
যুগান্তর ২০ আগস্ট ২০০৮
বাংলাদেশ সেন্টার ফর এডভান্সড স্টাডিজের (বিসিএএস) নির্বাহী পরিচালক ড. এ আতিক রহমান জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা আইপিসিসির সদস্য। পরিবেশের ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য জাতিসংঘ পরিবেশ সংস্থা (ইউএনইপি) তাকে ২০০৮ সালের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত গবেষণার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ অধিদফতর তাকে ‘এনভায়রনমেন্ট এওয়ার্ড ২০০৮’ প্রদান করে। ড. আতিক রহমান বোস্টনের টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর। এর আগে প্রায় দেড় দশক তিনি অক্সফোর্ড ও এবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণা করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে লন্ডনের ব্র“নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। যুগান্তরের পক্ষে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ রোকন।
যুগান্তর : স¤প্রতি ইন্ডিপেনডেন্টের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০৭১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তলিয়ে যাবে। আপনি এ আশংকা কতটা সত্য মানেন?
ড. আতিক রহমান : না, সম্পূর্ণ ডুবে যাবে না। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা তো বাড়বেই। আইপিসিসি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৮৯-৯০ সেমি বেড়ে যাবে। আইপিসিসির চতুর্থ রিপোর্টের পর আরও যেসব রিপোর্ট ও আর্টিকেল বেরিয়েছে খুব বিখ্যাত এবং সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞানভিত্তিক, সেখানে বলা হচ্ছে, মেরু অঞ্চলের বরফ আশংকার চেয়ে দ্রুতগতিতে গলছে। বাংলাদেশ কর্কটক্রান্তি অঞ্চলে অবস্থিত। এখানে যদি তাপমাত্রা এক-দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, মেরু অঞ্চলে বাড়বে ছয় ডিগ্রি। তাতে করে বরফ অনেক দ্রুত গলবে। আরও কিছু সূচকে দেখা যাচ্ছে, বরফ গলাটা বাড়বে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে এবং দেশের অনেক অভ্যন্তরের অঞ্চল পর্যন্ত তলিয়ে যাবে। কতটা যাবে, এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। আগে হিসাব করা হয়েছিল, এক মিটার উচ্চতা বাড়লে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৭ ভাগ তলিয়ে যাবে। বরফ গলার হার বেড়ে যাওয়ায় সেটা এখন আরও বাড়তে পারে।
যুগান্তর : জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ কী ধরনের বিপদের সম্মুখীন হবে?
আতিক রহমান : দক্ষিণাঞ্চলের ১৭ ভাগ তলিয়ে গেলে ১৩ ভাগ কৃষিজমি বিনষ্ট হবে। সাইক্লোনের সংখ্যা ও গতি দুটোই বেড়ে যাবে। সাইক্লোনের ক্ষতি আরও বাড়বে। একদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, অন্যদিকে সাইক্লোন বাড়বে। দুটোর সমন্বয়ে পানি স্থলভাগের অনেক ভেতরে চলে আসবে। সাইক্লোনের সবচেয়ে প্রাণঘাতী দিক হচ্ছে জলোচ্ছ্বাস। তখন এটা আরও তীব্র হবে এবং অনেক অভ্যন্তরে চলে আসবে। বেশি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও জলোচ্ছ্বাসের আওতা বাড়ার ফলে লবণাক্ত পানিও অনেক ভেতরে চলে আসবে। আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে মাটি ও পানির লবণাক্ততা বেড়ে যাবে এবং খাদ্য উৎপাদন কমবে। সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে। বনের পরিধি কমে যেতে পারে, হারিয়েও যেতে পারে।
আরেকটি বিপদ হচ্ছে, হিমালয়ের যে বরফরাশি বা হিমবাহ থেকে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের মতো নদীর উৎপত্তি, সেগুলো গলতে শুরু করেছে। গত ২০ বছরে গঙ্গোত্রি হিমবাহ ৮৬ মিটার পিছিয়ে গেছে। এখন আরও দ্রুতগতিতে গলছে। নেপাল-ভুটানে আগেই দেখা গিয়েছিল, সেখানে হ্রদের পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর পাকিস্তানিরাও জানিয়েছে, সেখানে বড় বড় নতুন লেক তৈরি হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে বরফ গলা পানি। বেশি বরফ গলার জন্য মধ্য বাংলাদেশে জলাবদ্ধতা দেখা দেবে। কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় নদীবাহিত পানি সরবে না। বাংলাদেশের প¬াবন ভূমিতে বন্যা আরও বাড়বে। নদীভাঙন বাড়বে। নদীগুলোর তলদেশ আরও উঁচু হবে। ফলে বন্যার পৌনঃপুনিকতা ও ক্ষতির মাত্রা বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বরেন্দ্রভূমি আরও শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে। সব সূচকই তাই বলছে। ওই অঞ্চলে যে শস্য হতো, সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। আইপিসিসি বলছে, গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ২০৩০ সাল নাগাদ ২০-৩০ শতাংশ খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে। ফলে খাদ্যাভাব ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাবে।
কবিতা, প্রকৃতি ও জীবনÑ যেখান থেকেই হোক, আমরা এখন জানি কোন মাসে কেমন বৃষ্টিপাত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এতে অনিশ্চয়তা দেখা দেবে। ফলে চাষীরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। সব মিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করবে।
যুগান্তর : জলবায়ু পরিবর্তনের কোন প্রভাব কি এ মুহূর্তেই শুরু হয়েছে?
আতিক রহমান : দু-তিনটি প্রভাবের কথা এখনই বলা যায়। আমরা দক্ষিণাঞ্চলে গিয়ে প্রবীণদের জিজ্ঞেস করে জেনেছি, অমাবস্যা-পূর্ণিমার সময় যে বড় জোয়ার, সেটার উচ্চতা অনেক বেড়েছে। খেপুপাড়া-কুয়াকাটার দিকে গেলে দেখা যাবে, মানুষ তাদের ভিটে উঁচু করছে। দক্ষিণাঞ্চলে আগের মতো সুপেয় পানি পাওয়া যাচ্ছে না। তার মানে লবণাক্ততা বাড়ছে। একদিকে উত্তর থেকে আসা সুপেয় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে দক্ষিণের লবণাক্ততা বাড়ছে। সিডরের মতো শক্তিশালী সাইক্লোন আগে আমরা দেখিনি। আইপিসিসির অনুমানের সঙ্গে এটা মিলে যায়। ২০০৭ সালে দুটো বন্যা হয়েছে একই বর্ষা মৌসুমে। একই মৌসুমে দুটো বন্যা হওয়ার নজির নেই। অন্তত আমার জানা নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যে পড়তে শুরু করেছে, এগুলো তারই ইঙ্গিত।
যুগান্তর : এ পরিবর্তনের কারণ সংক্ষেপে যদি বলেন।
আতিক রহমান : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন। বর্তমানে উন্নত রাষ্ট্রগুলো গত দুইশ’ বছর ধরে এ গ্যাস উৎপাদন করেছে। তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যে পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে, যে কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন উৎপন্ন হয়েছে, সেটা বায়ুমণ্ডলে আটকে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপানের মতো দেশের দুশ’ বছরের দাহনের ফলে বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। আমাদের বায়ুমণ্ডল অনেক বড়, কিন্তু বর্তমানে এর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে।
যুগান্তর : এতে বাংলাদেশের দায় কতটুকু?
আতিক রহমান : বাংলাদেশের দায় খুবই কম। বাংলাদেশে মাথাপিছু দুশ’ কেজির মতো প্রতিবছর কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হয়। গ্রামের একটি সাধারণ পরিবার হয়তো সন্ধ্যাবেলা থেকে দেড়-দু’ঘণ্টা একটা কুপি জ্বালায়। তারা যে খুড়কুটো জ্বালায়, পরবর্তী বছর তাদের কৃষি ও প্রকৃতিভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা ওই পরিমাণ কার্বন শুষে নেয়। কার্বন ডাই অক্সাইড হিসেবে বায়ুমণ্ডলে জমে না। যতটুকু জমে, সেটা হিসাবে আসে না। বাংলাদেশের শহরের লোকজনেরই বা ক’টা এয়ার কন্ডিশনার আছে? ক’জনের একাধিক গাড়ি আছে? ভারত বা পাশ্চাত্যে শতাব্দী ধরে কয়লা পোড়ানো হচ্ছে, আমরা সেটা করি না। ইউনিট প্রতি জ্বালানি পোড়ালে সবচেয়ে বেশি কার্বন বের হয় কয়লায়, তারপর পেট্রল এবং তারপর প্রাকৃতিক গ্যাসের। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা প্রথমেই প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে শুরু করেছি।
যুগান্তর : জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আমাদের করণীয় কী হতে পারে?
আতিক রহমান : বাংলাদেশের সবাই যদি আগামীকাল থেকে কোন গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন না করে, তাহলে কি আমরা জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে পারব? না। আমরা তো খুব কম উদগিরণ করি। বলা হয়, গোটা বাংলাদেশ যতটা গ্রিনহাউজ গ্যাস উদগিরণ করে, শুধু নিউইয়র্ক সিটি তারচেয়ে বেশি কার্বন করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যারা দায়ী, তাদেরকেই গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমাতে হবে। আইপিসিসি স্পষ্ট বলেছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ৮০ শতাংশ গ্রিনহাউজ উদগিরণ কমাতে হবে। তা না হলে প্রচণ্ড ক্ষতি হয়ে যাবে। প্যানেলের চেয়ারম্যান রাজেন্দ্র পাচুরি সম্প্রতি বলেছেন, আমাদের হাতে সময় খুব কম। দেরিতে ব্যবস্থা নিলে আমরা উদগিরণ কমাতে পারব না। পাশ্চাত্য দেশগুলোকেই আগে গ্রিনহাউজ গ্যাস কমাতে হবে। তারপর চীন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো নতুন অর্থনৈতিক শক্তিকে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হয়ে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমাতে হবে। পদ্ধতিটি হবে ডিকার্বনাইজেশন অব ডেভেলপমেন্ট। উন্নয়ন অব্যাহত থাকবে; কিন্তু কার্বন কমাতে হবে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যতই কার্বন নির্গমন কমানো হোক, জলবায়ুর পরিবর্তন যা হওয়ার ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। এখন আমাদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশের জন্য এটাই জরুরি।
যুগান্তর : ডিকার্বনাইজেশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কী করার আছে?
আতিক রহমান : অল্প কিছু করার আছে। সব সাধারণ বাল্বের বদলে যদি আমরা এনার্জি সেভিং বাল্বে চলে যাই, তাহলে বর্তমানের বিদ্যুৎ ঘাটতি বহুলাংশে কমে হবে। পাকা বাড়ি ও বহুতল ভবনে যদি পোড়া ইট ব্যবহার না করে অন্য ধরনের ইট (রোদে শুকানো কমপ্যাক্ট ইট) ব্যবহার করতে পারি, তাহলে সুবিধা হবে। ট্রাফিক জ্যাম কমিয়ে ফেলতে পারলেও জ্বালানি কম পুড়বে এবং কার্বন কম উদগিরণ হবে। উন্নতর গাড়ি হলেও সেটা কমবে। আমরা গাছ লাগিয়ে কার্বন নির্গমন কমাতে পারি।
যুগান্তর : আপনি বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে বলছিলেন।
আতিক রহমান : লবণাক্ততার কারণে শস্য উৎপাদন কমে যাবে বা কোন কোন অঞ্চলে শস্য হবে না। এজন্য আমাদের লবণসহিষ্ণু শস্য উদ্ভাবন করতে হবে। এ নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। বিআর-৪৮ নামে একটি ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে। কিন্তু তার উৎপাদন অনেক কম। এটা বাড়াতে হবে। মঙ্গা এলাকায় এমন কিছু ধান চাষ করা হচ্ছে, যা শুকনো মৌসুমেও টিকে থাকে। এর উৎপাদন বাড়ানোর কাজ করতে হবে। বরিশাল অঞ্চলের মানুষ কচুরিপানা জড়ো করে এক ধরনের ভাসমান বাগান তৈরি করেÑ তার ওপর লাউ, কুমড়া লাগায়। এটার সম্প্রসারণ প্রয়োজন হবে। উন্নত চুলা করে অল্প কাঠে যাতে অধিক রান্না হয়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। বায়োগ্যাস করে গোবর পচে যে মিথেন বের হয়, সেটা কমাতে পারি। শহরে গার্হস্থ্য বর্জ্য কম্পোস্ট করতে পারি। এর মিথেন বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে লাগাতে পারি। যেসব এলাকায় এখনও বিদ্যুৎ নেই, সেখানে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারি। সৌরতাপ দিয়ে পানি গরম করে আমরা বাড়িতে, হাসপাতালে ব্যবহার করতে পারি। এগুলো হচ্ছে মিটিগেশন।
যুগান্তর : খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা কী করতে পারি?
আতিক রহমান : মিটিগেশনের পাশাপাশি এডাপ্টেশন বা অভিযোজন জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কৌশল, যেমন এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার ব্যবস্থাও মানুষকে শেখাতে হবে। সে এডাপ্টেশনই কাজে লাগবে, যেটা উন্নয়নে সাহায্য করে। দক্ষিণাঞ্চলে মানুষকে সরাতে না চাইলে চার-পাঁচতলা বাড়ি করতে হবে। নিচতলা খোলা রাখলে বন্যা আসবে এবং চলে যাবে। গরিব এর খরচ বহন করতে পারবে না। সরকার এমন কিছু বাড়ি করে দিতে পারে। আরও কিছু সাইক্লোন শেল্টার করা যেতে পারে। গ্রামের কোন বড়লোক হয়তো কাঠের বড় বাড়ি করতে চায়। সরকার থেকে কিছুটা সাহায্য দিয়ে বিল্ডিং করে দেয়া যেতে পারে। গ্রামের লোকজন সেখানে আশ্রয় নিতে পারে। এগুলো হচ্ছে স্ট্রাকচারাল এডাপ্টেশন। আবার নতুন সুন্দরবন তৈরি করে সাইক্লোন-জলোচ্ছ্বাসের আঘাত কমিয়ে দেয়া যেতে পারে। যেসব বাঁধ ও পোল্ডার রয়েছে, সেগুলো আরও উঁচু ও শক্তিশালী করতে হবে। সুপেয় পানি ও পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা করে দেয়া যেতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কাগুলোর সঙ্গে উন্নয়নের বিষয়কে সমন্বিত করে নতুনতর উন্নত পদ্ধতিতে মানুষকে অভ্যস্ত করতে হবে।
যুগান্তর : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা এবং এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার তো একটা খরচ আছে।
আতিক রহমান : হ্যাঁ, এতে খরচ আছে। এটা কে দেবে? বলা হচ্ছে, পলুটারস পে। যে দূষণ করেছে, তাকে এর ব্যয় বহন করতে হবে। তারা কারা, আমরা জানি। ক্লাইমেট কনভেনশনের এনেক্স ওয়ানে লেখা আছে, ধনী ও শিল্পোন্নত দেশগুলো এর জন্য বেশি দায়ী। অথচ দরিদ্র দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল ভোগ করবে অনেক বেশিমাত্রায়।
আইপিসিসির চতুর্থ রিপোর্টে স্পষ্ট এসেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কে কী মাত্রায় দায় বহন করবে। ইংরেজিতে বলেÑ বার্ডেন শেয়ারিং। আমাদের এখন ‘কমন বাট ডিফারেনশিয়েট রেন্সপন্সিবিলিটি’ নিয়ে কাজ করতে হবে। উন্নততর দেশগুলোকে দায় নিয়ে উন্নয়নশীলদের সহায়তা দিতে হবে। আমাদের মতো স্বল্পোন্নত অথচ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশকে টাকা, সম্পদ ও প্রযুক্তি দিতে হবে।
যুগান্তর : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আমরা কতটা অগ্রসর হতে পেরেছি?
আতিক রহমান : খুব বেশি পারিনি। সচেতনতা একদমই ছিল না। তবে এখন অনেক বেড়েছে। সরকারও খুব সচেতন। যে কোন সরকারকে সচেতন হতে হবে। কারণ আইপিসিসির চতুর্থ রিপোর্টে বিষয়টি স্পষ্ট বলা হয়েছে। আগে দ্বিধা ছিল। এখন কোন দ্বিধা নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ দেখা দিচ্ছে। আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে আনতে হবে। ছাত্রছাত্রী, বাড়ির মহিলাদেরও বোঝাতে হবে। এখন বেশিরভাগ মানুষই বিষয়টি নিয়ে ভাসাভাসা কথা শুনছে। এটাকে সামগ্রিকভাবেÑ সুনির্দিষ্ট ও গভীর করে বোঝাতে হবে।
যুগান্তর : জলবায়ু পরিবর্তনে কিছু উন্নত দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের সঙ্গে তাদের প্রস্তুতির বিষয়টি কিভাবে তুলনা করবেন?
আতিক রহমান : আমাদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে নেদারল্যান্ডসের। ওই দেশও আমাদের মতো সমতল। আমাদের মতোই সমুদ্রের হুমকির মুখে। তবে আমাদের মতো বড় নদী নেই। তাদের রাইন খুবই ছোট নদীÑ পদ্মা, মেঘনার মতো নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নেদারল্যান্ডসের অর্থের অভাব নেই। ফিলিপস, সেল, ইউনিলিভারের মতো বড় কোম্পানি এজন্য এগিয়ে এসেছে। নেদারল্যান্ডসের সমুদ্র তীরবর্তী বাঁধ এক মিটার উঁচু করতে এক বিলিয়ন ডলার খরচ হবে। সেটা তারা ব্যাংকে জমা রেখেছে। বাংলাদেশের তো এত টাকা নেই। একই সঙ্গে বর্তমানে খাদ্যনিরাপত্তা বিধান এবং ভবিষ্যতের উন্নয়নও নিশ্চিত করতে হবে। নেদারল্যান্ডসের মতো দেশের নৈতিক দায়িত্ব হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো দেশকে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে আর্থিক সাহায্য দেয়া। এটা আগের সাহায্যগুলোর সঙ্গে মেলালে চলবে না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতে আগে যে সহায়তা দেয়া হতো, সেটা বহাল রেখেই জলবায়ু ইস্যুতে নতুন সহায়তা দেয়া হবে। এ নিয়ে চিন্তাভাবনা হচ্ছে।
বাংলাদেশের সুবিধা হচ্ছে, এখানকার জনগোষ্ঠী দুর্যোগ মোকাবেলায় অভ্যস্ত। এদেশের অনেক সামাজিক প্রতিষ্ঠান, এনজিও বড় বড় কাজ করেছে। আমরাও গত ২০ বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করছি। বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান আমাদের সম্পর্কে জানে। আমাদের প্রধান সমস্যা দারিদ্র্য। একই সঙ্গে দারিদ্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। সরকারকে তো আগে দারিদ্র্যের দিকটা দেখতে হয়। আবার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা না করতে পারলে দারিদ্র্য বেড়ে যাবে। দারিদ্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তন কিভাবে মোকাবেলা করা যায়Ñ এ নিয়ে আমরা এখন গবেষণা করছি। একই সঙ্গে আমাদের দুটি কাজ করতে হবে। এটা খুব কঠিন। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের গতানুগতিক মানসিকতা একটি বড় বাধা। তারা শুধু নিজেদের মেয়াদের জন্য চিন্তা করেন। তার বদলে নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে। কৃষি, মৎস্য, বন, পশুপালন বিভাগকে এ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করতে হবে।
যুগান্তর : সরকারের পক্ষে তো ক্লাইমেট চেঞ্জ সেল ও ন্যাশনাল প¬ান অব অ্যাকশন প্রণয়ন করা হয়েছে।
আতিক রহমান : ন্যাশনাল প¬ান অব অ্যাকশন (ঘঅচঅ) বা নাপা করা হয়েছিল। কিন্তু এটার উদ্দেশ্য ছিল সীমিত। এটা কোন পরিকল্পনা নয়, কৌশলপত্র নয়, নীতিমালাও নয়। নাপাতে আছে জরুরি ও তাৎক্ষণিক কিছু কাজের তালিকা। এটা করা হয়েছিল বিশেষ কারণে। এখন সেটাকে সদূরপ্রসারী করতে হলে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টির সমন্বয় ঘটাতে হবে।
যুগান্তর : জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বৈশ্বিক কী কী উদ্যোগ রয়েছে?
আতিক রহমান : ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে ক্লাইমেট কনভেনশন হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রটোকল নামে একটি ডকুমেন্ট তৈরি হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ২০১২ সালের মধ্যে উন্নত দেশগুলো শতকরা ৫৪ ভাগ গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন কমাবে। কিয়োটো প্রটোকলের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে ২০১২ সালে। এ সময়ের মধ্যে ধনী দেশগুলোকে অনেক কিছু করতে হবে। ২০১২ সালের পরের করণীয় এখনই ঠিক করতে হবে। ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে এ নিয়ে আরেকটি মিটিং হবে। গত বছর বালি সম্মেলনে মোটামুটি সিদ্ধান্ত হয়েছে, চারটি ক্ষেত্রে আমাদের গভীরভাবে জোর দিতে হবে। একটি হচ্ছে মিটিগেশন বা গ্রিনহাউজ গ্যাস কমানো; দ্বিতীয়ত, অভিযোজন বা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া; তৃতীয়ত, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও হস্তান্তর। চতুর্থত, অর্থায়ন। ছোট ছোট তহবিল তৈরি হচ্ছে এখন। এগুলো এক সময় বড় তহবিলে পরিণত হবে।
যুগান্তর : এক্ষেত্রে আঞ্চলিক সহযোগিতা কত দূর এগিয়েছে?
আতিক রহমান : গত মাসে ঢাকায় সার্ক পরিবেশ মন্ত্রীদের সম্মেলন হয়েছে। হিমালয়ান ড্রেইনেজ ইকোসিস্টেমে যে আঘাত আসবে, সেটা ভারত, বাংলাদেশ বা নেপালের একার পক্ষে মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এজন্য আঞ্চলিক ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। ব্যাপক গবেষণা এবং উপাত্ত বিনিময় করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সরকারগুলোকে একত্রে কাজ করতে হবে। এ অঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনে ‘ফুড ব্যাংক’ করতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র এলাকা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবও এখানে সবচেয়ে বেশি পড়বে। আমাদের মধ্যে পানি বণ্টনের মতো কিছু বিষয়ে ঝগড়া আছে। সেগুলো থেকে বেরোতে হবে। কারণ জলবায়ুর দানব হচ্ছে বাইরের। তার বিরুদ্ধে সবাই এক হয়ে লড়াই করতে হবে।
যুগান্তর : জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে বাংলাদেশের অর্থায়ন সম্পর্কে কিছু বলুন।
আতিক রহমান : একটা শুভ লক্ষণ হচ্ছে, চলতি বাজেটে সরকার ৩০০ কোটি টাকার একটা তহবিল তৈরির কথা বলেছে। ৩০০ কোটি বড় কথা নয়, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বাজেটে হেডলাইন হয়েছে, সেটা বড় কথা। এটা চিন্তাধারায় পরিবর্তনের ইঙ্গিত। সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে লন্ডনে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা বিষয়ে একটা উচ্চপর্যায়ের আন্তঃসরকার সভা হবে। সেখান থেকেও এ ধরনের তহবিল আসবে। তবে সেটা একান্তই অনুদানভিত্তিক হবে। কিন্তু জলবায়ু ইস্যুতে তহবিল গঠনের বিষয়টি হতে হবে ধনী দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণমূলক। গে¬াবাল এডাপ্টেশন ফান্ড, গে¬াবাল এনভায়রনমেন্ট ফান্ড বলে আরও দু-একটি ফান্ডিং মেকানিজমও রয়েছে।
গ্লে¬াবাল এডাপ্টেশন ফান্ড নিয়ে একটা কমিটি করা হয়েছে। বাংলাদেশ তার সদস্য। ক্লিন ডেভেলপমেন্ট মেকানিজম সিস্টেমের শতকরা দুই ভাগ নিয়ে একটা ফান্ড হবে। কিয়োটো প্রটোকলে অন্য দুটো ম্যাকানিজম আছে, সেগুলোর অর্থও আসতে হবে। এ ফান্ড কে পাবে? আমাদের দেশ, না অন্য দেশ? জনগণ পাবে, না সরকার পাবে? এখনও গাইড লাইন নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে।
যুগান্তর : বাংলাদেশ কি ইতিমধ্যে কোন ফান্ড পেয়েছে?
আতিক রহমান : অল্প কিছু ফান্ড নিয়ে কথা চলছে। নাপা একটা প্রকল্প পেয়েছে ছয় বা আট মিলিয়ন ডলারের। সেটাও সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে আটকে আছে। এগুলোতে সময় লাগে। গবেষণা করতে হয়। কাগজ তৈরি করতে হয়। একটা ইফিশিয়েন্ট কাউন্টারপার্ট এজেন্সি লাগবে। সেখানে উৎসাহী মানুষ থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক অর্থ আনা অনেক ঝামেলার কাজ।
যুগান্তর : শোনা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন ফান্ড নিয়ে সরকারে দুই মত রয়েছে। কেউ ঋণ নিতে চাইছেন, কেউ চাইছেন অনুদান।
আতিক রহমান : এটাকে আমি খুব বড় ব্যাপার মনে করছি না। সরকারের ভেতর চিন্তাধারায় ব্যবধান থাকতেই পারে। আমরা ১৯৯২ সালে ক্লাইমেট চেঞ্জ কনভেনশন সই করেছি। আজকে ২০০৮। গত ১৬ বছরে আমরা নেগোশিয়েট করেছি একটা নীতির ভিত্তিতে। সেটা হল, আমরা অনুদান নেব ন্যায্য হিস্যা হিসেবে, ক্ষতিপূরণ হিসেবে। ঋণ আমরা নিতে চাই না। স্বল্পোন্নত দেশগুলোরও অবস্থান এটাই। অন্য চিন্তা হচ্ছে, অনুদান দিলে তো কম অর্থ দেবে। বড় বাঁধ করতে অনেক টাকা দরকার। তাহলে কি ঋণ নেব না? তারা বলছে, বড় কাজের জন্য ঋণ নিতে হবে। সে ঋণের পদ্ধতিও ভিন্ন হবে।
যুগান্তর : জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশের কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন, সেটা কি নির্ধারণ করা সম্ভব?
আতিক রহমান : সম্ভব। তবে কস্ট অব এডাপ্টেশন আমরা এখনও করিনি। কেউই করেনি। চিন্তাভাবনা চলছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের একটা টিম এসেছিল। তারা চেষ্টা করছে। আমরা গবেষণা, আলাপ-আলোচনা করছি। বিষয়টি সহজ নয়। কিছু সময় লাগবে।
যুগান্তর : জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তো অনেক জনবল প্রয়োজন হবে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে।
আতিক রহমান : প্রচুর মানুষের প্রয়োজন। আমরা ক’জন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি? একশ’জন। আমাদের দরকার ৫০ হাজার মানুষ। সেই সচেতন ও শিক্ষিত মানুষ কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয়ে কি এটা পড়ানো হচ্ছে? শিক্ষকরা কি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন? সরকার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে সংশি¬ষ্ট মন্ত্রণালয়ের কয়েকজনকে। আমরা প্রশিক্ষণ দিচ্ছি কিছু মানুষকে। কিন্তু আমাদের দরকার হাজার হাজার কর্মী তৈরি করা।
যুগান্তর : গবেষণাও প্রয়োজন। সেটা কতখানি হয়েছে?
আতিক রহমান : বেসরকারি পর্যায়ে গবেষণা এগিয়েছে বেশি। সরকারি পর্যায়ে এগোচ্ছে ধীরে ধীরে। তবে আগের চেয়ে গতি বেড়েছে। কিন্তু আমাদের যে পরিমাণ গবেষণা প্রয়োজন, তার তুলনায় এটা অপ্রতুল।
যুগান্তর : জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কতটা সচেতন?
আতিক রহমান : মানুষ বুঝতে পারছে, আবহাওয়ায়, পরিবেশ ও প্রতিবেশে নানা পরিবর্তন আসছে এবং তা তাদের জীবন-জীবিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কিন্তু এজন্য তাদের কী করণীয়, সে প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছে না। এক্ষেত্রে গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকার, গণমাধ্যম ও সংশি¬ষ্টরা জরুরি ভিত্তিতে কাজ করতে পারেন।
No comments:
Post a Comment