Tuesday, September 2, 2008

কয়রার ১৩২ সরকারি জলাশয়ে আইন ভেঙে তোলা হচ্ছে লোনা পানি

২৪.০৮.০৮ l যায়যায়দিন
ম মামুন রেজা, খুলনা

‘কয়েক বছর আগেও লোকজন কয়রায় ধান কাটতে আসত। আর এখন চিংড়ি চাষজনিত লবণাক্ততার কারণে ধান উৎপাদন কমে যাওয়ায় এখানকার লোকজন ধান কাটতে যায় বাইরের এলাকায়। সরকারি খাল ও জলাশয়গুলো লিজ নিয়ে একশ্রেণীর প্রভাবশালী লোক সেখানে লবণ-পানি উত্তোলন করায় পার্শ্ববর্তী হাজার হাজার বিঘা জমিতে ফসল ফলানো যাচ্ছে না। অথচ লিজ নেওয়ার শর্তে রয়েছে এসব জলাশয়ে লবণ-পানি ঢোকানো যাবে না। এর আরেক অর্থ চিংড়ি চাষ করা যাবে না, কারণ চিংড়ি চাষে লোনা পানির প্রয়োজন পড়ে। অন্যদিকে লবণ পানি উঠানোর প্রতিবাদ করলে লিজ গ্রহণকারী প্রভাবশালী মহলগুলোর হামলা-মামলার শিকার হতে হয়।’ সরকারি খাল ও জলমহালে লবণ-পানি তোলার ফলে সৃষ্ট নানা সমস্যার কথা এভাবেই বর্ণনা করলেন সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলার কাঠমারচর গ্রামের বাসিন্দা মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবীর। তার ক্ষোভের অনুরণন শোনা যায় গোটা কয়রা উপজেলাতেই। লবণ-পানির নীরব অথচ নির্মম আগ্রাসনে কয়রা উপজেলার কৃষকদের প্রতিটি দিন কাটছে এখন দিশেহারা অবস্থ’ায়। ঘের ও খালের লবণ-পানি চুইয়ে চুইয়ে পার্শ্ববর্তী ফসলি জমিতে চলে যাচ্ছে। লবণ-পানির কারণে পার্শ্ববর্তী এসব জমিতে কৃষকরা ধান বা শাক সবজির আবাদ করতে পারছেন না। একই কারণে খালের পার্শ্ববর্তী জমির গাছপালাও লাল হয়ে মরে যাচ্ছে। এমনকি লবণ-পানি খেয়ে খেয়ে গবাদি পশু মারা যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। হাঁস-মুরগি বিলীন হওয়ার পথে। মানুষও পেটের পীড়াসহ বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। লবণ-পানির চিংড়ি চাষ প্রতিরোধসহ পরিবেশ রক্ষার দাবিতে বিগত কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করছে কয়রা উপজেলা মানবাধিকার জোট। জোটের সভাপতি আ ব ম আবদুল মালেক জানান, কয়রা উপজেলার ১৩২টি খাল ও জলমহাল সরকার কর্তৃক ব্যক্তিমালিকানায় লিজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু লিজ গ্রহীতারা লিজের শর্ত ভঙ্গ করে লবণ পানিতে মৎস্য চাষ করার ফলে একদিকে এলাকায় খাবার পানির অভাব দেখা দিয়েছে অন্যদিকে লিজ দেওয়া জলাশয়ের পার্শ্ববর্তী জমিতে ধানসহ অন্য কোনো ফসলও ফলানো যাচ্ছে না। বিষয়টি স্থ’ানীয় প্রশাসনকে বারবার জানানো হলেও তারা কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে। তিনি জানান, উপজেলার ৮ হাজার ৫১২টি পুকুরের মধ্যে অধিকাংশ পুকুরেই লবণ-পানি প্রবেশ করায় খাবার ও ব্যবহƒত পানির ব্যাপক সংকট দেখা দিয়েছে। আর মানবাধিকার জোটের তথ্য মতে, বর্তমানে কয়রায় সরকারি আইন অমান্য করে প্রায় ৪ হাজার ঘেরে লোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ হচ্ছে।
কয়রা উপজেলার বড়বাড়ী গ্রামের জ্যোতিষ কুমার সরকার বলেন, পাথরখালী খালে লবণ-পানি তোলার ফলে প্রায় ২ হাজার বিঘা জমিতে ধানসহ অন্যান্য ফসলের আবাদ করা যাচ্ছে না। ৪ নল্ফ^র কয়রা গ্রামের রুহুল আমিন বলেন, এলাকায় আগে অনেক গবাদি পশু ছিল। এখন কমে গেছে। উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সরদার মতিয়ার রহমান বলেন, খালের লবণ পানি কেরোসিনের মতো চুইয়ে চুইয়ে পার্শ্ববর্তী জমিতে চলে যায়। লবণাক্ততার কারণে পাকা ভবনগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
কয়রা উপজেলা মানবাধিকার জোটের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক বলেন, খাল ও জলাশয়গুলোতে লবণ পানি তোলা এবং লবণ পানির চিংড়ি ঘেরের কারণে কয়রার অনেক এলাকা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের অধিকাংশ স্থ’ানে ফসল হয় না। সেখানকার অনেক লোক বেকার হয়ে গেছে। অনেকে ভারতে চলে গেছে। লোনা পানির আগ্রাসনে এখন মিঠা পানির মাছ পাওয়া যায় না বললেই চলে। এ অবস্থ’ায় কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ২০০৬ সালের ২২ মার্চ খাল-জলাশয়ের লিজ প্রথা বাতিলের দাবিতে স্মারকলিপি পেশ এবং ওই বছর ১৮ জুন মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের ভাগবার খালে লবণ-পানি উত্তোলন বন্ধের জন্য এলাকাবাসী লিখিত আবেদন করেন। চলতি বছরে ২২ ফেব্র“য়ারি দেওলিয়া খাল, নুরো হারা খাল ও অর্জুন খালের ইজারা বাতিলের জন্য মহারাজপুর ইউনিয়নের বাসিন্দারা উপজেলা জলমহাল টেন্ডার কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করেন। গত ১৬ এপ্রিল উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নবাসী কাটাখালী খাল, কাটকাটা খাল, দেওয়ানখালী, পুঁটিঘেরী খাল ও পাথরখালী খালের এবং গত ১২ মে মহারাজপুর ইউনিয়নের অর্জুন খালে অবৈধভাবে লোনা পানি উত্তোলনের প্রতিকার চেয়ে এলাকাবাসী এ আবেদন করেন। এছাড়া লবণ-পানি প্রতিরোধে কয়রার সব জলমহালের ইজারা বাতিলের দাবিতে গত ৫ জুন মানবাধিকার জোট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে স্থ§ারকলিপি পেশ করে। ওই স্মারকলিপিতে বলা হয়, পাউবোর বেড়িবাঁধ কেটে বা ছিদ্র করে অবাধে ফসলি জমিতে লবণ-পানি ঢোকানো হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, জলাশয় লিজ দেওয়ার নিয়ম হচ্ছে সেখানে পানিপ্রবাহে বাধা এবং লবণ-পানি প্রবেশ করানো যাবে না। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এমএম আরিফ পাশা সমকালকে বলেন, লিজ দেওয়া খালে লবণ পানি তোলার ব্যাপারে লিখিত সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থ’া নেওয়া হয়ে থাকে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন লিজ গ্রহীতাকে ডেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor