
১৯.০৯.০৮
।।ইত্তেফাক।। রেজাউল করিম খান, রাজশাহী অফিস
নাটোরের একটি গ্রামে প্রায় এক হাজার পুকুর আছে। পুকুরগুলোতে আধুনিক পদ্ধতিতে চলছে মাছ চাষ। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এখন কাজে ব্যস্ত। তাদের সংসারেও এসেছে স্বাচ্ছন্দ্য। গত পাঁচ বছরে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে কয়েকশ’ বেকার মানুষের। কিন্তু সম্প্রতিকালে রাসায়নিক সারের সংকটের কারণে মাছের উৎপাদন কমছে আশংকাজনক হারে। আর এই জন্য হতাশা নেমে এসেছে মৎস্যচাষিদের মধ্যে।
গ্রামের প্রবীণ মৎস্য চাষি আবুল কালাম আজাদ জানান, গ্রামের মাঠে তার এক বিঘা আবাদি জমি ছিল। কিন্তু জলাবদ্ধতার কারণে সারা বছর আবাদ করা সম্ভব হতো না। ১৯৯৭ সালে তৎকালীন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুস সবুর তাকে পুকুর খননের পরামর্শ দেন। তিনি পুকুর খনন করেন এবং তারই সহযোগিতায় স্থানীয় কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। প্রথম বছরেই তিনি এক লাখ টাকার মাছ বিক্রি করে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেন। এরপর থেকে তিনি শুধু এগিয়েই চলেছেন। এখন তার ৩০ বিঘার ওপরে পুকুর আছে। বছরে আয় করেন প্রায় ১৫ লাখ টাকা। মাছ চাষে তার সাফল্য দেখে গ্রামের অনেকেই এগিয়ে আসতে শুরু করে। শুরু হয় পুকুর খনন আর মাছ চাষের বিপ্লব।
পাঁচ বছর পূর্বে আব্দুর রাজ্জাক তার প্রায় ছয় বিঘা জমির উপর দুইটি পুকুর খনন করেন। তখন পুকুরের মাটি কাটা হতো কোদাল-ঝুড়ির সাহায্যে। ঐ সময় তার খরচ হয়েছিল প্রায় ৭০ হাজার টাকা। প্রথমে মাছের পোনা আনা হয় নাটোর হ্যাচারি থেকে। প্রথম দিকে পোনার মান ভাল ছিল। মাছের খাবারের দামও ছিল কম। তার পুকুরে এক বছরে রুই ও কার্প জাতীয় মাছের উৎপাদন হয় বিঘা প্রতি ২০ মণ। পুকুরে তিনি প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার ছাড়াও খৈল, গম ও ধানের ভূষি, চালের কুঁড়া প্রভৃতি ব্যবহার করেন। এক বিঘা পরিমাণ পুকুরে ১৫ কেজি ইউরিয়া, ১০ কেজি টিএসপি ও পাঁচ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করতে হয়। মৎস্য বিভাগ জানায়, গুরুদাসপুর উপজেলায় পুকুরে ব্যবহারের জন্য প্রতি মাসে প্রায় ৮০টন সারের প্রয়োজন। কিন্তু পাওয়া যায় মাত্র ১৬ টন। মৎস্যচাষিরা বাধ্য হয়ে কালোবাজার থেকে দ্বিগুণ দামে সার কিনে পুকুরে ব্যবহার করেন।
গ্রামের ইয়াকুব আলী, আনছার আলী, মোজাম্মেল হকসহ জমির মালিক প্রায় সকলেই পুকুর খনন করেছেন। মৎস্যচাষিরা জানান, বর্তমানে মাছের খাবারের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সারের দাম আরও বেশি। সেই তুলনায় মাছের দাম মিলছে না। উৎপাদিত মাছ পার্শ্ববর্তী তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটি বাজারে বিক্রি করা হয়। এছাড়াও পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, নাটোর প্রভৃতি আড়তে মাছ পাঠানো হয়। মাছ পরিবহনের জন্য ব্যবহার করা হয় শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ভ্যান। স্থানীয় ভাষায় একে ভটভটি বলা হয়। রাস্তায় এর জন্য পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়। স্থানীয় আড়ৎ সমূহে বর্তমানে সিলভার কার্প ৭৫ টাকা ও রুই-কাতল ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রয় হচ্ছে। এই সব মাছ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে।
নাটোরে রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ বিল চলনবিল। এছাড়া রয়েছে ২৭টি ছোট বড় নদ-নদী। এক সময় চলনবিল এলাকার নানা প্রজাতির মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও সারাদেশে পাঠানো হতো। এখন সেই সব মাছ আর নেই। বিল এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, রাস্তা সেতু, কালভার্ট প্রভৃতি নির্মাণ করায় পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া পলি ও বালির স্তর পড়ায় বিল-নদীর নাব্যতা কমেছে আশংকাজনকভাবে। এর ফলে একদিকে সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা, অপরদিকে চাষের জমি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রাকৃতিক নিয়মে মাছের প্রজনন কমে গেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে বাজারে মাছের চাহিদাও বেড়েছে কয়েকগুণ। মৎস্যজীবীরা বিধি নিষেধ সত্ত্বেও ছোট বড় সব ধরনের জাল দিয়ে প্রায় ছেঁকে তুলে নিচ্ছে। ফলে দেশি প্রজাতির অনেক মাছই এখন আর পাওয়া যায় না। মাছের এই অভাব পূরণ করছে ব্যক্তিগত পুকুরের মালিকেরা।
No comments:
Post a Comment