Tuesday, September 2, 2008

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের কৃষি খাত

সমকাল ।। মনির উদ্দিন

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এ দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছিল একটি প্রধান সমস্যা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর এ দেশের লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৭ কোটি আর খাদ্য উৎপাদন ছিল মাত্র ১ কোটি টন। যার কারণে খাদ্য সংকট ছিল এ দেশের নিত্যসঙ্গী। এরপর দেশে শুরু হলো সবুজ বিপ্লব। কম উৎপাদনশীল দেশি জাতের ধানের জমিতে প্রবর্তিত হলো ইরির ও ব্রির আবি®কৃত উচ্চফলনশীল উন্নত জাতের ধান। ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য শুরু হলো রাসায়নিক সারের ব্যবহার। সেচের জন্য সরকারিভাবে বিএডিসির মাধ্যমে স্থ’াপন করা হয় গভীর নলকূপ। আর এভাবেই অভাবের এ দেশে উৎপাদিত হতে থাকে মাঠভরা সোনালি ধান এবং তারই ধারাবাহিকতায় আজ ১৪ কোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দেওয়ার জন্য উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৩ কোটি টন ধান। এভাবেই আগামী দিনের ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্থাপু দেখছিল দেশের ১৪ কোটি মানুষ। বাংলাদেশের সাধারণ খেটে খাওয়া সেই মানুষের স্বপ্নে বাদ সেধেছে প্রকৃতি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে যে বিষয়টি নিয়ে আতংক দেখা দিয়েছে, আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচনা চলছে সেটা হলোÑ বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তন এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব। বিগত কয়েক বছর থেকেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায়ই খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, অসময় বন্যা প্রভৃতি ঘটছে, যা আমাদের জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের আভাসই দিচ্ছে।
উন্নত বিশ্ব দ্র“ত শিল্পায়নের ফলে বায়ুম-লে কার্ব মনোঅক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেইন, ক্লোরোফ্লোরো কার্বন যুক্ত হয়ে ধরিত্রীর তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সেই সঙ্গে বিশ্বের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য যে পরিমাণ বন তথা গাছ থাকা দরকার শিল্প-কারখানা স্থ’াপন, ফসলের জমি বাড়ানো তথা নগরায়নের ফলে সেটা কমে গেছে। এর ফলেও বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড যুক্ত হয়ে বায়ুমন্ডল উত্তপ্ত হচ্ছে। পাশাপাশি কল-কারখানার জ্বালানি, ফসল উৎপাদনের জন্য রাসায়নিক সারের ব্যবহারÑ সবকিছু মিলিয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে গেছে, যার প্রভাবে দুই মেরুর বরফ গলছে। গলিত এই বরফের পানি সমুদ্র পড়ে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। যার কারণে বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশের একটা অংশ পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক এ জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের উন্নয়ন ক্ষতিগ্রস্তহবে সবচেয়ে বেশি। কারণ এ দেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। সীমিত আয়তনের এ দেশে ১৪ কোটি লোকের বাস। নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে চলে এ দেশের কৃষি। আগামীতে বাড়তে থাকবে মানুষ, কমতে থাকবে জমি। এ অবস্থ’ায় দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা দিতে হলে আগামী দিনের কৃষি হবে আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে যেসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হতে পারে বাংলাদেশ, সেগুলো মাথায় রেখেই অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে নিতে হবে আমাদের আগামী দিনের কৃষিকে। জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে গড়ে তুলতে হবে কৃষি ব্যবস্থ’াকে। তাহলে হয়তো দুর্যোগের মোকাবেলা করেই দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে কৃষি ব্যবস্থ’া গড়ে তোলার জন্য যে বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া দরকার এবং যথাযথ পদক্ষেপ এখন থেকেই গ্রহণ করা জরুরি তা হলো : ফসলের এমন জাত উদ্ভাবন করা, যা পরিবর্তিত আবহাওয়ায় খাপ খাওয়াতে পারে। ২০০৭ সালের বোরো মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ধানে চিটা হয়েছিল, যার পেছনে নীরব ভূমিকা ছিল জলবায়ুগত পরিবর্তনের। ধানের ফুল আসা অবস্থ’ায় যদি অতি তাপমাত্রা, অতি ঠান্ডা, অতিবর্ষণ বা প্রবল বায়ুপ্রবাহ যে কোনো একটি ঘটে তাহলে পরাগায়নে বাধার কারণে ধানে চিটা হবে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা যেমন রাজশাহী অঞ্চলের বরেন্দ্র এলাকা, ময়মনসিংহের বিভিন্ন সীমান্ত বর্তী এলাকা, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়ের অনেক এলাকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জমি বোরো মৌসুমে সেচের অভাবে অনাবাদি থাকে। গভীর নলকূপ ছাড়া এসব এলাকায় সেচের ব্যবস্থ’া করা অসম্ভব। আর স্থ’ানীয় কৃষকদের পক্ষে গভীর নলকূপ স্থ’াপন করা দুরূহ। তাই সরকার যদি এসব এলাকায় গভীর নলকূপ স্থ’াপনের ব্যবস্থ’া করে তাহলে দেশের বোরো মৌসুমে আবাদি জমির পরিমাণ বেড়ে যাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। হাওর-বাঁওড়, বিল-ঝিলের এ দেশে নিয়মিত বন্যার কারণে অনেক হাওর-বাঁওড়, বিল বন্যাবাহিত পলির মাধ্যমে উঁচু জমিতে পরিণত হয়েছে, যেখানে বোরো চাষ হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের উন্নয়ন কর্মকা-ের জন্য অবকাঠামো তথা রাস্তাঘাট নির্মাণ করতে গিয়ে প্রতিটি জেলায় বিপুল পরিমাণ জমি কৃত্রিম জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ, খাল খনন, স্লুইস গেট নির্মাণ করে শস্যের নিবিড়তাও বাড়ানো দরকার। পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থ’াপনা করা সম্ভব হলে অনেক এক ফসলি জমি দুই ফসলের আওতায়, দুই ফসলি জমি তিন ফসলের আওতায় আসতে পারে।
উপকূলীয় এলাকায় রয়েছে আমাদের আবাদি জমির মোট ২০ শতাংশ, যা ইতিমধ্যেই লবণাক্ততার কবলে আক্রান্ত। খুলনার বিস্তীর্ণ এলাকায় ধানের ফলন একরপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ মণের জায়গায় ৫ থেকে ৬ মণে নেমে এসেছে। এখনই পরিকল্পিত ব্যবস্থ’া নেওয়া দরকার এসব জমিকে লবণাক্ততার হাত থেকে রক্ষা করার। এক্ষেত্রে উপকূলীয় অঞ্চলকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে এলাকার স্থ’ানীয় খাল ও নদীগুলোকে সংস্কারের মাধ্যমে উজানে পলিবাহিত পানিকে বর্ষাকালে এসব এলাকার জমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত করা এবং তা যথাযথ নিষ্কাশনের ব্যবস্থ’া থাকা। কৃষি জমি যাতে অকৃষি খাতে চলে না যায় তার ব্যবস্থ’া গ্রহণ করা দরকার। ধান উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল এ দেশের অর্থনীতি। তাই আগামীতে দুর্যোগ উপেক্ষা করেও যাতে দেশের চাহিদামাফিক ফসল উৎপাদন অব্যাহত রাখা যায় সেজন্য কৃষি জমিকে রক্ষা করা অতীব জরুরি। গ্রামীণ বাড়িঘর নির্মাণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকা দরকার। চীনের মতো বিশাল দেশেও নির্দিষ্ট এলাকায় বসতি স্থ’াপন করে পরিকল্পিতভাবে জমির ব্যবহার করা হচ্ছে। সেখানে আমাদের গ্রামীণ পর্যায়ে বাড়িঘর তথা বসতি স্থ’াপনে কোনো নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor