Thursday, June 11, 2009

জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ

ইত্তফোক- ০১.০৫.০৯
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ
প্রফেসর নজরুল ইসলাম, পরিবেশবিদ ও চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের উপর বিরাট প্রভাব পড়তেই পারে। বলা উচিত ইতিমধ্যেই এর প্রভাব পড়তে শুরু হয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন বলতে প্রথমেই বুঝবো জলবায়ুর যে মূল উপাদানগুলো রয়েছে অর্থাৎ তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বায়ুর আর্দ্রতা, এবং বায়ুপ্রবাহের গতিবিধি ও বেগ। এগুলোর পরিবর্তনশীলতা আর পরিবর্তন আমরা পরিমাপ করি একটা দীর্ঘ সময়ে। তবে কমপক্ষে বিশ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে এই উপাদানগুলোর পরিবর্তন হতে পারে। আরও হয়তো সঠিক হবে যদি আরও দীর্ঘ সময়ের পরিবর্তন ধরি। অর্থাৎ চল্লিশ বছর ধরে যদি জলবায়ুর এই পরিবর্তন ধরি। সে হিসেবে যদি আমরা সাম্প্রতিক সময়ের হিসেবটাও দেখি- তাহলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হবে তাপমাত্রার এই পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে উচ্চ তাপমাত্রা যেমন বর্তমান সময়েই আমরা দেখতে পাই ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্যান্য শহরে উচ্চ তাপমাত্রা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কালবৈশাখীর সময় যে বৃষ্টিপাত হয় তা হচ্ছে না বলে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বৈশ্বিক যে জলবায়ু পরিবর্তন তা থেকে সারা বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ছে বলেই মনে করা হচ্ছে। যদি এক ডিগ্রি বা দুই ডিগ্রি বাড়ে তবে বাংলাদেশেও তার মাত্রা বাড়তে থাকবে। বৃষ্টির পরিমাণ ও বৃষ্টির সময় কখনো বৃষ্টি ঠিক সময়ে হবে না, যার ফলে এর প্রভাব বা মূল যে কাঠামো তা কৃষির উপর বিরাট ভূমিকা রাখে।
দুর্যোগ যেমন সাইক্লোন, টর্নেডো ইত্যাদির প্রকোপটাও দিন দিন বাড়ছে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন যে সাইক্লোন বলা চলে তার তীব্রতা বাড়ছে। তাতে করে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রচণ্ড আঘাতে বিধ্বস্ত হচ্ছে ঘর-বাড়ি, নষ্ট হচ্ছে ফসলের ক্ষেত। বন্যাও আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে বেড়ে যায়। আগে যেখানে দশ বছর অন্তর অন্তর বন্যা হতো, তা এখন দুই বছর পর পর হয়ে যায়। এই ভিন্নতা বৈশ্বিক জলবায়ুর জন্যেই হচ্ছে। বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় নদী ভাঙ্গনের বিষয়টি। এতে অসংখ্য পরিবার বাড়ি-ঘর হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষির তো আর পরিবর্তন করা যায় না। যার ফলে কৃষিরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্বাস্থ্য সমস্যারও প্রকোপ বাড়ে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে চারদিকে অসুখ-বিসুখ ছড়িয়ে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে স্থাবর সম্পত্তির ক্ষতি হয়। এ কথাগুলো বলছি এজন্যে যে, ইদানীংকালে শিল্পায়নের কারণে এই পরিবর্তনটা আসছে। শিল্পায়নের কারণে রাষ্ট্রীয় দূষণ হয়। এটি হচ্ছে পরিকল্পনার ও বাস্তবায়নের দুর্বলতার কারণে। নগরায়ন যদি অপরিকল্পিতভাবে দ্রুততার সঙ্গে হয় তাহলে ক্ষতি বেশি হবেই। আমার মতে বৈশ্বিক পরিবর্তনটা স্থানীয় উন্নয়নের কারণেই ঘটছে। উন্নয়নটা যদি পরিকল্পনা মাফিক ও পরিবেশ সমন্বিতভাবে হতো তাহলে এর প্রভাবটা সারা বিশ্বে পড়তো না, তা না হলে যেভাবে অপরিকল্পিতভাবে এবং পরিবেশকে বিনষ্ট করে উন্নয়ন হচ্ছে তাতে জলবায়ুর পরিবর্তনটা তীব্রভাবে অনুভূত হবে- এটাই স্বাভাবিক।


প্রফেসর ড. এম. নজরুল ইসলাম, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এই নদী ভরাট সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য যে প্রযুক্তি ও অর্থের প্রয়োজন তা কি আদৌ বাংলাদেশের রয়েছে? বাংলাদেশে জলবায়ুর অনেক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। দিনদিন গড় তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি শীতকালে তাপমাত্রা দিনদিন কমে যাচ্ছে। সাধারণত মে-জুন মাসে গড় তাপমাত্রা থাকার কথা ৩০-৩৬ সে.গ্রেড, কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ৩৮-৪২৭ পর্যন্ত উঠানামা করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের অনেক নদী-নালা শুকিয়ে যাচ্ছে, ফলে জীববৈচিত্র্য ও কৃষি কাজের সেচের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। অদূর ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে ভূ-গর্ভস্থ পানির অভাব ঘটবে এবং কৃষি কাজে সেচের মারাত্মক সমস্যা দেখা দিবে। কারণ বর্তমানে যেভাবে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে তা যদি ত্বরিত বন্ধ করা না হয় তবে এর বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশের জলবায়ুকে আরো অসহিষ্ণু করে ফেলবে বলেই পরিবেশবিদ ও জলবায়ু বৈজ্ঞানিকদের অভিমত। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের পরিবেশগত বিপর্যয়ের জন্য বাংলাদেশের যতটা না ভূমিকা রয়েছে তার চেয়ে বেশী ভূমিকা রয়েছে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে পানিচুক্তি থাকলেও অনেক সময় তার সুষম বন্টন সম্ভব হচ্ছে না। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিশ্ব উষ্ণায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিপর্যয় রক্ষার জন্য আাঞ্চলিকভাবে তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে না। আমরা পশ্চিমা দেশের দিকে দেখতে পাই সুইডেনে এসিড রেইন হতো, সংগে সংগে পশ্চিমা দেশগুলো এটা মোকাবিলার জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা তৈরী করেছিল সালফার প্রটোকল-১ ও পরবর্তীতে সালফার প্রটোকল-২ নীতিমালা। এই নীতিমালার মাধ্যমে সালফার ডাই অক্সাইড ও কার্বণ মনোঅক্সাইড অপেক্ষাকৃত ধনী রাষ্ট্রগুলো প্রয়োজনীয় মাত্রায় উভয়-দূষক ৩০% এবং পরবর্তীতে ৬০% হারে কমিয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে সালফার প্রটোকলকে ত্বরান্বিত করার জন্য যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে অপেক্ষাকৃত কম অর্থনীতিক উন্নত দেশগুলো যেমন: সুইডেন, পোল্যান্ড এবং স্পেনকে ভর্তুকি দিতে থাকে। বর্তমানে পশ্চিম ইউরোপের এসিডিফিকেশন এন্ড ইউট্রোফিকেশন-এর মাত্রা আগের তুলনায় অনেকাংশে কমে এসেছে। এতকিছুর পরও উন্নত পশ্চিমা দেশগুলো অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, নগরায়ন ও ফিটনেস বিহীন স্থলজ ও সামুদ্রিক পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করে থাকেন। নর্থ-সাউথ কনফ্লিক্টের নামে তারা পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য অনুন্নত ও উন্নয়নকামী দেশগুলোকে ব্যাপকভাবে চাপ দিয়ে আসছে। প্রকৃতপক্ষে শিল্পোন্নত দেশগুলো অতিরিক্ত মাত্রায় শিল্পায়ন ও ভোগের ফলে পরিবেশের উপর ব্যাপক চাপ পড়ছে। ক্লাব অব রোম রিপোর্ট ১৯৭৩ এবং কমন ফিউচার অব আর্থ রিপোর্টে পশ্চিমা দেশগুলোর অতিরিক্ত মাত্রায় উন্নয়ন ও ভোগবাদী সমাজের স্বেচ্ছাচারিতাকে পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য হুমকি হিসাবে দেখানো হলেও পশ্চিমা বিশ্ব বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গঠিত রিওডিও সামিট, কিয়োটো প্রটোকল এবং জোহানেসবার্গ সামিটের মাধ্যমে অনুন্নত ও উন্নয়নকামী দেশগুলোকে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে তাগিদ দেন। তারা মিলেনিয়াম গোল ও এজেন্ডা-২১ ঘোষণা করলেও তার বাস্তবায়নে আমাদের মত উন্নয়নকামী দেশে এর প্রভাব খুব কমই পড়েছে। বিশ্ব জলবায়ু সমস্যা একটি দেশের পক্ষে এককভাবে মোকাবিলা করা খুবই দুরূহ। কারণ দূষক ও দূষণ ট্রান্স বাউন্ডারী সমস্যা। যেমন: ভারতে কোন দূষণ ঘটলে বাংলাদেশের পক্ষে কি তা আটকিয়ে রাখা সম্ভব? তাই আজ সময় এসেছে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব থেকে বরফ ও গ্লেসিয়ার রক্ষা করা। তা না হলে দিন দিন তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং বরফ গলতে থাকবে। ফলে সমুদ্র সমতলের উচ্চতা অনেকগুণ বেড়ে যাবে একথা আর কারো কাছেই অজানা নয়। সুখের কথা হলো দেরীতে হলেও পশ্চিমা দেশগুলো তাদের শিল্প কারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড নিয়ন্ত্রণের জন্য উট- (ঊট-ঊঞঝ)কার্বন মার্কেট তৈরী করেছেন। প্রত্যেকটা শিল্প প্রতিষ্ঠানকে ইমিশনের মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যদি কেউ এর চেয়ে বেশী ইমিট করে তাহলে তাকে অন্য জায়গা থেকে কোটা ক্রয় করে আনতে হবে। আর যদি কম ইমিট করে তাহলে অতিরিক্ত কোটা কার্বন মার্কেটে বিক্রি করতে পারবে। এতসব আশার আলোর মাঝেও পশ্চিমা দেশগুলোর বাংলাদেশসহ অনুন্নত দেশগুলোর পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ে তেমন কোন পরিকল্পনা নেই বললেই চলে। তাই স্বল্প পরিসরে হলেও বাংলাদেশের জলবায়ু ও জলবায়ুগত বিপর্যয় রোধের জন্য বনভূমি রক্ষা থেকে শুরু করে জীববৈচিত্র্য নীতিমালা, জলমহাল নীতিমালা এবং পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনকে জোরদার করা প্রয়োজন। এ জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর সহযোগিতা নিয়ে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভিন্ন এজেন্ডা, প্রটোকল ও পারস্পরিক প্রযুক্তি আদান-প্রদান করা যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের হাত থেকে কৃষিনির্ভর বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সমস্যা সমাধানের জন্য নেগোসিয়েশন টেবিলে বসার বিকল্প নেই।


ওয়ালিউর রহমান, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও রাষ্ট্রদূত
আইপিসিএস ৪ নম্বর রিপোর্টে গত বছর যে কিছু সিদ্ধান্ত এসেছিল তার মধ্যে একটি হলো বাংলাদেশের মতো দেশ সমুদ্র থেকে তাদের উচ্চতা অনেক কম, তারা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সর্বপ্রথম আঘাতপ্রাপ্ত হবে। এছাড়াও বিভিন্ন জলবায়ু সংক্রান্ত বায়ু পরিবর্তনের ফলে সাইক্লোন ও অন্যান্য ধরনের দুর্যোগের সম্মুখীন হবে। সেখানে বেশ কয়েকটি দেশকে তারা চিহ্নিত করেছে। সিডরের আঘাত আমরা গত বছর যে পেলাম সেটা তারই একটি অংশ। ব্লক সুয়ান সিনড্রম-এ যতগুলো আঘাত আসতে পারে তার ভেতরে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং জাপান পর্যন্ত সেটা আঘাতপ্রাপ্ত হবে। এ সমস্ত দুর্যোগের ব্যাপারে কোন রকমের পূর্ব পূর্বাভাস থাকবে না। যেমন- ইপি-থ্রির-মতো ঘটনা, সুনামি, এভিএন্টফ্লো বা অন্য রকমের ফ্লোর আক্রমণ এসবই থাইওয়ান ও চীনের ভিতরে এই সিনড্রমের কারণে পরিলক্ষিত হবে আগামী পঞ্চাশ বছরের ভিতরে।
কুপেন হেগেনে যে মিটিংটা গত পরশু শেষ হলো তাতে করে দেখা যাচ্ছে যে এই শতাব্দির শেষ পর্যন্ত হিমালয় এবং আর্থটিক অঞ্চলে বরফের যে গলন ধরেছে সি-নিকোশনের ফলে তা যদি বন্ধ না করা যায় তাহলে এই শতাব্দির শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের পানি ১ মিটার ওপরে ওঠে যাবে।
এই প্রেক্ষিতে আমাদের চেষ্টা করতে হবে সে সমস্ত দুর্যোগের ব্যাপারে আমরা যেনো প্রস্তুত থাকি এবং এ ব্যাপারে নেদারল্যান্ডের এবং অন্যান্য দেশের কারিগরি সহায়তা নিতে পারি। এছাড়াও আমরা উপকূলে বাঁধগুলোকে আরও সংরক্ষিত করতে পারি এবং সাইক্লোন শেল্টারগুলোকে আরও অনেক বেশি মজবুত করে তুলতে পারি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে সজাগ এবং আশা করি আমাদের নিকটতম দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি রিজন্যাল ফোরামে সবার সুবিধার্থে এবং সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আমাদের দেশকে বাঁচাতে সচেষ্ট হবো।

অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন একটি বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার অবস্থায় বিরাজ করছে। পৃথিবীর বহু বিজ্ঞানী যারা বিশেষ করে আবহাওয়া ও জলবায়ু সংক্রান্ত এবং পরিবেশ সম্পর্কিত বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন, তাদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো কি হতে পারে সেটা নিয়ে একটা চিন্তা-ভাবনা চলছে। আগামী ডিসেম্বরে কুপেন হেগেনে বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের উপর যে সম্মেলনটি হবে সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রভাব ও করণীয় সম্পর্কে বিশদ আলোচনা হবে। বলা হয়ে থাকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিম্ন সমভূমিগুলো যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা কম সেসব অঞ্চলে সমুদ্র পৃথিবীর উচ্চতা বাড়ার কারণে জলমগ্ন হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করে অনেকেই। এবং এর ফলশ্রুতিতে বিশ্বের প্রায় ১০ কোটি লোকের বাস্তুবিচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমি মনে করি জলবায়ু পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিশ্ব সৃষ্টির সময়কাল থেকেই এই পরিবর্তন মাঝে-মাঝেই সংগঠিত হয়ে আসছে। এবং এর কিছু প্রভাব বিশ্বের বাস্তব্য ব্যবস্থাপনায় কখনো কখনো কিছু কিছু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের কিছু খারাপ প্রভাব জনমানুষের উপরে পড়বে বলে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন। এর কারণ হিসেবে তারা বলেছেন যে, গ্রীন হাউস গ্যাস উদ্গীরণের কারণে কার্বন ডাই অক্সাইডের প্রাচুর্য মানব জীবনে একটা দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। গ্রীন হাউস গ্যাস উদ্গীরণের প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রায় ৩ ডিগ্রী বেড়ে যাওয়ার কারণে মেরু অঞ্চলীয় এবং হিমালয় অধ্যুষিত জমানো বরফ গলে বিপর্যয় সৃষ্টি করার সম্ভাবনা রয়েছে এবং বর্তমানে বরফ গলার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। যার ফলশ্রুতিতে জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে পৃথিবীর কিছু কিছু অঞ্চলে এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে কৃষি, জনস্বাস্থ্য এবং ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুগত বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এই অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও এই জলবায়ুগত পরিবর্তনের প্রভাবে বেশকিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। এবং যার কারণে আমি মনে করি যে এ ধরনের পরিবর্তনের প্রভাব ঘটার আগেই বাংলাদেশের ব্যাপারে পূর্ব থেকেই কিছু পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করার চিন্তা-ভাবনা করা উচিত হবে। বিশেষ করে কৃষি, জনস্বাস্থ্য, অবকাঠামোগত দিকগুলো সম্পর্কে কি ধরনের প্রভাব প্রতিক্রিয়া হতে পারে সে সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা উচিত এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা জরুরী বলে মনে করি।
যেমন কৃষিতে পানির প্রবাহ ঠিক রাখা এবং সেচ ব্যবস্থায় এই পানির ব্যবহারের উপযুক্ত কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করা একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। সুপেয় পানির ব্যবস্থা গ্রহণও এই কর্মপদ্ধতির একটি অংশ হওয়া উচিত বলে মনে করি। বৈশ্বির উষ্ণতার কারণে বাংলাদেশে বিভিন্ন জলবায়ুগত রোগ-ব্যাধি বিস্তারের সম্ভাবনা বেশি বলেই অনেকে ধারণা করছেন। ডায়রিয়া, কলেরা, জলবসন্ত এবং বিভিন্ন ধরনের ক্রান্তি অঞ্চলের ফ্লু জনস্বাস্থ্যের অবণতি ঘটতে পারে। এ বিষয়েও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া দরকার পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করার জন্য বাংলাদেশের নদীগুলোকে আরো সচল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং এজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বৃষ্টি এবং নদীর পানি ধরে রাখার জন্য কি ধরনের অবকাঠামোগত ব্যবস্থা নেয়া যায় সে দিকটাও পরিকল্পনাবিদদের চিন্তা করতে হবে। বিশেষ করে পদ্মার ড্যাম তৈরি করা উচিত। বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগণকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করে তোলাও উচিত বলে আমি মনে করি। ঝড়, ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস এবং লবণাক্ততা সম্পর্কিত বিষয়গুলো সম্পর্কে সতর্কতামূলক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা এখনই উচিত বলে মনে করি।
জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবিলায় তখন থেকে সরকারের একটা বিশেষ তহবিল গঠন প্রয়োজন বলে মনে করি এবং উন্নত দেশগুলো যাদের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারায় বিরূপ প্রভাব ফেলেছে তাদের কাছ থেকে এই তহবিলের মোটা অংশ আদায় করা উচিত বলে মনে করি। যদিও জলবায়ু পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। হাজার লক্ষ বছরে এই ধরনের এক একটি পরিবর্তন দেখা যায় বর্তমান বিশ্বের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানে উচ্চতর ব্যবহার এই পরিবর্তনের সঙ্গে সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বিশ্ব মানবের কল্যাণ সংগঠিত হবে বলেই বিশ্বাস রাখি।
বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিরূপ হতে পারে সে সম্পর্কে আরো বিষদ গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।

ড. আমানত উল্লাহ খান, পরিচালক, দুর্যোগ গবেষণা প্রশিক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জলবায়ুর যে সমস্ত প্রজেকশন করা হয়েছে তার উপাত্তের ভিত্তি যথেষ্ট নয় বলে আমার মনে হয়েছে। এর কারণ হলো বায়ুমন্ডলের গভীরতা কয়েক হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে আমাদের উপাত্ত রয়েছে কয়েকশ’ কিলোমিটার। তাও আবার অনেক ছড়ানো-ছিটানো ওয়েদার স্টেশনগুলো থেকে। এই সব উপাত্তে গত ৫০/১০০ বছরের ডাটা নেই। অথচ পৃথিবীর বয়স কোটি বছরেরও বেশি এবং এই কোটি বছরে বায়ুমন্ডলের নানান পরিবর্তনের অভিযোগ রয়েছে। তবুও গত লক্ষ লক্ষ বছরের মধ্যেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে লক্ষ্য করা গেছে। সেজন্যে এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলা সমীচীন হবে না।আমরা প্রায়সই ‘সি’ লেভেলের কথা শুনি। কিন্তু ‘সি’ লেভেলটা কখনো লেভেল নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠে সর্বনিম্ন এবং সর্বোচ্চ লেভেলের মধ্যে প্রায় ১২০ মিটারের ব্যবধান রয়েছে। মালদ্বীপ এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠ সর্বনিম্ন। এবং এর কারণ হলো মালদ্বীপ এলাকার লিথলজিক অবস্থা। এখানে মধ্যাকর্ষণ শক্তি সমুদ্রপৃষ্ঠকে নিচে নামিয়ে রাখছে। সে রকমই হালকা রগ ফরমিশন সমুদ্রপৃষ্ঠকে এতোটা আকর্ষণ করতে পারে না, ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ অনেক জায়গায় উঁচু।
সেজন্যই বাংলাদেশে যে অনেক সময় মানচিত্র এঁকে দেখানো হয় যে, এক তৃতীয়াংশ সমুদ্রপৃষ্ঠে চলে যাবে- এটা বিশ্বাসযোগ্য অনেকাংশে মনে হয় না। যেদিন থেকে তারা একথাগুলো বলে আসছে এতোদিনে এক তৃতীয়াংশ চলে যেতে পারতো। যে হারে বরফগলা শুরু হয়েছে তাতে চলে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু আমরা দেখছি এর উল্টোটা। বাংলাদেশের মধ্যে হাওর এলাকাটা অনেকটা নিচু। বদ্বীপ অঞ্চলগুলো অনেকাংশে উঁচু। তাই সবকিছু নিয়ে গবেষণা করতে হবে। শুধু সেমিনার করলেই তো হবে না, পুরো বিষয়টি গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে, বাংলাদেশেও জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। তবে ঘটছে যে না সেটা কিন্তু আমি বলছি না।
আমার কথা হলো এ বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করা উচিত এবং এটা হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবে। এটা যতটা সাইন্টিফিক থিউরি তার চেয়ে বেশি পলিটিক্যাল থিউরি। পৃথিবীকে যে দু’টি গ্রুপে ভাগ করা হয়েছে, যার কারণেই তো তথ্যানুসন্ধান মার খাচ্ছে। তাই আমার কথা হলো শুধু জলবায়ু পরিবর্তন নয়, এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু যুক্ত রয়েছে। যেমন পরিবেশ। এই পরিবেশের ভারসাম্যের কারণেই বাংলাদেশে এরকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এটাকে শুধু জলবায়ুর জন্য বলা যাবে না। উন্নয়নের নামে কংক্রিটের জংগল বানিয়ে ফেলা হয়েছে। কোন পরিকল্পনা নেই, অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে ইমারতের পর ইমারত। ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।


ড. আইনুন নিশাত
পানি বিশেষজ্ঞ

বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধি বিষয়ে পৃথিবীর সব দেশের মনেই এখন আর কোন সন্দেহ নেই। ২০০৭ সালে এ বিষয়টি পর্যালোচিত হয়েছিল এবং ২০০৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক কর্মসূচিগুলোকে ঢেলে সাজানো হবে। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দর কষাকষি চলছে। বাংলাদেশ এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। এই পরিবর্তনের বিষয়ে চারটি লক্ষ্যে কাজ হচ্ছে। প্রথমত, যে কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে তা কমালে অর্থাৎ কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাস উৎপাদন কমালে। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশের ভূমিকা নগণ্য বলা চলে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যে সমস্ত বিরূপ আবহাওয়ার সম্মুখীন হবো সেগুলোর মোকাবিলা করার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। তৃতীয় হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণ। চতুর্থত হলো, সকল কাজে অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিতকরণ।
আমরা মনে করি বাংলাদেশ এই বিষয়টি মোকাবিলা করার জন্যে তার পরিকল্পনা সাফল্যের সঙ্গে তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে যা ঘটতে পারে তার মধ্যে রয়েছে অসময়ে বৃষ্টি, বৃষ্টির অনিশ্চয়তা, বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙ্গন, সাইক্লোন, টর্নেডো ইত্যাদির প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়া।
বাংলাদেশ ক্লাইমেক্স চেঞ্জ বিষয়ক যে একশন প্লেন তৈরি করেছে তাতে সর্বপ্রথম দৃষ্টি দেয়া হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের বিষয়ে। তার সঙ্গে জোর দেয়া হয়েছে জীবিকার নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য নিরাপত্তা। এরপর জোর দেয়া হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থার উপর। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়েছে। বলা প্রয়োজন যে, এ কাজে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হবে। এছাড়া গবেষণা, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যতে যেকোন প্রকল্প হাতে নিলেই যেন বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়টি যেভাবে বিবেচিত হয় সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ বৈশ্বিক উষ্ণতায় বিপর্যস্ত হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ কেবল অন্যতমই নয় বরং বলা যেতে পারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এজন্যে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে নিজস্ব অর্থ থেকে তিনশত কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করেছে। তবে আমার ধারণা, এ কাজে কয়েক হাজার কোটি টাকার মতো প্রয়োজন হতে পারে। কাজেই অর্থ সংগ্রহের বিষয়ে বাংলাদেশকে সচেষ্ট থাকতে হবে।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : সৌরভ জাহাঙ্গীর

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।