Tuesday, September 2, 2008

জলবায়ু পরিবর্তনে বদলে যাওয়া পরিবেশ

ইত্তেফাক \ ২৩.০৮.০৮
আতিউর রহমান

কিছুদিন আগেও জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি সাধারণ মানুষকে এতোটা ভাবাতো না। মূলত বিশেষজ্ঞদের গবেষণা ও কথাবার্তার সীমিত পরিসরেই এ নিয়ে উদ্বেগ পরিলক্ষিত হতো। কিন্তু হঠাৎ করেই গত ক’বছরে সারা বিশ্বেই দুর্যোগ দুর্বিপাকের সংখ্যা ও ব্যাপ্তি বেড়ে যাবার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে ভাবনার গণ্ডি মনে হয় বিস্তৃত হয়েছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পরিবেশ নেতা আল গোর এবং জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তঃসরকারি কমিটি বা আইপিসিসিকে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরষ্কার দেবার পর এ নিয়ে নীতি নির্ধারক ও সাধারণ মানুষের মাঝে আগ্রহ বেশ বেড়েছে। বিশেষ করে গণমাধ্যম বিষয়টিকে খুবই দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া সর্বশেষ বালীতে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবার পর থেকেই দেশে দেশে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে অনেক বেশি কথাবার্তা হচ্ছে। মাত্র ক’দিন আগে ঢাকাতেই দক্ষিণ এশীয় পরিবেশ মন্ত্রীদের জলবায়ু বিষয়ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাতে জর্জরিত দেশগুলোর প্রথম সারিতে রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বলা হয়ে থাকে আবহাওয়া উষ্ণ হবার কারণে সমুদ্রের উপরিভাগ স্ফীত হয়ে উঠবে এবং সে কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিরাট অংশ লোনা পানির নীচে তলিয়ে যাবে। তৈরি হবে এক মানবিক বিপর্যয়। বিপুল সংখ্যক বিপন্ন মানুষ তখন জলবায়ু শরণার্থী হয়ে যাবে। অথচ তাদের এই দুর্দশার কারণ কিন্তু তারা নয়। উন্নত বিশ্বের অপরিণামদর্শী জীবনচলার মাশুল গুনতে হবে বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের দুঃখী মানুষকে। উন্নত দেশের ধনী মানুষেরা নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ানোর যে আত্মবিধ্বংসী পথ বেছে নিয়েছে তার মূল্য এখন আমাদের গুনতে হচ্ছে। চীন, ভারত, বা ব্রাজিলের মতো অগ্রসর উন্নয়নশীল দেশের এলিটরাও জীবনচলার একই পথ বেছে নিয়েছেন। আমাদের এলিটদের একাংশও একই পথের যাত্রী হতে দ্বিধা করছেন না। ভোগবাদী এই জীবন চলার এবং প্রচলিত শিল্পায়নের চাপ গরিব দেশের গরিব মানুষকেই বেশি করে বইতে হচ্ছে। তার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি আমাদের উপকূল হাওর, চরাঞ্চল বদলে যাবার চিত্র থেকে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকার প্রকৃতির মতিগতি দ্রুতই বদলে যাচ্ছে। মানুষের বেঁচে থাকার সুযোগগুলো দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে। প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল গরিব মানুষের দুঃখ ও দারিদ্র্য দুইই বাড়ছে। কখনও বন্যা, কখন সিডরের মতো ভয়ঙ্কর ঝড়, নিরন্তর নদী ভাঙন, দীর্ঘস্থায়ী খরা মানুষ, পশু, পাখি ও বৃক্ষের জীবনকে করছে বিপন্ন। এসবই যে জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে হচ্ছে সাধারণ মানুষ তা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না। তবে তারা এতটুকু বুঝতে পারছে যে তাদের চারপাশের পরিবেশ ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। গত তিরিশ বছর ধরে এসব অঞ্চলের কৃষকদের জমির উৎপাদনশীলতা কমেছে, জেলেদের মাছ ধরার পরিমাণ কমেছে, নদী ভাঙনের হার বেড়েছে, সর্বত্র জীববৈচিত্রের ধারা বদলেছে, মানুষের আয় রোজগারের সুযোগ কমেছে, মানুষের স্থানান্তরের মাত্রা কমেছে, সমাজে অশান্তি বেড়েছে এবং কতিপয় মানুষ ছাড়া আর সবাই আগের চেয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। রোগ-শোকের পরিমাণ বেড়েছে। বনাঞ্চল উজাড় হয়েছে। লোনা পানির দাপট বেড়েছে। এসব সংকট মানুষকে দারুণ হতাশ করে ফেলেছে। বাঁচার জন্য মানুষ নতুন ধানের সন্ধান করতে গিয়ে পুরোনো ধানের বীজ হারিয়ে ফেলেছে। চিংড়ি চাষ প্রকৃতিকে বিপন্ন করে ফেলেছে।
এমন আরো অনেক ধরনের পরিবর্তন আমরা মানুষের জীবনচলা ও প্রকৃতির মেজাজ-মর্জিতে লক্ষ্য করছি। এই পরিস্থিতিতে মানুষ সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখে। তবে সেই অবস্থাকে বাস্তবে রূপায়ন করতে হলে নানা পর্যায়ে আমাদের কাজ করতে হবে। আগামী ১০ সেপ্টেম্বর লন্ডনে বৃটিশ সরকারের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা সংক্রান্ত বড় ধরনের এক সম্মেলন। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিসহ অ-সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরাও সেখানে অংশগ্রহণ করবেন বলে শোনা যাচ্ছে। আশা করছি এ সম্মেলনটির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা সংক্রান্ত বেশ কিছু সুপারিশ উঠে আসবে এবং আমাদের নীতিনির্ধারকরাসহ সকলেই একযোগে খুব জোরেসোরেই কাজ শুরু করবেন। এভাবেই বিশ্ব পরিসরে গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা কমানো বা নিষিদ্ধ করার আন্দোলনকে সমর্থন যেমন করতে হবে, তেমনি দেশের ভেতরেও উন্নয়ন নীতিমালায় জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে মূলধারায় আনতে হবে। স্থানীয় কমিউনিটিকে সঙ্গে নিয়ে এই বিপর্যয়কে ঠেকানো ও নতুন ধারার জীবনচলার পক্ষে বিপুল সম্পদ ও বিকল্প শক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনি গড়ে তোলা, নবায়নযোগ্য শক্তির (সৌর, বায়ু, জৈব) বিকাশ ও ব্যবহার বৃদ্ধি করা, স্থানীয় উদ্যোসমূহকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলার মতো নীতি ও কর্ম উদ্যোগ আমাদের নিতে হবে। একই সঙ্গে ভুক্তভোগী জনগণকে এসব উদ্যোগের মর্মার্থ বোঝাতে হবে এবং সকল প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। যে যেখানেই থাকুন না কেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে অনুভব করুন এবং সম্মিলিতভাবে এর ক্ষতিকর দিক থেকে রক্ষা পাবার পথ খুঁজে বের করুন।
[লেখক: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ]

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor