Thursday, September 11, 2008

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা

১২.০৯.০৮
।। ডেসটিনি।। জেনারেল মইন উ আহমেদ এনডিসি, পিএসসি

সাহসী মানুষের এ দেশ, সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ বারবার সবকিছু নিংড়ে নিয়ে আমাদের জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে উপনীত করে। তারপরও আমাদের সাহসী মানুষগুলো প্রায় শূন্য হাতেই জীবনযুদ্ধে নেমে পড়ে। কারও দিকে তাকিয়ে থাকে না, কেউ পাশে থাকল কি না চেয়ে দেখে না। এ যুদ্ধই তাদের জীবন। এ যুদ্ধে সে অবশ্যম্ভাবীভাবে জয়ী হয়। এ জয়ী মানুষগুলোই আমাদের প্রেরণা। এ প্রেরণা থেকেই ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সাঁইত্রিশ বছরের পথচলায় আমরা কখনো গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছি, কখনো আশার আলোতে উদ্ভাসিত হয়েছি। কিন্তু আমাদের পথচলা থেমে থাকেনি। এবারও থেমে থাকবে না। এ বছর শেষেই অনুষ্ঠিত হবে প্রতিশ্রুত নির্বাচন। আশাবাদী মানুষের মতো আমারও আশা নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সৎ ও নতুন নেতৃত্ব দেশকে প্রত্যাশিত পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নতুন স্বপ্নে, নতুন বাস্তবতায়, নতুন চিন্তা-চেতনায় ও নতুন স্পন্দনে এ দেশ ঘুরে দাঁড়াবে। বিশ্ববাসীর কাছে নতুন করে পরিচিত হবে নতুন এক বাংলাদেশ। কিন্তু আপাদমস্তক সমস্যায় জর্জরিত এদেশের এমন কিছু সমস্যা আছে যা নিয়ে এখনই কাজ না করে যদি অপেক্ষা করে থাকি তাহলে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব। তেমনি একটি বিষয় হলো খাদ্য নিরাপত্তা। পনের কোটি মানুষের দেশে পনের কোটি মুখ। এ মুখে খাবার তুলে দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সীমিত সামর্থ্য নিয়ে সরকারের পক্ষে একা এ দায়িত্ব পালন করা কতটুকু সম্ভব? প্রতিদিন খাবারের মুখ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আনুপাতিক হারে আবাদযোগ্য জমি কমছে। বাড়তি মুখের এ খাবার যোগাতে সরকারকে তার সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে দিতে হচ্ছে। কিন্তু পুরো পৃথিবীর খাদ্য নিরাপত্তাই যেখানে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, সেখানে আমাদের মতো দরিদ্র দেশের সীমিত সামর্থ্য এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কতটুকু সমর্থ হবে? এর উত্তর আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের খাদ্য-নিরাপত্তা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের যে-পরিমাণ খাদ্যশস্য দরকার তা যদি আমরা উৎপাদন করতে না পারি তাহলে খাদ্য ঘাটিতে হবেই। এ ঘাটতি পূরণে আমাদের আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু এ নির্ভরতা কখনো কখনো আমাদের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
যেমনটি হয়েছিল ২০০৭ সালে, যখন সারাবিশ্বে আমাদের প্রধান খাদ্য চালের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গিয়েছিল। নিজেদের খাদ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্বের প্রধান প্রধান চাল উৎপাদনকারী দেশ চাল রফতানি বন্ধ করে দিয়েছিল। আমাদের সৌভাগ্য যে, বিশাল জনসংখ্যা নিয়েও কোনো বড় রকমের বিপর্যয় ছাড়াই আমরা এ বিপদ কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। কিন্তু তাই বলে ভবিষ্যতের জন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। এ বিষয়টি নিয়ে এখনই আমাদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। চাষাবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়াতে হবে, জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, উচ্চফলনশীল বীজ ও আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্রয়োগ করে ফলন বাড়াতে হবে। সর্বোপরি জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে এনে দেশের ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধি
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময় দেশের জনসংখ্যা ছিল সাড়ে সাত কোটি। আর আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৯৯ লাখ হেক্টর। বর্তমানে এ জনসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে পনের কোটিতে আর জমির পরিমাণ কমে হয়েছে ৬৬ লাখ হেক্টর। ছত্রিশ বছরে জনসংখ্যা হয়েছে দ্বিগুণ; আর আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে এক-তৃতীয়াংশ। বিভিন্ন কারণে আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে। অনেক জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, অনেক জমিতে ঘর উঠেছে, কল-কারখানা বসেছে, পেট্রলপাম্প, সিএনজি স্টেশন এমনকি মোবাইল টাওয়ার বসাতেও নষ্ট হয়ে গেছে অনেক জমি। অধিক মুনাফার লোভে আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে গ্রামের সড়ক। একই জমি বংশানুক্রমে খ--বিখ-িত হয়েছে, নতুন আইল পড়েছে। শুধু আইলের কারণে সারাদেশে কি পরিমাণ জমি নষ্ট হচ্ছে! সিঙ্গাপুরের মতো দেশ যেখানে অন্যদেশ থেকে মাটি এনে সমুদ্র ভরাট করে জমির পরিমাণ বাড়িয়েছে সেখানে আমরা অযতœ আর অবহেলায় নষ্ট করছি মূল্যবান এ সম্পদ। অথচ যথাযথ পরিকল্পনা ও একটু সহনশীল হলেই এ জমিটুকু বাঁচানো যেত। একটি মোবাইল টাওয়ারে সবগুলো ‘মোবাইল অপারেটর’ স্থান করে নিলে বেঁচে যেত অনেক জমি। কমিউনিটি পদ্ধতিতে চাষ করলে বাঁচানো যেত আইলের জমি। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে আইলের জমিটুকু কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আমি চট্টগ্রামে ‘আইল চাষ’ পদ্ধতিতে শিমের ব্যাপক চাষ হতে দেখেছি। সারাদেশে যদি এ ‘আইল চাষ’ ছড়িয়ে দেয়া যায় তাহলে বেঁচে যেত সবজি লাগানোর জমি, সেখানে চাষ করা যেত অন্য কোন শস্য। বিন্দু বিন্দু পানি জমেই তো সৃষ্টি হয়েছে মহাসাগর। আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র মনে হলেও এমন অসংখ্য ক্ষুদ্রের সমষ্টিই আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করবে। আবাদি জমি বাঁচাতে অবশ্যই আমাদের কমিউনিটি লিভিং-এ অভ্যস্ত হতে হবে।
এ মুহূর্তে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং নির্মাণ সম্ভব না হলেও গ্রামের বাড়িতে দেশীয় প্রযুক্তির দোতলা মাটির ঘর তৈরি করে বাঁচানো যেতে পারে অনেক জমি। গাজীপুর ও মধুপুরে এমন বাড়ি আমি অনেক দেখেছি। তারপরও হয়তো সময় এসেছে, আবাদি জমি বাঁচাতে আমাদের আইন করতে হবে, কেউ ইচ্ছে করলেই যাতে আর আবাদি জমিতে ঘরবাড়ি কিংবা কলকারখানা নির্মাণ করতে না পারে। এভাবে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্যই প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা কাজে লাগাতে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে ‘গ্রিন হাউজ ইফেক্ট’ এর মতো আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরেও অনেক কারণ আছে যার প্রভাব আমাদের ঝুঁকিপূর্ণ এক ভবিষ্যতের মুখোমুখি করছে। উন্নত বিশ্ব এর জন্য দায়ী হলেও এর দুর্ভোগ পুরোটাই আমাদের ভোগ করতে হবে। আইসল্যান্ডের প্রেসিডেন্টের মুখে শুনেছি, গ্রিন হাউজ ইফেক্টের জন্য তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে গ্রিনল্যান্ডের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৭ মিটার বৃদ্ধি পাবে। তেমন দুর্যোগে বাংলাদেশের কতভাগ ডুবে যাবে বলার চেয়ে কত ভাগ জেগে থাকবে তাই গবেষণা করা উত্তম।
জমির বহুবিধ ব্যবহার
আমাদের ছোট্ট এ দেশে আবাদি জমি সীমিত। এর প্রতিটি ইঞ্চির যথার্থ ব্যবহারও এ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য যথেষ্ট নয়। এ জমির সবটুকু ক্ষমতা নিংড়ে বের করার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি সিলেট অঞ্চলে দেখেছি সেখানে একমাত্র আমন ধান ছাড়া অন্য কোনো ধান চাষ করা হয় না। জিজ্ঞেস করে উত্তর পেয়েছি, তাদের পূর্বপুরুষরা করেনি তারাও চাষ করে না। পূর্বপুরুষদের প্রয়োজন ছিল না তাই তারা করেনি, আমাদের প্রয়োজন তাই আমাদের করতে হবে। একফসলি জমিকে দুই-তিন ফসলিতে রূপান্তর করতে হবে। প্রয়োজনে শস্য বিন্যাস পরিবর্তন করতে হবে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে শস্য-বিন্যাস পরিবর্তন করে একফসলি জমিকে দুই-তিন ফসলি জমিতে রূপান্তরের মাধ্যমে ফরিদপুর জেলায় মাত্র এক বছরেই অতিরিক্ত বারো হাজার হেক্টর এবং সিলেট জেলায় অতিরিক্ত তেতাল্লিশ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে। ফরিদপুর জেলায় পাটের সঙ্গে রোপা আমন চাষ করে অতিরিক্ত পঞ্চাশ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপাদন করা হয়েছে। অভিনব এ পদ্ধতিতে পাট কাটার দুই-তিন সপ্তাহ আগে কৃষকরা পাট থাকা অবস্থায়ই আমন ধান বপন করে। পরে তারা পাট কেটে নিলে জমিতে আমন ধান থেকে যায়। এক্ষেত্রে কেটে নেয়া পাটের মূল যা জমিতে থাকে তা সারের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। এভাবে জেলায় প্রায় ৭৬ ভাগ জমি দুই-তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করা হয়েছে। আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলেও দেশের ৬৪টি জেলাইতেই এ পরিবর্তন করা সম্ভব। সীমিত সম্পদের এ দেশে এছাড়া আর উপায় কী?
উচ্চ ফলনশীল বীজের প্রচলন
অধিক ফলনের জন্য একদিকে যেমন প্রকৃতির ওপর নির্ভর করতে হয় অন্যদিকে তেমনি প্রয়োজন ভালো বীজ, কীটনাশক ও সুষ্ঠু সার ব্যবস্থাপনা। ‘হাইব্রিড’ ধানের অনেক বেশি ফলন হলেও এর বীজ যেমন দু®প্রাপ্য ও ব্যয়বহুল তেমনি উচ্চমূল্যের সার, কীটনাশক আর আদর্শ আবহওয়ার সঙ্গে এর সমন্বয় থাকতে হয়। তা না হলে ফলন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় এবং কৃষকরা প্রভূত ক্ষতির সম্মুখীন হয়। হাইব্রিডের বদলে দেশীয় পদ্ধতিতে উৎপাদিত, সুলভ ও উচ্চফলনশীন উফশি (উন্নত ফলনশীল) ধান চাষের ব্যাপক প্রচলন করা গেলে একদিকে যেমন উৎপাদন বৃদ্ধি পারে অন্যদিকে তেমনি কৃষকরা বীজের জন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভর না করে নিজেরাই বীজ সংরক্ষণ করতে পারবে। ভালো ও উন্নত জাতের বীজ তৈরির জন্য খুব বড় ডিগ্রিধারী বিজ্ঞানীর প্রয়োজন পড়ে না। ‘হরিধান’ এর উদ্ভাবক ঝিনাইদহ জেলার হরিপদ কাপালি খুব সাধারণ মানুষ। শীতকালে গায়ে দেয়ার জন্য তাঁর কম্বল ছিল না। তাঁর তেমন কোন পুঁজিও ছিল না। তারপরও একাগ্রতা ও আন্তরিকতা দিয়ে হরিধান উদ্ভাবন করে তিনি প্রমাণ করেছেনÑ আমরাও পারি। কৃষি কাজে এখনো আমরা সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের পদ্ধতি অনুসরণ করি। এ পদ্ধতিতে একদিকে যেমন বেশি পরিশ্রম করতে হয় অন্যদিকে তেমনি ফলনও কম হয়। সাধারণ অবস্থায় একর প্রতি যেখানে ২.৫ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করা যায় সেখানে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে ১০-১২ টন খাদ্যশস্য উৎপন্ন করা সম্ভব। এরকম সবক্ষেত্রেই আমাদের আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি প্রয়োগ করে এর সুফলকে ঘরে তুলতে হবে।
কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতা
কাঠফাটা রোদ আর বৃষ্টিতে ভিজে যে কৃষক দেশের অন্নের জোগান দেয়, চাষাবাদের উপকরণ পেতে তাকে প্রতিটি মুহূর্ত সংগ্রাম করতে হয়। দাদনের চড়া সুদে ঋণ, জীবন বাজি রেখে সার সংগ্রহ আর ধান বিক্রিতে ফড়িয়ার চালাকিÑ এ সবকিছুরই নির্মম বলি অসহায় কৃষক। কী দুর্ভাগা দেশ আমাদের! যে মাটির জন্য এতকিছু, অল্প কিছু মুনাফার আশায় সারে ভেজাল মিশিয়ে সে মাটির উর্বরতা নষ্ট করতে আমরা কুণ্ঠাবোধ করি না। এদিকে কৃষকই আবার নিবিড় পরিচর্যায় এ মাটিকে উর্বর করে তোলে, আমাদের অন্নের জোগান দেয়। এ কৃষককে যেমন করেই হোক বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এ কৃষকই আমাদের দেশের প্রাণ। কৃষির উপকরণ সুলভ ও সহজলভ্য করতে সব রকমের ব্যবস্থা নিতে হবে। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সেনাবাহিনী প্রতিটি উপজেলায় সার পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল, যার ফলে গত বছর কোনো সার সংকট হয়নি। দেশে দাদনের প্রচলন সেই অনেক আগে থেকেই। যারা দাদন দেয় তাদের চুক্তি থাকে একশ টাকায় প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে সুদ দিতে হবে এবং ফসল যা হবে তা তাদের কাছে বিক্রি করতে হবে। অসহায় কৃষককে শোষণ করার কি নির্মম ব্যবস্থা! কৃষকদের এ অসহায়ত্ব আমাকে স্পর্শ করেছে। যার কারণে আমি সেনাবাহিনীকে দিয়ে ওই ফসলগুলো দ্বিগুণ দামে বিক্রি করে তাদের ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করেছি। ঋণ প্রদানকারী সংস্থা থেকে শতকরা ৪ টাকা হিসেবে ঋণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আমি জানি, এ ব্যবস্থা সাময়িক। আমাদের জনপ্রতিনিধিদেরই এর স্থায়ী সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের প্রয়োজনেই আমাদের কৃষকদের বাঁচাতে হবে। কৃষক বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে।
কৃষি ব্যবস্থা উন্নয়নে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দায়বদ্ধতা
সারাদেশে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদফতরের কাঠামো তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। জেলা ও উপজেলার কৃষি অফিসার ও কর্মচারীরা রয়েছে, নেই শুধু জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া শুধু ব্যক্তিগত উদ্যোগ একটি দেশের কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু আমদের দেশের কৃষি উন্নয়ন বিভাগ এ ক্ষেত্রে তেমন একটা কার্যকর অবদান রাখতে সক্ষম হয়নি। আমি জানি, এ বিভাগে অনেক পরিশ্রমী, সৎ ও নিবেদিত কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছে। তাদের এ ভালো কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। ভালো পোস্টিং, প্রমোশন, বিদেশে প্রশিক্ষণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে এ পরিশ্রমী মানুষগুলোকে তুলে আনতে হবে। আর তাহলেই অন্যরাও ভালো কাজ করার উৎসাহ খুঁজে পাবে। জেলা প্রশাসনের ডিসি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদেরও এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে।
খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন
খাদ্য নিরাপত্তার জন্য খাদ্যাভ্যাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সহজে উৎপাদিত খাদ্যই একটি দেশের খাদ্যাভ্যাস নির্ধারণ করে। আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল খাদ্যশস্যটিই আমাদের প্রধান খাদ্য। আর এ কারণেই আমাদের যখন খাদ্য-ঘাটতি দেখা দেয় তখন আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কারণ আমাদের সীমিত সম্পদ আন্তর্জাতিক বাজার থেকে খাদ্যশস্য সংগ্রহ করার জন্য যথেষ্ট নয়। এমনিতেই আমাদের বাজেটের প্রায় ৬০ ভাগ অর্থ নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিস আমদানিতে ব্যয় হয়। এর অতিরিক্ত যে-কোনো ব্যয় সামগ্রিক বাজেটের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করে। এজন্যই আমাদের সব প্রচেষ্টা উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য। শুধু চাল আর গমের ক্ষেত্রেই আমাদের বার্ষিক খাধ্যশস্যের চাহিদা ২.৬ কোটি মেট্রিক টন। এ বছরের বোরোর বাম্পার ফলনে আমরা উৎপাদন করেছি ২.৫৯ কোটি মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। সে হিসাবে আমাদের ঘাটতি ১ লাখ মেট্রিক টন মাত্র।
কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এ দেশে গাণিতিক এ হিসাব প্রায়ই মিলানো যায় না। গত বছরে ‘সিডর’ এর তা-বে একরাতেই নষ্ট হয়েছে ১৮ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য। যার কারণে বিশাল এক জনগোষ্ঠী সব সময় খাদ্য-নিরাপত্তা ঝুঁকিতে আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। এজন্যই আমাদের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের বিষয়টি গভীরভাবে ভাবতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রচার মাধ্যমগুলোকে গভীর প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময় জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস। কারণ বোরো ধান বাজারে আসে এপ্রিল মাসের শেষ ভাগে এবং তা অব্যাহত থাকে জুন মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। যার কারণে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বাজারে চালের সরবরাহ কমে যায়। আলুর ফলন ঘরে আসে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত। এ সময় বাজারে প্রচুর আলু থাকে এবং উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে এর বড় একটা অংশ নষ্ট হয়ে যায়। আমরা যদি বছরের এ সময়টিতে আলুর ব্যবহার বাড়িয়ে দেই তাহলে একদিকে যেমন কৃষক বাঁচবে অন্যদিকে তেমনি চালের ওপর চাপ কমবে। এজন্যই গত বছর আলুর বাম্পার ফলনের পর আমার সেøাগান ছিলÑ ‘আলু খান, কৃষক বাঁচান’। হল্যান্ডের মতো একটি উন্নত দেশের প্রধান খাদ্য যদি আলু হতে পারে তবে আমরা কেন বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় ভাতের সঙ্গে আলু খাওয়া বাড়াতে পারব না। এজন্যই আমি বলেছি ‘ভাতের সাথে আলু প্রতিদিন’। ওই সময়ে আমি সেনাবাহিনীতে সৈনিকদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় আলুর পরিমাণ বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেও আলু খাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য সবরকম চেষ্টাই করে। আমি ভেবেছি আমাদের খাদ্যাভ্যাসে ছোট্ট এ পরিবর্তনে শুধু কৃষক বাঁচবে না আমাদের দেশও বাঁচবে। আফ্রিকার অনেক মানুষ ‘কাসাভা’ নামক এক প্রকার আলু থেকে আটা, রুটি ইত্যাদি তৈরি করার পদ্ধতি শিখে নিয়েছে। বাঁচার প্রয়োজনেই তারা তা করেছে। বাঁচার প্রয়োজনে আমরাও সেটা করতে পারি। শুধু গোল আলু কেন, মিষ্টি আলুসহ অন্যান্য বিকল্প খাদ্যের সন্ধানও আমাদের এখন থেকেই করা উচিত।
মৎস্য চাষ : নদীমাতৃক এ দেশে মৎস্য চাষ একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। অল্প উদ্যোগেই এ শিল্পকে একটি রফতানিমুখী শিল্পে পরিণত করে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তোলা যায়। আইসল্যান্ড ছিল ইউরোপের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি। তারা শুধু পানি সম্পদকে ব্যবহার করেই প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে, তারা যদি পারে আমরাও পারব। আমাদের নদ-নদীগুলো সারাদেশে জালের মতো বিছিয়ে আছে। এ নদীগুলোকে সম্পদে পরিণত করতে হবে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চাঁদপুরের ঘোড়ামারা এলাকায় নদীতে ভাসমান খাঁচা দিয়ে মৎস্য চাষ করে প্রভূত সফলতা অর্জন করা গেছে। মৎস্য বিভাগের মি. বাকী এ প্রকল্প বাস্তবায়নে কারিগরি সহায়তা করেছেন। তাঁর মতো যারাই নিজের কাজের পরিধির বাইরে এসে দেশের জন্য কাজ করতে চান তাঁদের উৎসাহ দিতে হবে। তাঁদের কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশ বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি মৎস্য উৎপাদন করে একদিকে যেমন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখবে অন্যদিকে তেমনি রফতানি বাড়িয়ে আমাদের অর্থনীতিকে সচল রাখতে ভূমিকা রাখবে।
ভোজ্যতেলের বিকল্প সন্ধানে
বাংলাদেশ শুধু ভোজ্যতেল আমদানি খাতে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে। এদেশে ভোজ্য তেলের চাহিদা ও উৎপাদনে বিশাল ঘাটতি রয়েছে। কৃষি বিভাগের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৪,৫০,০০০ হেক্টর জমিতে ৩,৫০,০০০ টন তেল বীজ উৎপাদিত হয়, যা থেকে আনুমানিক ১,৪৫,০০০ টন ভোজ্যতেল নিষ্কশিত হয়। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতে বার্ষিক ৬ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণে আমদানি খাতে প্রতি বছর ব্যয় হয় ৪০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের এই ঘাটতি মিটাতে পাম চাষ এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ রাখতে পারে বলে আমার বিশ্বাস। অন্যান্য উদ্ভিজ তেলের মতো কোলেস্টরেলমুক্ত এই তেল পুষ্টি বিচারে ভিটামিন এ এবং ই এর ঘাটতি পূরণে অবদান রাখতে পারে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষের পাশাপাশি বসতবাড়ির আঙ্গিনায় একটি বা দুটি পাম গাছ পরিবারের ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটাতে সহায়ক হবে।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
খাদ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টিও আমাদের গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। যে কোনো কারণেই হোক জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি এখন আর অগ্রগণ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয় না। জনগণকে সচেতন করতে আগে যেমন প্রচার-প্রচারণা চালানো হতো এখন আর তেমন একটা দেখা যায় না। অথচ জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে খাদ্য-নিরাপত্তার কোনো পদ্ধতিই কাজে আসবে না। বর্তমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বজায় থাকলে ২০৩৭ সালে দেশের জনসংখ্যা হবে ২১ কোটি। এ বাড়তি ৬ কোটি মানুষের খাবার কোথা থেকে আসবে? তাদের বাসস্থান কোথায় হবে? বাড়তি এ জনসংখ্যাকে জায়গা করে দিতেই প্রতি বছর শতকরা একভাগ করে আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে। যে কোনো বিচারেই এ তথ্য খুবই আশঙ্কাজনক। চীন ‘এক সন্তান’ নীতি অনুসরণ করে জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। অথচ আমরা ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ নীতি নিয়েও সফল হতে পারিনি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এ ব্যর্থতা আমাদের অস্তিত্বকে হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ অবস্থা মেনে নেয়া যায় না। যেমন করেই হোক এক্ষেত্রে আমাদের সফল হতে হবে। শুধু আইন করে এর নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সবাইকে এক সঙ্গে এক লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে।
সাহসী মানুষের কথা বলে আমি এ লেখাটি শুরু করেছিলাম। সেই সাহসী মানুষদের কাছে আবেদন রেখেই আমি এর উপসংহার টানতে চাই। অনেক সম্ভাবনাময় এ দেশ। অজস্র সাহসী সূর্য সন্তানের অত্মত্যাগে রচিত হয়েছে এ দেশের গৌরবময় ইতিহাস। মানবসৃষ্ট কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ অসীম ধৈর্য আর সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করে এ মানুষেরাই দেশকে আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে শেখায়। গত বছর খাদ্য-সংকটের আশঙ্কায় যখন বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় মানুষ হিংসাত্মক প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছে তখন আমাদের মানুষগুলো আশ্চর্য এক সহনশীল মনোভাব নিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলা করেছে। এ কারণেই আমি এ মানুষদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি। আমি সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করি, এ সাহসী মানুষেরাই এ দেশকে স্বপ্নময় এক পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সে পথের সন্ধানে আমাদের প্রচেষ্টার মূল চাবিকাঠি তাদেরই হাতে। আমরা যাই করি না কেন, এ সাহসী মানুষদেরই এগিয়ে এসে উপযুক্ত নেতৃত্ব নির্বাচিত করতে হবে, যে-নেতৃত্ব আমাদের খাদ্য নিরাপত্তাসহ সব নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, যাদের হাত ধরে দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে। দেশের আপামর জনসাধারণের মতো আমিও অপেক্ষায় আছি সে সোনালি দিনের।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor