Thursday, January 29, 2009

রবি ফসল রক্ষায় কৃষি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

২৯.০১.০৯
যায়যায়দিন ।। গোকুল চন্দ্র বিশ্বাস বাকৃবি
টানা ঘন কুয়াশা, তাপমাত্রা কমে যাওয়া এবং সূর্যালোকের স্বল্পতার কারণে দেশে রবি ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। বিরূপ আবহাওয়ার কারণে দেশের প্রায় ৭০ ভাগ জমির আলু গাছ ইতিমধ্যে রোগাক্রান্ত হয়েছে। এছাড়া রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে টমাটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, শিম, লাউ, মুলা, বেগুনসহ কমপক্ষে দশ ধরনের শীতকালীন সবজি। কৃষি বিজ্ঞানীদের মতে এ বিরূপ আবহাওয়া দীর্ঘস্থায়ী হলে গম ও ভুট্টা চিটা হয়ে যেতে পারে এবং বোরো ধানেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এ মুহূর্তে রিডোমিল গোল্ড ছত্রাক নাশক ব্যবহার না করে অ্যাক্রোব্যাট ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আলুর লেটব্লাইট বা পাতা মড়ক রোগ নিয়ে উপমহাদেশের প্রথম ও একমাত্র প্লান্ট ডিজিজ ক্লিনিক বা উদ্ভিদ হাসপাতালের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্লান্ট প্যাথলজি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. এম. বাহাদুর মিঞা জানান, ১৮৪৫ সালে আয়ারল্যান্ডে আলুর লেটব্লাইট বা পাতা মড়ক রোগের কারণে সেখানে আইরিশ ফ্যামিন বা দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। যার কারণে সে দেশের অজস্র মানুষ না খেয়ে মারা গিয়েছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় আলু ক্ষেতে লেটব্লাইট বা পাতা মড়ক রোগ দেখা দিয়েছে যা অত্যন্ত ক্ষতির কারণ হতে পারে। সরেজমিন বিভিন্ন জেলায় মাঠ পরিদর্শন করে দেখা গেছে এবার দেশের প্রায় ৭০ ভাগ জমির আলু গাছ লেটব্লাইট রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ১৯৯২ সাল থেকে বাংলাদেশের মানুষ এ রোগের বিপরীতে রিডোমিল গোল্ড ব্যবহার করে আসছে। কিন্তু এ ছত্রাকনাশকের প্রতি লেটব্লাইট বা পাতা মড়ক রোগের জন্য দায়ী অণুজীব সহনশীল হয়ে গেছে। তাই রিডোমিল গোল্ড ছত্রাকনাশক ব্যবহার না করে অ্যাক্রোব্যাট ব্যবহার করতে হবে।
ড. বাহাদুর জানান, আলুর ‘লেটব্লাইট’ রোগের জন্য বিরূপ আবহাওয়াই অনেকটা দায়ী। এ ছাড়া টমাটো গাছও ব্লাইট রোগে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। শিম ও লাউ গাছের ফুল পচে যাওয়ার কারণে উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে এবং বাজারে শিম ও লাউয়ের সরবরাহ অনেক কমে গেছে। বেগুন গাছের ফুল ঝরে যাচ্ছে। এছাড়া ফুলকপি, বাঁধাকপি এবং মুলা গাছে পচন রোগ দেখা দিয়েছে। এ বিরূপ আবহাওয়া ২০-২৫ দিন স্থায়ী হলে গম ও ভুট্টায় চিটা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং বোরো ধানের ফলনেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ড. বাহাদুর আরো বলেন, শীতকালে শীত ও কুয়াশা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। সাধারণত জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এবং কুয়াশা কম থাকে। গত দুই-তিন বছর ধরে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকেও তাপমাত্রা কম থাকছে এবং টানা ঘন কুয়াশা থাকছে। রবি ফসল উৎপাদনের জন্য এরূপ আবহাওয়া একটি বড় ধরনের বাধা। টানা ঘন কুয়াশার কারণে পাতা ও কা- ভেজা থাকায় ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকজনিত বিভিন্ন রোগে রবিশস্য আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া পোকার আক্রমণও বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকরা বাকৃবির প্লান্ট ডিজিস ডায়াগনস্টিক ক্লিনিকে ফোন করে এসব সমস্যার প্রতিকার জানতে চাচ্ছেন। সারাদেশের রবি ফসলের বর্তমান অবস্থা উদ্বেগজনক।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (সরেজমিন উইং) কৃষিবিদ অনিল চন্দ্র সরকার জানান, ‘বিরূপ আবহাওয়ার কারণে এবারে রবি শস্যে তুলনামূলকভাবে বেশি রোগ বালাইয়ের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। আলু গাছ ‘লেটব্লাইট’ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। তবে যেসব চাষী আগাম আলু চাষ করেছেন তাদের জমিতে এ রোগের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে কম হয়েছে। এসব আলু খাবার হিসাবে ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হলেও পরবর্তী সময়ে বীজ হিসেবে ব্যবহার করতে নিষেধ করা হচ্ছে। অন্যদিকে দেরিতে চাষ করা আলু গাছ এবার তুলনামূলকভাবে রোগাক্রান্ত হয়েছে বেশি। সুখের কথা হচ্ছে, দেশের অধিকাংশ কৃষকই আগাম আলু চাষ করছেন।
ফসল উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. এম.এ. হালিম খান জানান, ‘টানা ঘন কুয়াশা এবং সূর্যালোক না থাকায় ফসলের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাতা ভেজা থাকায় এর যে ‘স্ট্রোমা’ ছিদ্র আছে তা বন্ধ থাকছে। এ ছিদ্র দ্বারা উদ্ভিদ ‘ফটোসিনথেসিস’ প্রক্রিয়ার জন্য কার্বনডাইঅক্সাইড গ্যাস গ্রহণ করে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস গ্রহণ করতে না পারায় এবং সূর্যালোক না থাকায় উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ হচ্ছে না। সালোকসংশ্লেষণ না হওয়ায় গাছ কার্বোহাইড্রেট তৈরি করতে পারছে না বিধায় গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অস্বাভাবিক আবহাওয়া আরো কয়েকদিন স্থায়ী হলে দেশের রবি শস্যের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে’।
বাকৃবির প্লান্ট প্যাথলজি (উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব) বিভাগের অধ্যাপক ড. বাহাদুর মিঞা, মুশফিকুর রহমান খান ও আলী হোসেন এবং উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম রাব্বানী জানান, বর্তমানে যেভাবে আলু গাছ মারা যাচ্ছে তাতে এর কোনো প্রতিকার সম্ভব নয়। কারণ এ মড়কে রিডোমিল গোল্ড একমাত্র প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জনসহ নানাবিধ কারণে রিডোমিল গোল্ড ব্যবহার করে এ বছর কোনো কাজে আসছে না। তবে অ্যাক্রোব্যাট ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যাচ্ছে। ২০ গ্রাম অ্যাক্রোব্যাট ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতক জমিতে ¯েপ্র করলে সুফল পাওয়া যাবে। তারা আরো বলেন, পরবর্তী বছরে জমিতে এ রোগকে প্রতিহত করতে চাইলে আলু ও টমাটো বাদে ওই জমিতে অন্যান্য রবি ফসল লাগাতে হবে।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor