Tuesday, September 2, 2008

কৃষিক্ষেত্রে অর্গানিক পেস্টিসাইড

২৭.০৮.০৮
কৃষিবিদ মো. নূর আলম মিয়া

কৃষিক্ষেত্রে পোকামাকড়, রোগজীবাণু, আগাছা, ছত্রাক ইত্যাদিকে বিনাশ করার জন্য ডিডিটি, এলড্রিন, ক্লোরডেন, হেপ্টাক্লোর, টক্সাফিন, আনসার ইত্যাদি ওষুধ পৃথিবীর সব দেশেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব রাসায়নিক দ্রব্যাদি আজকাল মানুষের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তাদের শরীরে স্বাভাবিক ব্যক্তির তুলনায় আড়াই গুণ বেশি ডিডিটি থাকে। অনেকে ধারণা করেছেন, এর উপস্থিতিই ক্যান্সার হওয়ার একমাত্র কারণ। অপরিকল্পিতভাবে কীটনাশক ব্যবহার করায় ফসলের জমিতে নতুন নতুন শক্তিশালী পোকার জন্ম হচ্ছে। অনেক পোকামাকড়ের শরীরে কীটনাশকের বিষক্রিয়া অকার্যকর। উপরন্তু বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় জলজ প্রাণীসহ পরিবেশ অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। ১৯৫৪ সালে বাংলাদেশে ৩ মেট্রিক টন কীটনাশক আমদানি হতো, এখন বছরে ২৩০ গুণ বেশি কীটনাশক সরকারিভাবে আমদানি হচ্ছে। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে বালাইনাশক আমদানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫ হাজার মেট্রিক টন। টাকার পরিমাণে যা ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০০৩ সালে কৃষি খাতে বালাইনাশকের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ২৩০ শতাংশ।
দেশে প্রতি বছর পোকামাকড় দমনে প্রায় ৭ হাজার টন বিভিন্ন ক্ষতিকর কীটনাশক ফসলি জমিতে মিশছে। কোনো নিয়মনীতি ছাড়াই ইচ্ছামতো কীটনাশক ব্যবহারের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য যেমন নষ্ট হচ্ছে, তেমনি ধ্বংস হচ্ছে মাটির উপকারী জীবাণুও। এখন সময় এসেছে জমিতে অর্গানিক পেস্টিসাইড বিশেষ করে প্রাকৃতিক নির্যাস ব্যবহার করে রোগ ও পোকা দমন করার। গবেষণায় দেখা গেছে, উৎপাদিত ফসল ২৮৩টি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়। এসব রোগের কারণেই উৎপাদিত মোট ফসলের ৩০ শতাংশই নষ্ট হয়ে যায়। অপরদিকে পৃথিবীর প্রাণীকুলের প্রায় ৮৫ শতাংশই কীটপতঙ্গ। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, রোগ ও পোকামাকড় দমন ফসল উৎপাদনের কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
যেসব উদ্ভিদে ওষুধ প্রস্তুত করা হয়, সেসব উদ্ভিদকে ভেষজ উদ্ভিদ বলা হয়। ভেষজ উদ্ভিদের গুণাগুণ নির্ভর করে সে উদ্ভিদে অবস্থিত অ্যালকায়েড বা উপক্ষারের ওপর। উপক্ষার হলো ভেষজ উদ্ভিদে অবস্থিত নাইট্রোজেনঘটিত জৈব রাসায়নিক পদার্থ। বিভিন্ন গাছের ছাল, পাতা, বীজ ইত্যাদি খাদ্যশস্যের সঙ্গে মিশিয়ে কীটপতঙ্গের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রাচীন পদ্ধতি এখনো অনেক দেশে বিদ্যমান। এসব গাছের অংশবিশেষ কীটপতঙ্গের উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্য সংরক্ষিত খাদ্যশস্যে মিশানো হয়ে থাকে। এ ছাড়া ল্যান্টানা, বিষকাটালী এবং নিশিন্দা পাতাও প্রতিরোধক হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে নিম বীজ প্রাকৃতিক কীটনাশক ওষুধ হিসেবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে এবং ভারতে এর সাহায্যে প্রস্তুত নিমবিন, নিমবিনিন এবং নিমবিডিন নামে তিনটি কার্যকর কীটনাশক ওষুধ বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আমাদের দেশেও নিমবিসিডিন নামে কার্যকর কীটনাশক বাজারে প্রচলিত আছে।
কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য অর্গানিক পেস্টিসাইড হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিকর্ষক হিসেবে গো-চোনার ব্যবহার আশার আলো জাগিয়েছে। চন্দ্রমল্লিকা ফুল থেকে পাইরিথ্রিন ইনসেক্টিসাইড তৈরি করা হয় যা সিনথেটিক পাইরিথ্রয়েড ইনসেক্টিসাইড হিসেবে বাজারে আছে। ভুট্টা এবং অন্যান্য ফসলের উইভিল, এফিড এবং ক্যাটারপিলার প্রতিরোধে ভেরেন্ডার তেল পানির সঙ্গে মিশিয়ে স্প্রে করলে কার্যকর ভূমিকা রাখে। উল্লেখ্য, ভেরেন্ডার খইলে রিসিন নামক বিষাক্ত পদার্থ বিদ্যমান যা পোকা দমনে কার্যকর। ইতিমধ্যে কাজুবাদামের নির্যাস মশার লার্ভার ওপর স্প্রে করে সফলতা পাওয়া গেছে। সম্প্রতি বীজবাহিত রোগ দমনে বীজ শোধনের জন্য অ্যালামান্ডা ট্যাবলেট আবিষ্কৃত হয়েছে। অনুরূপভাবে, মেহগনির নির্যাস, তামাকের গুঁড়া ও কা-ের রস, পাটের কা-ের ডাস্ট বা কা-ের নির্যাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক নির্যাস ধান, গম এবং অন্যান্য ফসলে প্রয়োগে পোকামাকড় দমনে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া গেছে। আগে বাংলাদেশে প্রতি হেক্টর জমিতে ৪৪ কেজি হারে কীটনাশক ব্যবহার করা হতো, ুবর্তমানে তা বেড়ে ২৫০ কেজিতে এসে দাঁড়িয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘদিন কীটনাশক ব্যবহার করতে গিয়ে দেশের অধিকাংশ কৃষক ও কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর এ ধরনের চিকিৎসায় দেশের কৃষকদের ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। তাই পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা এবং আর্থিক অপচয় রোধে অর্গানিক পেস্টিসাইড ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। এ বিষয়ে জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার ও গণমাধ্যমের পাশাপাশি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠান এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারে।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor