Monday, January 26, 2009

রংপুর-দিনাজপুরের আলুচাষিরা ‘লেটব্লাইট’ তা-বে বিপাকে

ডেসটিনি ।। রংপুর প্রতিনিধি

বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের মাটি আলু চাষের জন্য উৎকৃষ্ট হলেও বৈরী আবহাওয়া, ভেজাল সার এবং মানহীন বালাইনাশকের ছড়াছড়ির কারণে এবার এ অঞ্চলে আলু উৎপাদনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভেজাল ও মানহীন বালাইনাশকের কারণে আলু ক্ষেতে পাতাপচা রোগের আক্রমণ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিনিয়তই হাজার হাজার একর জমির উঠতি আলু ফসল লেটব্লাইট রোগ বা পাতাপচা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শত চেষ্টা করেও এ রোগের কবল থেকে বের হয়ে আসতে পারছেন না এ অঞ্চলের আলুচাষিরা। ছত্রাকনাশক ও বালাইনাশক সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন ¯েপ্র করেও আলু ক্ষেত লেটব্লাইট রোগ থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। এছাড়া বাজারে উল্লেখিত ওষুধগুলোর সংকট সৃষ্টি করে ব্যবসায়ীরা কৃষকদের জিম্মি করে রাখছে। ফলে তারা ন্যায্যমূল্য দিয়েও চাহিদামতো ওষুধ কিনতে পারছেন না। শনিবার সন্ধ্যায় বালাইনাশক মজুদারির বিরুদ্ধে শহরের মাহিগঞ্জে আলুচাষি সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে। জানা গেছে, চাষিরা আলুক্ষেত রক্ষায় হন্যে হয়ে বালাইনাশক খুঁজছেন। যদিও বা দু-একটি দোকানে বালাইনাশক পাওয়া যায়, তা বাজার মূল্যের চেয়ে অধিক দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা দিয়েছে বায়ার কোম্পানির সিকিউর জাতীয় বালাইনাশকের। আলু আবাদ করে লগ্নিকৃত অর্থ খোয়ানোর আশংকায় শংকিত হয়ে পড়েছেন বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের চাষিরা। ফলে কাক্সিক্ষত ফলন অর্ধেকে নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। এ বছর ঘন কুয়াশা, আর শীত এবং মানহীন বালাইনাশকের খপ্পরে পড়ে বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের আলুচাষিরা দিশেহারা। নামি-দামি কোম্পানির ছত্রাকনাশক ওষুধ ব্যবহার করেও আলু ক্ষেত পচন রোগ থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না। ভুক্তভোগী চাষিরা এবার বালাইনাশক ওষুধের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। প্রতি কেজি বালাইনাশকের প্যাকেটে যে পরিমাণ গুণাগুণ থাকার কথা, সে পরিমাণ আছে কি না তা নিয়েও চাষিরা আশংকা প্রকাশ করছেন। তাছাড়া সরকারের কৃষি বিভাগ থেকেও এসব বালাইনাশকের গুণগত মান পরীক্ষা-নিরীক্ষার তেমন কোনো তদারকি না থাকায় প্রতিনিয়তই মানহীন কোম্পানির হরেক রকমের ছত্রাকনাশক ওষুধ অবাধে বাজারে ঢুকছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় কৃষি বিভাগের তেমন কোনো জোর নজরদারি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বলে ভুক্তভোগী আলুচাষিদের অভিযোগ। বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের একাধিক কৃষক অভিযোগ করেন, তারা সরকারের কৃষি বিভাগ থেকে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষি উপ-সহকারীদের কাছে তেমন কোনো পরামর্শ বা সহযোগিতা পাচ্ছেন না। কোন বালাইনাশক কি পরিমাণ ও কতটুকু জমিতে প্রয়োগ করতে হবে তা কৃষকরা নির্ভর করছেন বালাইনাশক বিক্রেতার পরামর্শের ওপর। এর ফলেও তারা প্রতারিত হচ্ছেনÑ তারা প্রতিনিয়তই বাজারে বালাইনাশক ওষুধের সরবরাহ কম বলে ছত্রাকনাশক ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন বলেও আলু চাষিদের অভিযোগ। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা কৃষি সংশ্লিষ্ট উপকরণের মাননিয়ন্ত্রণ ও অধিক মূল্যের বিষয়টিও জোর নজরদারিতে দেখছেন না বলে কয়েকজন আলু চাষি আক্ষেপ করে বলেন। এ ব্যাপারে রংপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আলহাজ্ব দেলবর হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমরা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের যথাসাধ্য পরামর্শ ও সহযোগিতা প্রদানের চেষ্টা করছি। প্রমাণ সাপেক্ষে মানহীন ওষুধের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর যদি বালাইনাশক বিক্রেতারা ছত্রাকনাশক ওষুধ বেশি দামে বিক্রি করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে মাঠ পর্যায় ঘুরে দেখা গেছে উল্টো চিত্র।
রংপুর সদরের বুড়িরহাট গোয়ালুর আলু চাষি তাজিদুল ইসলাম লাল ও দুলাল চন্দ্র রায় দুঃখ করে বলেন, ‘ভাই অনেক শখ করি ১০ একর জমিত আলু নাগাছু। মাইসের কাছে টাকা হাওলাত করি। কায় জানে লেটব্লাইড মোর এমন সর্বনাশ করবে। টাকা প্যাচত নিয়া দোকানত ঘুরি ঘুরিয়াও সিকুর পানু না। তাও যদি আছে দাম মেলা টাকা চায়। এলা মুই কি করিম আল্লায় জানে মোর খরচ ওঠে না ওঠে।’
পীরগাছা উপজেলার কল্যাণী ইউনিয়নের এলাকার আদর্শ আলু চাষি বুলবুল ও মাহাবুব আক্ষেপ করে বলেন, ‘ভাই মুই হামার ইউনিয়নের কৃষি উপ-সহকারীক দ্যাখোং নাই, হামাক তেমন কোন সহযোগিতাও করে না। যদি কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে আসিয়া হামার আলু ক্ষ্যাত দ্যাখিয়া পরামর্শ দেইল হয় তাহলে কিছুটা হলেও হামার আলু ক্ষ্যাত রক্ষা হইল হয়।’ পীরগাছা উপজেলার কল্যাণী ইউনিয়নের আদর্শ আলুচাষি আহমেদ আক্ষেপ করে বলেন, ‘ভাই মুই এবার শ্যাস, সারা বছরের জমানো টাকা দিয়া মুই এবার ছয় দোন জমিত আলু লাগাইছিনু, কিন্তু ক্ষ্যাত আর আটকাইবার পারছোং না। মানহীন বালাইনাশক মোক এবার পথে বসাইছে। আলু ক্ষ্যাতের যে জীর্ণশীর্ণ অবস্থা তাতে মোর বাঁচন নাই। মোর এলাকায় কোনদিনও সরকারের কৃষি বিভাগের লোকজন মোর দুঃখ-দুর্দশা দেইখবার আসিল নারে ভাই। ভাইরে মোর এবার উঠতি আলু ক্ষেত পাতাপচা রোগে খায়া ফ্যালাওছে, মুই কিভাবে দেনা শোধ করিম।’
কৃষকদের এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞ মহল কৃষি বিভাগের মাঠ পর্যায়ে জোর নজরদারি, কৃষকদের বিভিন্ন ফসল উৎপদানের যথাযথ পরামর্শ প্রদান, বাজারে বালাইনাশক ওষুধের মাননিয়ন্ত্রণ করা এবং ভেজাল সার যাতে বাজারে প্রবেশ করতে না পারে তর জন্য সরকারের কৃষি বিভাগের আশু সুদৃষ্টি আকর্ষণ করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছেন। নইলে বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের সম্ভাবনাময় অর্থকারী ফসল আলু চাষের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যাবে। অতিরিক্ত কৃষি স¤প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা গেছে, এবার বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে প্রায় ১ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে। কৃষি অফিস সূত্র মতে, গড়ে প্রতি হেক্টরে ১৭ মেট্রিক টন করে আলু উৎপাদন হলে ৩০ লাখ ৭ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিরূপ আবহাওয়ায় অধিকাংশ আলুক্ষেত লেটব্লাইট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আলু উৎপাদন কম হওয়ার আশংকা করছেন কৃষক ও কৃষিবিদরা। এদিকে রংপুরে কিটনাশক ও বালাইনাশকের কৃত্রিম সংকটের প্রতিবাদে শনিবার সন্ধ্যায় শহরের মাহিগঞ্জ পাইকারী কাঁচাবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন রংপুর আলুচাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন চৌধুরী।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor