Friday, September 5, 2008

উত্তরাঞ্চলের কৃষিতে ভুট্টার আগ্রাসন

অনুসন্ধান
05.09.08
।। সমকাল ।। পরিমল মজুমদার ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি

সেচ ও রবি মৌসুম শুরু হতে এখনো অনেক দেরি, কিন্তু ভুট্টা চাষের জন্য আগাম লিজ হয়ে গেছে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার চরাঞ্চলের প্রায় ৮৫ হাজার হেক্টর ধানি ও প্রচলিত চাষাবাদের জমি। বিভিল্পু জেলার কৃষি দফতর থেকে জমির এই পরিমাণ জানা গেছে। দেশি-বিদেশি এনজিও ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীরা পুঁজি ল¹িু করায় শুধু বৃহত্তর রংপুর অর্থাৎ রংপুর, নীলফামারী, গাইবাল্পব্দা, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলায় আগাম লিজ হয়েছে ২২ হাজার হেক্টর জমি। বীজ, সার, সেচ ও নগদ টাকা সহায়তা পাওয়ার লোভনীয় হাতছানিতে কৃষকরা বিনিয়োগকারীদের হাতে অনায়াসে তুলে দিচ্ছে ধানসহ প্রচলিত চাষাবাদের জমি।
উত্তরাঞ্চলের নতুন প্রবণতা ধান ও প্রচলিত ফসলের পরিবর্তে ভুট্টা চাষ। তবে এটা শুধু ফসলের পরিবর্তন নয়, কৃষিতে এক গভীর রূপাšøরের সহৃচনা, যার পরিণতিতে জমির উর্বরতা বিন®দ্ব, জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে কৃষকের নিঃস্ট^ হয়ে পড়া এবং কৃষি পুঁজি ল¹িুকারী ব্যবসায়ীদের করায়ত্ত হয়ে যাওয়ার আশগ্ধকা রয়েছে। আপাতদৃ®িদ্বতে চরাঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এই কৃষিতে চাষীরা সাময়িক লাভবান হলেও কৃষিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশবাদীরা জানাচ্ছেন, চিরায়ত ও প্রচলিত প™ব্দতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষকরা যেভাবে জমির উপরিভাগ রক্ষা করে চরাঞ্চলে আবাসন তৈরি করত, এখন অপ্রচলিত ও নিবিড় চাষাবাদের কারণে মাটির উপরিভাগ বা ‘টপ সয়েল’ মারাͧকভাবে ক্ষতিগ্রস্টø হবে। কমে আসবে ধান চাষের জমি। বিঘিœত হবে বসতি গড়ে তোলার প্রত্রিক্রয়া। চরের ফসলের বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ন®দ্ব হবে। কৃষক জমির মালিক থাকলেও উর্বরতা চলে যাওয়ায় ফসল ফলাতে পারবে না। কৃষি ব্যবস্ট’ার নিয়šúণ ত্রক্রমেই চলে যাবে মধ্যস্ট^Í^ভোগী ফাটকা ব্যবসায়ীদের হাতে। ব্যবসায়ী খামারিদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় কৃষক টিকতে পারবে না। ত্রক্রমেই জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে পরিণত হবে ক্ষেতমজুর কিংবা সর্বহারায়। যেমন সাঁওতালরা হারিয়েছিল বন ও জঙ্গলের অধিকার।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের চরবাগুয়া গ্রামের কৃষক হায়দার আলী তার চরের জমিতে ধান, বুট, খেসারি, কাউন, চিনা, ধনিয়া, মৌরি, মি®িদ্বআলু, বাদাম, লাউ, কুমড়া, বেগুন ও কলাসহ নানা জাতের দেশি ফসল বুনতেন। তা দিয়ে মঙ্গা ও আপৎকালীন সমস্যা মোকাবেলা করতেন। তাকে সারের জন্য ধরনা দিতে হতো। কখনোবা চড়া দামে কিনে লোকসানও গুনতে হয়েছে। আগামী আউশ মৌসুমে তার জমিতে ধান বা কোনো ফসলেরই চাষাবাদ করবেন না তিনি। কিন্তু তখন তার হাতে থাকবে কড়কড়ে টাকা। তার জমি লিজ নিয়েছেন নাটোরের এক ভুট্টা ব্যবসায়ী। তিনিই এখন চাষাবাদ করবেন। হায়দার আলী জমি লিজ দিতে পেরে খুবই খুশি ছিলেন। কিন্তু ভবিষ্যতে এই জমি তার আর নাও থাকতে পারে বলে কৃষি আন্দোলনের কর্মীরা তাকে বোঝানোর পর এখন তিনি তার ভুল বুঝতে পারছেন। লালমনিরহাট জেলায় এ প্রবণতা আরো প্রকট। কাঁধে লাঙল-জোয়াল, হাতে ধরা হালের বলদের দড়িÑ গ্রামবাংলার এ চিরায়ত দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। হাজার হাজার একর জমি ভুট্টা চাষের জন্য লিজ হয়ে গেছে। মৌসুম এলে জমিতে চলে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার। সেচযšেúর ঘট ঘট আওয়াজে প্রক¤িক্সত কৃষকের খুলি। চাষী নিজে চাষ করে না। জমির ভাড়া গোনে। খালি পড়ে থাকে কৃষকের ধানের গোলা। এ অঞ্চলের কৃষি ও চাষ ব্যবস্ট’া চলে যাচ্ছে ফটকা ব্যবসায়ীদের হাতে। ভবিষ্যতে কখনো লাভ না দেখলে ব্যবসায়ীরা কেটে পড়বে; কিন্তু চাষীরও আর জমি চাষবাসের উপায় থাকবে না।
পাটগ্রাম উপজেলার কৃষক নুরুদ্দীন মিঞা জানান, তিনি পাঁচ বছর আগে জমি লিজ দিয়েছিলেন ঢাকা থেকে আসা জয়নাল নামে এক ব্যাবসায়ীর কাছে। ভুট্টা চাষ করে তিন বছর ভালো লাভ করেছিলেন জয়নাল। কিন্তু চতুর্থ বছরে যখন লোকসান গুনলেন তখন লিজ বাতিল করে চলে গেলেন। পরের বছর নুরু মিঞা নিজে ধান বুনলেন। ধান ভালো হলো না। তারও লোকসান হলো। তিনি কৃষি বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, যে জমিতে ভুট্টা চাষ হয় সে জমিতে ধান কিংবা প্রচলিত ফসল ভালো হয় না। ভুট্টা চাষে বেশি পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহƒত হয় বলে জমির উর্বরতা কমে যায়।
নুরুদ্দীন মিঞা এরপর তার ৬৩ শতাংশ জমি ঢাকার ভুট্টা ব্যবসায়ী ওয়াসিউল ইসলামের কাছে বিত্রিক্র করে দেন। এখন তিনি হাটে হাটে কাঁচামালের চটি দোকান করেন। তার মতো অনেকেই লোভে পড়ে ভুট্টা চাষের জন্য জমি লিজ দিয়ে সর্বস্ট^াšø হয়েছেন বলে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান।
সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ ইউনিয়নের তালপট্টির চর, মধ্যচর, কুঠিপাড়া, রাজপুর ইউনিয়নের চিনাতলী, ভহৃতনাথ ও আরজি চিনাতলী চরেও একই চিত্র দেখা গেল। এসব এলাকায় মৌসুমে প্রতি একর জমি ৪০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার টাকায় পর্যšø লিজ দেওয়া হয়। জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ স¤ক্সর্কে ঢাকার ব্যবসায়ী জুনায়েদ সিদ্দিকী জানান, তিনি তার এক বল্পব্দুর ™^ারা এ প™ব্দতিতে চাষাবাদে উ™^ু™ব্দ হয়েছেন। ওই বল্পব্দু পঞ্চগড় জেলায় বিস্টøীর্ণ এলাকা লিজ নিয়ে ভুট্টা ও বাউকুল চাষ শুরু করেছেন। এ ব্যবসায় লাভ ভালো হয়, পাশাপাশি ব্যাংক থেকে মোটা অগ্ধেকর টাকা ঋণ পাওয়া যায়। এ কারণে তিনি এবার লালমনিরহাট জেলার বুড়িমারিতে ৩০ একর জমি লিজ নিয়েছেন সামনের মৌসুমে ভুট্টা চাষের জন্য।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশি®দ্ব পরিবেশবাদী, দেশি বীজ সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান, নয়া কৃষি আন্দোলন ও ‘উবিনীগ’-এর (উল্পুয়ন বিকল্কপ্প নীতি গবেষণা কেন্দ্র) পরিচালক ফরহাদ মজহার সমকালকে বলেন, অপরিকল্কিপ্পত ও অপ্রচলিত চাষ করে চরের আবাসন ক্ষতিগ্রস্টø করা হচ্ছে। যেন ঈশ^রের ওপর খবরদারি। চরের মাটির উপরিভাগ বা ‘টপ সয়েল’ ন®দ্ব করে ফেলা হচ্ছে। ভুট্টা চাষের নামে করা হচ্ছে বিষের চাষ। ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক কীটনাশক। ন®দ্ব করা হচ্ছে জমির স্ট^াভাবিক উর্বরতা ও পরাগায়ন। তিনি আরো বলেন, যে প্রচলিত খাদ্য উৎপাদন করে চরের মানুষজন তাদের আপৎকালীন বা মঙ্গা মোকাবেলা করে আসছে, এ অবস্ট’ায় তা আর করতে পারবে না। হারিয়ে যাবে দেশি ফসলের বীজ।
দেশের বিশি®দ্ব অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সমকালকে জানান, পৃথিবীর অনেক দেশের কৃষিতে এ অবস্ট’ার সৃ®িদ্ব হয়েছে। আমাদের দেশে হচ্ছে দেরিতে। এ ঘটনাকে তিনি ‘ক্যাপিটালি¯দ্ব পেনিট্রেশন’ বলে অভিহিত করে বলেন, এ পরিস্টি’তিতে দেশের কৃষি এবং কৃষকদের মধ্যে অনেক ভাঙাগড়ার খেলা হবে। বিভাজন সৃ®িদ্ব হবে। এই ভাঙাগড়ার খেলায় কৃষকদের একটি বিশাল অংশ নিঃস্ট^ হবে। এটাই পুঁজিবাদের ধর্ম। এ থেকে পরিত্রাণের একটাই উপায়, কৃষকদের সমবায়ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্ট’া গড়ে তুলে চাষাবাদ শুরু করা।
অরডিআরএস (রংপুর-দিনাজপুর রুরাল সার্ভিস) নামে একটি বেসরকারি সংস্ট’ায় কর্মরত কৃষিবিদ ও গবেষক মৃণ¥য় গুহ নিয়োগী জানান, ভুট্টা চাষ আমাদের দেশের জমি ও বর্তমান খাদ্য ঘাটতির পরিস্টি’তিতে ক্ষতিকর। ভুট্টা সাধারণত পতিত বা এক ফসলি জমিতে চাষযোগ্য একটি সারখেকো ফসল। দো-ফসলি জমিতে চাষ করলে মাটির উর্বরতা কমে যাবে এবং পরে ধান কিংবা অন্য ফসল চাষ করতে গেলে উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দেবে। তখন প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে ফসলের স্ট^াভাবিক বেড়ে ওঠা ধরে রাখতে হবে। এছাড়াও অধিক কীটনাশক ব্যবহারের কারণে ভুট্টা গাছে যখন ফুল আসে তখন ওই ফুলে মধু আহরণের জন্য বসা প্রজাপতি, মথ, ফড়িং প্রভৃতি পতঙ্গ মারা যায়। এসব পতঙ্গের অভাবে ওই এলাকায় লাউ, কুমড়া ও নানা জাতের শাক-সবজির পরাগায়ন বাধাগ্রস্টø ও বিলল্ফি^ত হয়। কেননা ওইসব পতঙ্গের পা ও পাখায় জড়িয়ে রেণু এক ফুল থেকে অন্য ফুলে গিয়ে পরাগায়ন ঘটায়।
তিনি জমি লিজ প্রথার বিরোধিতা করে বলেন, কৃষকরা যাতে তাদের জমিতে চাষাবাদ করতে পারে এজন্য তাদের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে।
কৃষি স¤ক্স্রসারণ অধিদফতর ও বিভিল্পু এনজিওর সহৃত্রগুলো জানায়, উত্তরের ১৬ জেলার চরাঞ্চলে এক ও দো-ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ২ লাখ হেক্টর। এর শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ জমিতে বিভিল্পু ধরনের দেশি জাতের ফসল উৎপাদিত হয়ে থাকে। কিন্তু গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে বিভিল্পু ব্যবসায়ী এসব জমি লিজ নিয়ে ভট্টা চাষ করে আসছেন। চরের আবাদি ৮৫ হাজার হেক্টর জমি লিজ হয়েছে। এ চাষাবাদে সহযোগিতা করছে মার্কিন যুক্তরা®েদ্ব্রর উইনরক ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি সংস্ট’া, দেশি এনজিও ব্র্যাক এবং কয়েকটি বেসরকারি বীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। উইনরক বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিবারণ, পরিবেশ, কৃষি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বেসরকারি প্রকল্কপ্প চালাচ্ছে; ভুট্টা চাষ উৎসাহিত করার প্রকল্কপ্প শুরু করেছে ২০০৪ সালে, যার মহৃল কর্মস্ট’ল রংপুর।
দেশে ভুট্টার চাহিদা রয়েছে খামারের মুরগির খাদ্য বা পোলট্রি ফিড তৈরির জন্য। আমেরিকা-ইউরোপে ভুট্টাসহ অন্য শস্য থেকে জ্বালানি (ইথানল বা বায়ো-ফুয়েল) তৈরি হচ্ছে। তবে পরিবেশবাদী ও কৃষিবিদরা এ নিয়ে বিতর্কও তুলেছেন।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor