Thursday, June 11, 2009

লাউয়াছড়ায় বিলীন হচ্ছে জীব-বৈচিত্র

নূরুল মোহাইমীন মিল্টন, কমলগঞ্জ সংবাদদাতা : দেশের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ সমৃদ্ধ জীববৈচিত্রময় একমাত্র বন গবেষণা কেন্দ্র সম্বলিত লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক। ন্যাশনাল পার্কসহ কমলগঞ্জের সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলের সবুজ নিসর্গ ক্রমেই ধ্বংস করা হচ্ছে। বিরামহীনভাবে এই নিসর্গ থেকে মূল্যবান প্রজাতির বৃক্ষ নিধনের ফলে বনাঞ্চল এর সাথে সাথে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ন্যাশনাল পার্কে অবস্থানরত জীব বৈচিত্র। পশু-পাখিরা হারিয়ে ফেলছে নির্ঝঞ্জাট জীবন যাপনের পরিবেশ। জঙ্গলের দূর্লভ প্রাণীগুলো জনপদে ছুটে এসে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মারা যাচ্ছে।

সবুজ প্রকৃতি ঘেরা অত্যন্ত সুন্দর পরিচ্ছন্ন লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক দেশ বিদেশের পর্যটকদের কাছে ব্যাপক সমাধিত। লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক ছাড়াও এখানে হাজার হাজার একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল রয়েছে। বর্তমানে মৌলভীবাজার জেলার সংরক্ষিত এই বনের বেহাল অবস্থা। ক্রমাশুয়ে বিপন্ন হচ্ছে বন। নিঃশষ হচ্ছে জীব বৈচিত্র। সংরক্ষিত বনের বিশাল এলাকা থেকে সেগুনকাঠসহ বিরল প্রজাতির মুল্যবান গাছগাছালি চোরাই কাঠ পাচারকারীরা হরদম পাচার করছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল ধ্বংস হতে হতে এখন পুরোপুরি নিঃশষ হওয়ার উপক্রম। বনাঞ্চল ও আশপাশ এলাকার বেকার লোকজন ছাড়াও কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ কাঠ পাচার পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এভাবে কাঠ পাচার হতে হতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের এখন যে অবশিষ্ট বন রয়েছে সেগুলো পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে সব রকম কার্যক্রম চালাচ্ছে কাঠ পাচারকারী ও বন রক্ষক বলে অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।

বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় লোকালয়ে বেরিয়ে আসছে বন্য প্রাণীরা। লোকালয়ে বেরিয়ে আসা এসব বন্য প্রাণী বিভিন্ন সময়ে মারা যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে জঙ্গলের শতাধিক প্রাণীর প্রাণ হারানোর অভিযোগ রয়েছে। এরমধ্যে বিগত ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীমঙ্গল শহরতলীর হবিগঞ্জ রোডের ভৈরবতলী নামক স্থানে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে ৪ ফুট লম্বা ২৬ কেজি ওজনের একটি বাঘ মারা যায়। একই বছরে নভেম্বর মাসে শ্রীমঙ্গল শীতেশ বাবুর ফিসারীতে পাহাড়ারত দুটি কুকুরের কাছে প্রাণ হারায় ৪ ফুট লম্বা ২০ কেজি ওজনের আরেকটি বাঘ। ২০০৫ সালের জানুয়ারী মাসে লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক থেকে বেরিয়ে আসা ১৩ ফুট লম্বা প্রায় ১০০ কেজি ওজনের ১ টি ওজগর সাপ জনপদে চলে আসলে চা শ্রমিকরা দড়ি দিয়ে বেধে সাপটিকে ৪ দিন আটকে রাখে। যার প্রতিবেদন তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ২০০৫ সালের ২৩ জানুয়ারী কমলগঞ্জের খাসিয়াদের হাতে ধরা পড়ে বিরল প্রজাতির একটি ধূমকল, একই বছরের নভেম্বর মাসে লাউয়াছড়ার গভীর জঙ্গল থেকে ৩১ কেজি ওজনের ৩ ফুট লম্বা মেছো বাঘ বেরিয়ে আসলে ২ টি কুকুরের হাতে প্রাণ হারায়। ৭ ই নভেম্বর তারিখে সাড়ে ৩ ফুট লম্বা আরেকটি মেছো বাঘ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসলে লোকজন তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। একই বছরের জানুয়ারী মাসে শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভৈরববাজারের লামুয়া নামক স্থানে গাড়ীর ধাক্কায় মারা যায় ৩ ফুট লম্বা একটি গন্ধগোকুল। এই বছরে ডিসেম্বর মাসে খাদ্যের অভাবে পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা বিরল প্রজাতির ১ টি হনুমান জনতার হাতে ধরা পড়ে। ২১ ডিসেম্বর তারিখে শ্রীমঙ্গল এলাকায় আহত অবস্থায় ধরা পড়ে ১ টি বন মানুষ। ২০০৮ সালের ১৩ এপ্রিল পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা একটি লজ্জাবতী বানর কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছে ধরা পড়ে জনতার হতে। পরে বানরটিকে বন বিভাগের সহায়তায় পৌছে দেয়া হয় শ্রীমঙ্গলের শীতেষ বাবুর চিড়িয়াখানায়। পরিবেশ সংরক্ষণবিদ সীতেশ রঞ্জন দেব জানান, গত এক মাসে কমলগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন এলাকা থেকে আহত অবস্থায় বিরল প্রজাতির একটি মেছো বাঘ, একটি সোনালী বাঘ, একটি গন্ধ গকুল ও একটি ধনেশ পাখি উদ্ধার করে তার পারিবারিক চিড়িয়াখানায় পাঠালে সেখানে সেবা প্রদান করা হয়। পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বিকাল ৪ টায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের জানকিছড়া বনাঞ্চলের ভিতর মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক মফিজুল ইসলাম বিরল প্রজাতির এই ৪ টি প্রাণী অবমুক্ত করেন। সম্প্রতি এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বনাঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসা একটি মায়া হরিণের মৃত্যু হয় শমশেরনগরে। এভাবেই প্রতিনিয়ত জঙ্গল থেকে ছুটে আসা প্রাণীগুলো মানুষের হাতে কখনও বা যানবাহনের নিচে, আবার কখনও অপর কোন প্রাণীর হাতে প্রাণ হারাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় মানুষের হাতে জীবিত ধৃত প্রাণীগুলোকে বন বিভাগ, বিডিআর ও পশুবিদ শীতেশ রঞ্জন দেব অবমুক্ত করে থাকেন। সরকার বিরল প্রজাতির পশু পাখীর আবাসস্থল এই লাউয়াছড়ার জৈব বৈচিত্র রক্ষায় লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্কে সকল প্রকার আহরন নিষিদ্দ করেছে। কিন্তু কিছুতেই তা মানা হচ্ছে না। পার্কের ভেতর দিয়ে রয়েছে বিভিন্ন লেবু, আনারস বাগান ও পান পুঞ্জির রাচ্চা, যার জন্য পশু পাখীর নিচ্চব্ধ পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।

সিলেট বন বিভাগের অধীনে এই বনাঞ্চলে আছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। ১৯২৭ সালের বন আইনের আওতায় ১৯৯৬ সালে গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে প্রতিষ্টা করা হয়েছিল এই জাতীয় উদ্যান। ১২৫০ হেক্টর জমিতে পশ্চিম ভানুগাছের রিজার্ভ ফরেস্টের অংশ বিশেষ নিয়ে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান গঠিত হয়েছে। উদ্যান প্রতিষ্টার এক বছরের মাথায় ১৯৯৭ সালে মার্কিন অক্সিডেন্টাল কোম্পানী পার্শ্ববর্তী মাগুরছড়ায় গ্যাস উত্তোলনকালে অগ্নিকান্ডে ক্ষতবিক্ষত হয় বন, মাটি, মানুষ ও প্রাণীজগতের। পরবর্তী ২০০৮ সালে শেভরনের ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ কার্যক্রমে মাগুরছড়ার নিকটবর্তী লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও আশপাশ এলাকায় মাটিতে ফাটল দেখা দেয় এবং বন্য প্রাণীরা ছোটাছুটি শুরু করে। বনাঞ্চল এলাকায় বেকারত্ব, রাজনৈতিক দলের প্রভাব, কৃষি জমির সম্প্রসারন, বসত বাড়ি স্থাপনা, জ্বালানী হিসাবে কাঠের ব্যাপক ব্যবহার, বন বিভাগের কম জনবল, চোরাই কাঠ পাচারকারীর সাথে অসাধু বনকর্মকর্তা ও পুলিশের যোগসাজস সর্বোপরি অসচেতনতার কারণেই সংরক্ষিত বনাঞ্চলসহ জীব-বৈচিত্রের আশ্রয়স্থল বিলিন হওয়ার কারন বলে স্থানীয় সচেতন মহল ধারনা করছেন। বনাঞ্চল এলাকার স্থানীয় খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন জানান, কমলগঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কাঠ পাচারের ফলে এখানকার বিরল প্রজাতির বৃক্ষ ও প্রাণী সমূহ বিলুপ্ত হওয়ার অপেক্ষায়। মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির হেড মিঃ জিডিসন প্রধান সুচিয়ান বলেন, ‘বিগত বছর শেভরনের কার্যক্রমের সময় এখানে বন্য প্রাণীর তৎপরতা দেখা যায়নি। তাছাড়া বনাঞ্চলের বাঁশে বাঁশে ফুল আসায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এখানকার বাঁশঝাড়। সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলে বহু প্রজাতির জীব-জন্তু বন থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে ও বনে আশ্রয় নেয় এবং বনেই বংশ বিচ্চার করে। কিন্তু বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় বন্য প্রাণীরা ও হুমকীর মুখে রয়েছে।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।