Thursday, September 4, 2008

ধ্বংসমুখী পাট শিল্পকে পুনরুদ্ধারের আশ্বাস সময়োপযোগী

০৩.০৯.০৮
।। ইত্তেফাক ।। আলী ইদ্রিস

একটা মাটির পুতুলও গড়া বেশ কঠিন কিন্তু ভেঙ্গে ফেলা এক মুহূর্তের ব্যাপার। তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের আমল থেকে সোনালী আঁশকে নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্ম হয়েছে, আঞ্চলিক অর্থনীতির চাকা কোথাও বেগবান হয়েছে, কোথাও থমকে দাঁড়িয়েছে। সোনালী আঁশ দ্বারা অর্জিত বিপুল বৈদেশিক মুদ্রার বৈষম্যমূলক ভাগাভাগি থেকে শাসকগোষ্ঠি চরম শিক্ষা লাভ করেছে। তারপরও সোনালী আঁশকে যথাযথ মূল্য দেয়া হচ্ছে না। গত ২৬ আগষ্ট মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা খুলনা বৈঠকে আশ্বাস দিয়েছেন যে বন্ধ করে দেয়া পাটকলগুলো খুলে দেয়া হতে পারে। যে পদ্ধতিতে চট্টগ্রামে কিছু পাটকল বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় লিজ দেয়া হয়েছে, সেই একই পদ্ধতিতে খুলনার বন্ধ করে দেয়া পাটকলগুলো ভাড়া দেয়া হবে। দেরীতে হলেও মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার এ আশ্বাস পাট শিল্পকে পুনরুদ্ধার করে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে সাহায্য করবে।

২০০২ সালের ১ জুলাই তৎকালীন জোট সরকার পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পাটকল আদমজীকে বন্ধ করে পাট শিল্পের মড়ক ডেকে এনেছিল। এরপর বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারও কয়েকটি পাটকল বন্ধ করে দেয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ৭২টি পাটকল চালু ছিল, তখন ভারতে ছিল মাত্র ১৭টি। বর্তমানে বাংলাদেশে ৩০টি আর ভারতে সম্ভবত ৯২টি পাটকল চালু রয়েছে। এই বিপরীতমুখী অবস্থা সৃষ্টির পিছনে বাংলাদেশের ভুলনীতি অনুসৃত কর্মকাণ্ডই দায়ী এবং ভুলনীতি প্রয়োগের পশ্চাতে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র যে কাজ করছে না, গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায় না। কারণ বর্তমান বিশ্বে পাটজাত দ্রব্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র লোকসানের অজুহাতে পাটকলগুলো বন্ধ করে দেয়া আর নামান্তরে মাথা-ব্যথা সারাতে মাথা কেটে ফেলার শামিল। আদমজী জুট মিলের লোকসানের পিছনে ব্যবস্থাপকদের যে দুর্নীতি ও অদক্ষতা কাজ করছিল তার প্রতিকার না করে মিলটা একেবারে বন্ধ করে দেয়া যুক্তিযুক্ত হয়েছে বলে মনে হয় না। আদমজী বন্ধ করার পূর্বে পাট মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি মাত্র ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে মিলটি ভালভাবে চালানো সম্ভব বলে মত দিয়েছিল কিন্তু তৎকালীন সরকার সম্ভবত বিশ্বব্যাংকের চাপে সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট আমলে না নিয়ে ১৫০০ কোটি টাকা চূড়ান্ত পাওনা খাতে ব্যয় করে মিলটি বন্ধ করে দেয়। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাতের হিসাব মতে আদমজী জুট মিলের বর্তমান বাজার মূল্য ১০,৯৫০ কোটি টাকা হলেও তৎকালীন সরকার গঠিত কমিটি এর মূল্য ধরে ১,০৩৮ কোটি টাকা (প্রঃ আলো, ২৬-৮-০৮)। বন্ধ হবার পর মিলের কিছু যন্ত্রপাতি ২নং ইউনিটে এবং কিছু যন্ত্রপাতি রাজশাহী জুট মিলের ২নং ইউনিটে স্থানান্তরিত হয়। বি,জে,এম,সি’র সিদ্ধান্তে রাজশাহী জুট মিলের ২নং ইউনিট চালু করার জন্য ৪ কোটি ৯ লাখ টাকার একটি প্রকল্পও হাতে নেয়া হয় কিন্তু-২০০৬ সালে আংশিক (৩৬ ভাগ) কাজ সম্পন্ন করার পর প্রকল্প আর এগোয়নি। বর্তমানে একটি টিনসেডের নীচে যন্ত্রপাতিগুলো পড়ে আছে। এগুলো নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে চুরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অধিক। এসব যন্ত্রপাতির মূল্য কোটি কোটি টাকা (ইত্তেফাক ২৮/৮/০৮)

বেসরকারীকরণ অথবা ভাড়ায় দেয়া নিজে ব্যবসা করা সরকারের কাজ নয়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে দেয়া হয় বেসরকারী মালিকানায়। সরকারের কাজ বেসরকারী সেক্টরকে ব্যবসা করতে সাহায্য ও সমন্বয় করা এবং সেখান থেকে শুল্ক কর, ভ্যাট ইত্যাদি যথাযথভাবে আহরণ করে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা। স্বাধীনতা উত্তরকালে পাটকল, চিনিকল, ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য ব্যবসাকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছিল একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে, তখন বেসরকারী উদ্যোক্তা বলতে, বাঙ্গালী খুবই কম ছিল। পাকিস্তানী শোষকগোষ্ঠী নিজেরাই অধিকাংশ শিল্প-ব্যবসার মালিক ছিল এবং তাদের পরিত্যক্ত শিল্প-ব্যবসাকে চলমান রাখার জন্য রাষ্ট্রীয়করণের প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে বাঙ্গালী উদ্যোক্তা কিংবা বিদেশী বিনিয়োগকারীর অভাব নেই। সুতরাং এখনও ঐ সমস্ত শিল্প-ব্যবসাকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রেখে পূজ্ঞিভূত লোকসান বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই। এজন্য অনতিবিলম্বে লোকসানে জর্জরিত পাট, চিনি, কাগজ, বস্ত্র, কলগুলোকে প্রতিযোগিতামূলক দামে বেসরকারী উদ্যোক্তাদের হাতে বিক্রি কর দেয়া উচিত এবং বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে দেশের উন্নয়নমূলক কাজ, অবকাঠামো নির্মাণ বা নতুন শিল্প স্থাপন করে দেশের শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করা উচিত। চট্টগ্রামে কিছু কিছু রাষ্ট্রায়ত্ব শিল্প ভাড়ায় বা লিজে বেসরকারী উদোক্তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। এ উদ্যোগটিও প্রশংসনীয়, কারণ জনসাধারণের করের অর্থ জনসেবা বা উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় না করে লোকসানে জর্জরিত শিল্প কারখানার শ্রমিকের বেতন বা কার্যকরী মূলধন যোগানো যুক্তিসঙ্গত কর্ম নয়। লিজ বা ভাড়ায় দেয়া ঐ সব কারখানায় অন্তত লোকসানের পরিবর্তে কিছু রাজস্ব আয় হবে যা সরকার দেশের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করতে পারবে। তবে তালাবদ্ধ পাটকলগুলোর যন্ত্রপাতিতে মরিচা ধরার আগেই সেগুলো বেসরকারীকরণ বা ভাড়ায় (লিজে) দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

পাট ও পাটজাত দ্রব্যের রপ্তানি বাজার খুবই সম্ভাবনাময়

সোনালী আঁশ এক সময় দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী রপ্তানিদ্রব্য ছিল। অদূর ভবিষ্যতে ও তা আবার বৃহৎ অর্থকরী দ্রব্যে পরিণত হতে পারে। পরিবেশ বান্ধব প্রাকৃতিক আঁশ বলে চটের ব্যাগ খাদ্য-দ্রব্য, ভোজ্যদানা, ঔষুধ ইত্যাদি প্যাকিং, সংরক্ষণ, পরিবহন ও গুদামজাত করার জন্য পৃথিবীব্যাপী সমাদর লাভ করতে যাচ্ছে। কার্পেটের ব্যাকিং, গাড়ীর যন্ত্রাংশ ও গদি তৈরীতে চটের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। চটের তৈরী কাপড়, জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ, থলে, বাসকেট, গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার্য বহুভিদ দ্রব্য, সুভেনির ইত্যাদির দেশে-বিদেশে দিন দিন চাহিদা বাড়ছে। এ সমস্ত রপ্তানিযোগ্য দ্রব্যকে নিয়ে বহু কুঠির শিল্প গড়ে উঠেছে এবং উঠবে। পাটের কার্পেট দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে, বহু কার্পেট মিল কার্পেট রপ্তানি করে মুনাফা করছে। কার্পেটের ডিজাইনে আশানুরূপ উন্নতি হলেও কার্পেটের তন্তুতে পশম বা এক্রেলিকের মিশ্রন ঘটিয়ে আরও উন্নত মানের কার্পেট তৈরীর প্রচেষ্টা নেয়া হয়নি বা প্রচেষ্টা সফল হয়নি। এ ব্যপারে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক বরাদ্দের প্রয়োজন আছে। পাটের সঙ্গ পশম বা এক্রেলিক মিশ্রিত কার্পেটের চাহিদা অনেক বেশী এবং তা রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যেতে পারে।

সংস্কার, বিপণন ও প্রচার

পাটজাত দ্রব্যের বিশ্ববাজার এক সময় তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের দখলে থাকলেও বর্তমানে সে বাজার ভারতের দখলে চলে গেছে। বাংলাদেশে একের পর এক পাটকলগুলি বন্ধ হচ্ছে আর ভারতে উত্তরোত্তর পাটকলের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ পাটের উৎপাদন ভূমি বাংলাদেশ। এদেশে উৎপাদিত কাঁচা পাট পাচার হয়ে ভারতের পাটকলগুলোর কাঁচামাল যোগাচ্ছে। এ অবস্থা মেনে নেয়া কষ্টকর। একটা গৌরবময় শিল্পকে তিলে তিলে নিঃশ্চিহ্ন হতে দেয়া যায় না। এজন্য প্রতিটি বন্ধ মিলকে বেসরকারী মালিকানায় অথবা লিজে ছেড়ে দিতে হবে। বি,জে,এম,সি এ পর্যন্ত কোন সাফল্যের প্রমাণ দিতে পারেনি। এই কর্পোরেশনটিকে ঢেলে সাজিয়ে এর জবাবদিহীতা বাড়াতে হবে। তবে প্রশ্ন থেকে যায় বেসরকারীকরণে বা লিজে দেয়ার পর এ কর্পোরেশনের অস্তিত্ব থাকার প্রয়োজন আছে কিনা, সেটা বিবেচনা করবে বেসরকারী পাটকল মালিক ও ভাড়াটেগণ। তাদের চাহিদা ও পরামর্শ অনুসারে বি,জে,এম,সি কাজ করে যেতে পারে অথবা বিলুপ্ত হতে পারে এবং আরএমজি সেক্টরের মতো তাদের ও একটি এসোসিয়েশন গঠিত হতে পারে। যাই করা হোক না কেন প্রধান অগ্রাধিকার এখন বন্ধ করে দেয়া (আদমজিসহ) পাটকলগুলোর যন্ত্রপাতি অকেজো বা চুরি হয়ে যাওয়ার পূর্বেই সেগুলোকে বেসরকারী উদ্যোক্তাদের মালিকানায় বা ভাড়ায় ছেড়ে দেয়া। এর পরই আসে বিশ্ববাজারে বিপণন ও প্রচারের প্রয়োজনীয়তা। বর্তমানে বেসরকারী মালিকানায় চলমান পাটকলগুলোর তথ্য নিলেই বুঝা যাবে সেগুলো কত সাফল্যের সাথে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিপণন ও প্রচার কার্যক্রম অনুসরণ করে নতুন উদ্যোক্তাদের এগিয়ে যেতে হবে।

[লেখক: চার্টার্ড একাউন্টেন্ট ও কথাসাহিত্যিক ]

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor