, ডাল ও তেল ফসল করা যায়। দুই যুগেরও বেশি সময় মুক্তাধান এদেশে মুক্তার মতই উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে ১৯৮৭ সালে ৩৩ শতাংশ এক বিঘা জমি থেকে আমি শুকনা ২৪ মন মুক্তাধান পেয়েছিলাম কিন্তু গত বছর বিঘাপ্রতি হয়েছে ১২ মণ। সময়ের পরিবর্তনে দেশের জনপ্রিয় আমন মৌসুমের সর্বোচ্চ ফলনশীল বি আর-১১ বা মুক্তা ধানের উৎপাদনে এখন ভাটা পড়েছে। অনেক এলাকায় বি আর-১১ ধান লাগালে উৎপাদন খরচই উঠছে না। কিন্তু দুই যুগ এই বি আরÑ১১ ধান আমন মৌসুমে সর্বোচ্চ ফলন দিয়েছে। মুক্তা ধানের এই ফলনের কারণে অনেকে আমন মৌসুমকে বি আর-১১-র মৌসুম বলত। এই ধানে মুড়ি ভাল হয়। ভাত মোটা হলেও খেতে সুস্বাদু। আমন মৌসুমের জন্য যতগুলো জাত আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে মুক্তার ফলন সবচেয়ে বেশি ছিল। আমাদের মধ্যে আর্শীবাদ স্বরূপ এই ধান এসেছিল।

এমন একটি জাত আবিষ্কারের জন্য ধানবিজ্ঞানীদের কৃষকদের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাই। কালের পরিবর্তনে নানা রোগ-বালাই ও ফলন কমে যাওয়ার কারণে বি আর-১১ ধানের স্থান দখল করে নিচ্ছে ইন্ডিয়ান স্বর্ণা, লাল স্বর্ণা, গুটি স্বর্ণা ইত্যাদি। যা রোগ-বালাই সহনশীল নয় ও সরকার কর্তৃক অনুমোদিতও নয়। অনুমোদন বিহীন উক্তজাতগুলোর চাষাবাদ কৃষির জন্য হুমকি স্বরূপ। বি আর-১১ ধানের যে ফলন কৃষকেরা পেয়েছে ওই রকম ফলন এখন কোন জাতের ধানের আর হচ্ছে না। আমন মৌসুমের জাতগুলো কম ফলনশীল হওয়ায় কৃষকদের এখন আমন ধান করে আনুপাতিক হারে লাভবান হতে পারছে না। আমরা জানি, আমাদের ধানবিজ্ঞানীরা অক্লাš- পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ফলনশীল জাতের জন্য। আমাদের যত কষ্টই হোক বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা মেটাতে মুক্তার অনুরূপ ফলনশীল জাতের বিকল্প নেই। যত কষ্টই হোক বা যেভাবেই হোক মুক্তার অনুরূপ জাত আমাদের আবিষ্কার করতেই হবে। তাই বিধাতার কাছে প্রার্থনা করি মুক্তার অনুরূপ জাত আমাদের আরও দরকার।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।