Tuesday, September 2, 2008

দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়ি শিল্পে কেরামত আলীর নতুন মডেল

ইত্তেফাক \ ২৯.০৮.০৮
।। রেজাউল করিম, খুলনা অফিস ।।

খাদ্যাভাবে যে এলাকার মানুষ এক সময় শাপলা ও ঢ্যাপ খেয়ে বছরের কয়েক মাস জীবন ধারণ করতো তারাই এখন সেখানে সাদাসোনা চিংড়ি ফলায়। এলাকাটির নাম বাগেরহাটের ফকিরহাট-মোল্লাহাট। চিংড়িকে ঐ এলাকার মানুষ বলে সাদা সোনা। কারণ ঐ এলাকার যে জমিতে কোন ফসলই ফলতনা সেই জমিতেই এখন চিংড়ি ফলে। এ চিংড়ি বিক্রি করে তারা আয় করে কাড়ি কাড়ি টাকা। তাদের উৎপাদিত চিংড়ি চলে যায় বিশ্বের বহু দেশে। সেখান থেকে বছরে আয় হয় শত-সহস্র কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। বাগেরহাটের সৈয়দ মহল্লা গ্রামের এক শিক্ষিত কৃষক সৈয়দ কেরামত আলী। ঐ এলাকার অনাবাদি জমিতে তিনি প্রথম চিংড়ি চাষ করে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেন। চিংড়ি চাষে তার অসাধারণ সাফল্যের খবর ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ার পর দক্ষিণাঞ্চলের শত-সহস্র কৃষক কেরামত আলীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে সচেষ্ট হন। অনেকেই অনাবাদি জমিতে চিংড়ি চাষ করে অপ্রত্যাশিত সাফল্য অর্জন করেন। ঐ অঞ্চলে কেরামত আলীকে বলা হয়ে থাকে চিংড়ি চাষের জনক।
বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে সৈয়দ মহল্লা গ্রামে সৈয়দ কেরামত আলীর বাড়ি। তার এ অসাধারণ সাফল্যের ইতিকথা জানতে কয়েকদিন আগে ঐ বাড়িতে গেলে ইত্তেফাকের এ প্রতিনিধির সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন। কেরামত আলী বর্ণনা করেন তার চিংড়ি চাষ কাহিনী। তিনি জানানঃ ১৯৭৭ সালে তিনি ঐ এলাকার গোদাড়া নামক স্থানের একটি জলাশয় লিজ নেন। তার আরো ২ জন ভাগিদারকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে সাদা মাছের চাষ শুরু করেন। পরের বছর তিনি ঐ জলাশয়ে প্রতিটি ১০ পাই (পয়সা) করে এক আঙ্গুল মত সাইজের ঝাট (ছোট) গলদা চিংড়ির পোনা ছাড়েন। পরীক্ষামূলকভাবে প্রথমবার তিনি প্রায় চার হাজার গলদার ঝাট সাদা মাছের খামারে অবমুক্ত করেন। নদীর পানিতে যদি গলদা হয় তবে জলাশয়েও তা হতে পারে এমন ধারণা থেকে তিনি কাজটি করেন। মাস পাঁচেক পর একবার জাল ফেলে দেখার চেষ্টা করেন যে, চিংড়ির সাইজ কেমন হয়েছে। কিন্তু জলাশয়ে জাল ফেলার পর একটি চিংড়িও সেখানে না পেয়ে তিনি রীতিমত হতাশ হয়ে পড়েন। তার ভাগিদাররা জলাশয়ে টাকা খরচ করে চিংড়ির পোনা ছাড়া নিয়ে তাকে কিছুটা হাস্যরসের কথা, বার্তাও বলেন। তাদের কথা শুনে কেরামত আলীর মনে হয় কী বোকামিই না করেছি। এভাবে বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়। জলাশয় থেকে ইতিমধ্যে একদফা সাদা মাছ ধরে বিক্রি করা হয়ে গেছে। কিন্তু জলাশয়ে কোন চিংড়ির সন্ধান মেলেনি। তখন তারা সবাই ধরেই নিয়েছেন যে, হয় চিংড়িগুলো একটু বড় হওয়ার পর জলাশয় থেকে বেরিয়ে নদীতে চলে গেছে অথবা অন্যকোন মাছের পেটে গেছে। হঠাৎ একদিন তাদের এক কর্মচারী মাছের খামারের শেষ মাথার কোণে গোলাকার মত একটি জায়গায় চিংড়ির লাল মোটা ঠ্যাং বা পা দেখতে পায়। দৌড়ে এসে সে তার মালিক কেরামত আলীকে বিষয়টি জানায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখানে গিয়ে কর্মচারীর কথার সত্যতা পান। দ্রুত জাল ফেলে বুঝতে চেষ্টা করেন যে সত্যিই চিংড়ি কিনা। জাল ফেলার পর তার সব ভাবনার অবসান ঘটে। বিরাট আকৃতির মোটা মোটা গলদা চিংড়ি জালে ভরে ওঠে। তখন তিনি বুঝতে পরেন অনেক গলদা আছে। জালে উঠে আসা সব চিংড়িই আবার জলাশয়ে ছেড়ে দেন।
ঘটনার দিন থেকে খামারে কড়া প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়। একই সাথে কঠোর গোপনীয়তাও। অলৌকিক এ সাফল্যের কথা অন্য কেউ জেনে গেলে অসুবিধা হবে ভেবে বিষয়টি ভাগিদার ছাড়া আর কাউকেই জানানো হয়নি। এরপর তিনি তার ভাগিদারদের নিয়ে এ চিংড়ি কোথায় বিক্রি করা যায় তা খোঁজা শুরু করেন। এ অঞ্চলে তখন কোথাও বাণিজ্যিকভাবে চিংড়ির বিকিকিনি হতো না। অনেক খোঁজাখুঁজি করে খুলনার খালিশপুরে একটি ব্যাঙ কেনার আড়তের সন্ধান পান তারা। সেখানে তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করার পর তারা চিংড়ি কিনতে সম্মত হয়। ৭০ টাকা সের দরে সেখানে চিংড়ি বিক্রি ঠিক হয়। কয়েক দফায় ঘের থেকে ধরে সেখানে চিংড়ি বিক্রি করে লক্ষাধিক টাকা আয় হয়। বাড়তি কোন পরিচর্যা ছাড়াই চিংড়ি উৎপাদনের এ সাফল্যে কেরামত আলী ও তার অংশীদারদের মনে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। চিংড়ি চাষের প্রতি তাদের উৎসাহ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। তখন সাদা মাছের চাষের প্রতি তাদের আগ্রহ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।
এর পরের বছর কেরামত আলী ফকিরহাটের ভিন্ন ভিন্ন স্থানে আরো বিঘা দশেক জমি নিয়ে ২টি ঘের তৈরি করে সেখানে চিংড়ি চাষ করেন। এভাবে শুরু হয় তার পথ চলা। দুই বছরের মধ্যে চিংড়ি চাষ করে তিনি বেশ কয়েক লাখ টাকা আয় করেন। তার এই সাফল্যের খবর আস্তে আস্তে ওই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। চিংড়ি চাষের পদ্ধতি জানার জন্য অনেকেই তার নিকট আসতে শুরু করেন। কিন্তু প্রথমদিকে তিনি তার সাফল্যের চাবি কাউকে দিতে চাইতেন না। এক সময় শিক্ষিত চাষী কেরামত আলীর মনে হয় বেশি বেশি চিংড়ি চাষ ও উৎপাদন হলে এলাকার মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন হবে। কারণ ঐ এলাকার কেন্দুয়া-কোদালিয়া নামে যে বিশাল বিল রয়েছে সেখানে তখন কোন ফসল হতো না। ফলে এলাকার মানুষের খাদ্যাভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। অনেকেই বিলে জন্মানো শাপলা ও তার ফলের বিচি (ঢ্যাপ) খেয়ে বছরের কয়েকমাস জীবনধারণ করতো। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য তিনি চিংড়ি চাষের পদ্ধতি আগ্রহী সবাইকে জানিয়ে দেন। তিন থেকে চার বছরের মধ্যে ঐ এলাকায় কয়েক হাজার ছোট-বড় চিংড়ি ঘের তৈরি হয়ে যায়। বছরে লাখ লাখ টাকা আয় করতে থাকে এলাকার চাষীরা। উক্ত এলাকাকে তখন অনেকে ‘ছোট কুয়েত’ বলে অভিহিত করতে থাকে। কুয়েতের মাটিতে যেমন তেল পাওয়া যায় তেমনি ঐ এলাকার মাটিতে মূল্যবান চিংড়ি উৎপাদিত হয় এমন ধারণা থেকে সবাই ঐ নামটি বলে।
সৈয়দ কেরামত আলী তার সাফল্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে আরো বলেন, চিংড়ি শুধু তার নয়, এলাকার হাজার হাজার মানুষের ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করেছে। মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। চিংড়ি চাষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন স্থাপনা। ঐ এলাকার গ্রামীণ জনপদের চেহারাও বদলে গেছে। সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। বেড়েছে তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাদ্যাভ্যাসও। কয়েক বছর আগে যারা সকালে একমুঠো পান্তাভাত আর কাঁচা মরিচ দিয়ে নাস্তা করতো তাদের অনেকেই এখন মোটরসাইকেলে করে নিকটস্থ কোন বাজারে গিয়ে পরোটা কিংবা রুটি দিয়ে নাস্তা করেন। যারা এক সময় অপরের বাড়ির কামলা হিসাবে কাজ করতো তাদের অনেকেই এখন চিংড়ি চাষ করে লাখ লাখ টাকা, বাড়ি, দোকান-পাটের মালিক হয়েছেন।
ব্যক্তিগত জীবনে কেরামত আলী চিংড়ি চাষ করে ৩০ একর জমি, দোতলা বাড়ি, মাছের ডিপো, ফিস মিলের মালিক হয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন পদক ও সম্মানের অধিকারী হয়েছেন সফল চিংড়ি চাষী হিসাবে। বিএ পাস করার পর থেকে তিনি বিভিন্ন ব্যবসার সাথে যুক্ত হন। ষাটের কোঠায় বয়সের এই চাষী স্বল্প পরিসরে হলেও এখনো চিংড়ি চাষ করেন। তিনি তার প্রথম খামারের চিংড়ি চাষ কখনো বন্ধ করবে না উল্লেখ করে বলেন, ঐ খামারটি তাকে সাফল্যের পথ দেখিয়েছিল। ঐ ঘেরটি তার কাছে লক্ষ্মী। চিংড়ি চাষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি জানান, লোনা পানির চিংড়ি চাষ মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাতে শুরু করেছে। ধান চাষ করে লাগসই প্রযুক্তির মাধ্যমে লোনা পানিতে চিংড়ি চাষ করতে হবে। দেশের খাদ্য সংকট মোকাবিলায় দক্ষিণাঞ্চলে ধান চাষের প্রতি মনোযোগী হওয়ার এখন সময় এসেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন ।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor