Friday, January 30, 2009

এবার ইরি-বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা

৩১.০১.০৯
যায়যায়দিন ।। মোর্শেদ আলী

এবার ইরি-বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কৃষিতে বিশেষ করে সার ও ডিজেলে যে প্রক্রিয়ায় বর্তমানে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে এ প্রক্রিয়ায় খোদ কৃষক খুব সামান্য উপকৃত হয়। আসলে লাভ হয় ডিলারদের। এ মধ্যস্বত্বভোগীদের তোয়াজ কি এ মুহূর্তে খুব প্রয়োজন ছিল? বরং পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন ছিল। আসলে কৃষককে যদি ভর্তুকি দিতে হয় সেটা সার, বীজ, সেচের মাধ্যমে দেয়া বাঞ্ছনীয়। আর সেটা করতে হলে বিএডিসিকে পূর্ব অবস্থানে নিতে হবে প্রথম।
===========================================
এবার যখন ইরি-বোরোর জন্য জমি তৈরি করার কাজ শুরু হয় ঠিক সে সময় জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকার ব্যস্ত ছিল। প্রয়োজনীয় নজরদারি ঠিকমতো হয়নি। নতুন সরকার আসার পর দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে ঠিক। কিন্তু ইতিমধ্যে চাষের ও ধান লাগানোর কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কৃষক জমি তৈরি করতে যেসব নন-ইউরিয়া সার ব্যবহার করে অর্থাৎ টিএসপি, ডিএপি, এমওপি জাতীয় সারের দাম অতিরিক্ত থাকায় সেসব অতি প্রয়োজনীয় সার কৃষক ব্যবহার করতে পারেনি। কিছু ব্যবহার করলেও পরিমাণমতো দিতে পারেনি। কারণ অতি উচ্চ মূল্য ছাড়াও যে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হয় তা হলো কৃষকের হাতে টাকা নেই। প্রয়োজনীয় কৃষিঋণ কৃষক পাচ্ছে না।
অথচ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আমাদের এ বোরো ফসলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অতি জরুরি। কারণ এখন আমাদের মতো দেশ চাইলেই চাল-গম কিনতে পারে না। বিশ্বে এখন খাদ্যশস্যের নানাবিধ ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যশস্যের দাম যেমন বেড়েছে তার সঙ্গে আগের মতো সহজপ্রাপ্য নয়। অর্থাৎ টাকা দিলেই বা থাকলেই বিদেশ থেকে খাদ্য সহজে কিনতে পাওয়া যায় না। কারণ আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বে বায়োফুয়েল তৈরির জন্য প্রচুর পরিমাণ শস্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্ন উঠেছে, কিন্তু ফয়সালা হয়নি। এসব বিষয় লক্ষ্য রেখে সরকার যাতে পদক্ষেপ নেয় তা জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রথমত আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে পড়ে যাওয়ায় সারসহ অনেক ব্যবহার্য জিনিসের দাম কমে গেছে। সেই সুযোগ গ্রহণ করে আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে।
এ বিষয়ে সরকারি পদক্ষেপের কিছু ত্রুটি লক্ষণীয়। আন্তর্জাতিক বাজারে যে হারে সারের দাম কমেছে সরকার ভর্তুকি দিয়ে তারচেয়ে বেশি দাম ঘোষণা করেছে। ডিজেলের ক্ষেত্রেও তাই। তাছাড়া ইউরিয়া সারের দাম যা ছিল তাই রেখেছে। অথচ এ সময়ই ইউরিয়া প্রয়োজন। বিগত সরকার ইউরিয়ার দাম দ্বিগুণ করে ১২ টাকা করে দেয়। এখনো তাই রাখা হয়েছে। অথচ ইউরিয়া উৎপাদন খরচ কেজি প্রতি ৭ টাকার বেশি নয়। সরকারের এ পদক্ষেপে কৃষক খুব লাভবান হবে না। কয়দিন আগে কৃষিমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, একসঙ্গে দাম না কমিয়ে ধাপে ধাপে কমানো আমাদের জন্য ভালো। কিন্তু সময়ের একটি বিষয় আছে। কৃষককে এখনই সহযোগিতা করা দরকার। কয়দিন পর দাম কমালে ইরি-বোরোর জন্য কোনো উপকার হবে না। ফলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন। অন্তত ইউরিয়া সারের দাম পূর্ব অবস্থায় নিয়ে গেলে সরকারের খুব ক্ষতি হবে না। আর যদি ফসলের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না করা যায়, তাহলে সরকার আরো ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। উল্লেখ্য, সরকার এবার ১ কোটি ৮০ লাখ ম্যাট্রিক টন ইরি-বোরোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে যা বিগত বছরের চেয়ে ১.৪০% বেশি।
অপর প্রসঙ্গ হচ্ছে কৃষিতে বিশেষ করে সার ও ডিজেলে যে প্রক্রিয়ায় বর্তমানে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে এ প্রক্রিয়ায় খোদ কৃষক খুব সামান্য উপকৃত হয়। আসলে লাভ হয় ডিলারদের। এ মধ্যস্বত্বভোগীদের তোয়াজ কি এ মুহূর্তে খুব প্রয়োজন ছিল? বরং পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন ছিল। আসলে কৃষককে যদি ভর্তুকি দিতে হয় সেটা সার, বীজ, সেচের মাধ্যমে দেয়া বাঞ্ছনীয়। আর সেটা করতে হলে বিএডিসিকে পূর্ব অবস্থানে নিতে হবে প্রথম। তারপর এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সব উপকরণ কিনে কৃষকদের দ্বারে ভর্তুকি মূল্যে বিতরণের ব্যবস্থা করলেই সত্যিকার উপকার হবে। তবে ব্যক্তিমালিকানায়ও সারের ব্যবসা থাকবে। শুধু ব্যক্তি মালিকদের ওপর নির্ভর করাটা সরকারের জন্য বোকামি হবে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও বিএডিসির মাধ্যমে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে সেচে যে রমরমা ব্যবসা ডিপ-টিউবওয়েলের মালিকরা গ্রামে ফেঁদে বসেছে তার হাত থেকে কৃষক মুক্তি পাবে না। এরই সঙ্গে কিছু পরামর্শ উত্থাপন করা হলোÑ
১. সার, বীজ, ঋণ প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও উপকরণসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সময়মতো সেসবের আমদানি নিশ্চিত করা এবং সারাদেশে উৎপাদক কৃষকের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ ও সহজলভ্য করতে হবে। ভর্তুকি প্রদান করে কম দামে এসব উপকরণ কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
২. খোদ কৃষক যাতে কৃষিপণ্যের উৎসাহমূলক ও ন্যায্য মূল্য পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে পণ্য পরিবহন, বাজারজাতকরণ, দেশব্যাপী পাইকারি ও খুচরা মূল্য সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহের উন্নত ব্যবস্থা করতে হবে। মূল্য সমর্থন দিয়ে লাভজনক দামে উৎপাদক কৃষকের কাজ থেকে সরকারিভাবে কৃষিপণ্য কেনার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. খুচরা মূল্যের ৭৫% যেন খোদ কৃষক পায় তার নিশ্চয়তার জন্য উপযুক্ত আইন ও তদারকি সরকারকে করতে হবে। এজন্য বাজার ব্যবস্থায় ব্যক্তি খাতের পাশাপাশি কৃষকদের বাজার সমবায় এবং বিএডিসিসহ রাষ্ট্রীয় সংস্থায় বহুমুখী কার্যক্রম প্রসারিত করতে হবে।
৪. গ্রামীণ অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক উৎপাদন ও সেবামূলক কার্যক্রম চালু করতে হবে। একই সঙ্গে গ্রামীণ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রসারে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে।
৫. কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে ভূমি ব্যবহার নীতি প্রণয়ন করতে হবে। খোদ কৃষক যাতে জমি না হারায় তার নিশ্চয়তা বিধান করে গ্রামাঞ্চলে নিঃসকরণ প্রক্রিয়া বন্ধ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. জলমহাল ও ভাসান পানিতে প্রকৃত জেলেদের মাছ ধরার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
৭. গবাদিপশু পালন কার্যক্রম কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সমবায়ভিত্তিক খামার প্রতিষ্ঠায় সরকারি উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে। গবাদি পশু-পাখির রোগবালাই বিশেষত বার্ড ফ্লু, ম্যাডকাউ ডিজিজ ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ ও বীমা সুবিধা প্রবর্তন করতে হবে।
৮. গ্রামে অবিলম্বে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে সহজশর্তে ঋণদান পদ্ধতি চালু ও তদারকির ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. সর্বোপরি অবিলম্বে শস্য বীমার ব্যাপক প্রচলন শুরু করতে হবে।
অবশেষে বলতে চাই, সরকার তার ভালো কথা বা সরকারি নির্দেশ দিলেই হবে না। তা কার্যকর হচ্ছে কি-না তার তদারকির ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। তাছাড়া গ্রামে কৃষকদের জন্য কার্ডের ব্যবস্থা করলে বিতরণ ব্যবস্থা উন্নত করা যাবে।
মোর্শেদ আলী: রাজনীতিক ও কলাম লেখক।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor