Tuesday, September 2, 2008

থাইল্যান্ডের ভেনামির কাছে মার খাচ্ছে বাংলাদেশের বাগদা

1.9.08 যায়যায়দিন
সুনীল দাস বাগেরহাট
ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ির চাহিদা ও দাম উভয়ই কমে গেছে। বিশেষ করে ছোট আকারের ৪০ থেকে ৬০ গ্রেডের চিংড়ির দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে। অন্যদিকে দিন দিন বেড়ে চলেছে থাইল্যান্ডে উৎপাদিত বাগদা চিংড়ির নতুন প্রজাতি ‘ভেনামি’র চাহিদা ও দাম উভয়ই। আকারে কিছুটা ছোট এ ভেনামি (চ. ঠধহহধসবর) জাতের চিংড়ির তুলনামূলকভাবে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বেশি, ভাইরাস সংক্রমণমুক্ত এবং খেতে সুস্বাদু হওয়ায় এর চাহিদা ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে দিন দিন বাড়ছে। ফলে থাইল্যান্ডের চিংড়িচাষীরা দ্রুত বাগদা চিংড়ির পরিবর্তে হেক্টরপ্রতি উৎপাদনের প্রায় পাঁচগুণ বেশি উৎপাদনক্ষম ভেনামির দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। আর বাংলাদেশের বাগদাচাষীরা হেক্টরপ্রতি কম উৎপাদন এবং বিশ্ববাজারে দাম কমে যাওয়ায় চরম ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। বিশ্ববাজারে নতুন সম্ভাবনাময় ভেনামির উৎপাদন এবং দাম উভয় ক্ষেত্রেই মার খাচ্ছে বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ির বাজার।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে বাগদা চিংড়ি বিশেষ করে ছোট আকারের ৪০ থেকে ৬০ গ্রেডের চিংড়ির দাম একেবারে নেই বললেই চলে। গত বছরের তুলনায় প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে। এর ফলে স্থানীয় বাজারেও ২০০৭ সালে যেখানে প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৬০ গ্রেডের চিংড়ির দাম ছিল ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকা সেখানে এবার মৌসুমজুড়ে তার দাম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় নেমে এসেছে। ফলে দেশে প্রচলিত বাগদা চাষের পরিবর্তে উন্নত প্রজাতির ও বিশ্ববাজারের উচ্চ চাহিদার ‘ভেনামি’র চাষকে বাংলাদেশের চিংড়িচাষীদের মধ্যে প্রবর্তন এবং সম্প্রসারণের বিষয়ে এখনই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া জ রুরি। তা না হলে দেশের দ্বিতীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী চিংড়ি সেক্টরে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন। হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারক, মৎস্য অধিদপ্তর, চিংড়ি সেক্টরের উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে কর্মরত সংস্থাগুলো সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। শনিবার বিকালে বাগেরহাটে মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন অভিযানের সমাপনী অনুষ্ঠানে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. নিত্যানন্দ দাস সম্প্রতি তার থাইল্যান্ডের ‘ভেনামি’ খামার পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বিষয়টি তুলে ধরেন।
বাগদার সঙ্গে ভেনামির তুলনামূলক বৈশিষ্ট্য ও চাষ থেকে উৎপাদন বিভিন্ন বিষয়ের কথা তুলে ধরে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করে ভেনামিকে বর্তমান বিশ্ববাজারে এবং চাষীদের জন্য লাভজনক বিবেচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বাগদা চিংড়ির সাইজ ৩৫-৪০ গ্রাম কিন্তু ভেনামির সাইজ ২০-২৫ গ্রাম। ফলে ছোট বাগদা যেটি ৪০-৬০ গ্রেডের ছিল তার সঙ্গেই মূলত ভেনামির প্রতিযোগিতা চলছে। উৎপাদনের ক্ষেত্রে বাগদা যেখানে প্রতি স্কয়ার মিটারে ৬-১০ পিস মজুদ করা যায়, সেখানে ভেনামি ১৫০ থেকে ৩০০ পিস পর্যন্ত মজুদ করা যায়। বাগদার গরম আবহাওয়া সহিষ্ণু ক্ষমতা ২৭-৩২ সেন্টিগ্রেড হলেও ভেনামির ১৬-৩৬ সেন্টিগ্রেড। বাগদা চিংড়ি চাষের পর আহরণের সময়কাল ১২০-১৫০ দিন হলেও ভেনামি মাত্র ১০০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে সংগ্রহ করা যায়। বাগদার লবণাক্ততা সহনীয় মাত্রা ১০-৩৫ পিটি হলেও ভেনামির ক্ষেত্রে তা ৫-৪০ পিপিটি। বাগদার কোনো প্রকার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই, অন্যদিকে টিএসভি ও আইএইচএইচএনভি জাতীয় রোগ-জীবাণু প্রতিরোধের ক্ষমতা ভেনামির রয়েছে। ফলে বাগদাচাষীরা প্রতি বছর ভাইরাসসহ বিভিন্ন রোগের কারণে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। বাগদার পোনার সারভাইভাল রেট মাত্র ২০-৩০ শতাংশ; কিন্তু ভেনামির পোনার সারভাইভাল রেট ৫০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত। বাগদা চিংড়িকে হোমস্টেডে পুুকুরে সংরক্ষণ করা যায় না। কিন্তু ভেনামিকে হোমস্টেডে পুুকুরে জেনেটিক সিলেকশনে এসপিএফ ও এসপিআর করা সম্ভব। সর্বোপরি বাগদার উৎপাদন হেক্টরপ্রতি সর্বোচ্চ ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার কেজি; সেখানে ভেনামির উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার কেজি। কম জমিতে বেশি উৎপাদন, ভাইরাস সংক্রমণমুক্ত হওয়ার কারণে থাইল্যান্ডের ভেনামিচাষীরা তাদের উৎপাদিত চিংড়ি কম মূল্যে বিক্রি করেও লাভবান হচ্ছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে কম উৎপাদন হওয়ায় এখানকার চাষীরা কম দামে বিক্রি করতে পারেন না। ফলে বিশ্ববাজারে বাগদার চাহিদা দিন দিন কমছে এবং দামও ভেনামির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমে যাচ্ছে। ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন আমাদের দেশের বাগদা চিংড়িচাষীরা।
হিমাংিত চিংড়ি রপ্তানিকারকদের সূত্রে জানা গেছে, থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স ও ইন্দোনেশিয়ার ছোট আকারের ভেনামি কম দামে বিক্রি হওয়ার কারণে বাগদার চাহিদা আগের তুলনায় কমে গেছে; বিশেষ করে ছোট আকারের যে বাগদা ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হতো। একই সাইজের ভেনামি থাইল্যান্ডসহ অন্য দেশগুলো কম দামে দেয়ায় বাংলাদেশ থেকে ছোট আকারের বাগদা কিনতে বিদেশিরা অনীহা প্রকাশ করায় দামও কমে গেছে। কাজেই প্রচলিত বাগদার পরিবর্তে ভেনামির মতো অধিক উৎপাদনক্ষম এবং সুস্বাদু জাতের চিংড়ি চাষের কথা ভাবতে হবে। তা না হলে বিদেশের বাজারে বাগদার বাজার চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে। হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানিকারকদের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. বেলায়েত হোসেন জানান, ছোট আকারের বাগদা চিংড়ি বিশেষ করে ৪০-৬০ গ্রেডের চিংড়ির দাম বিদেশের বাজারে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। থাইল্যান্ডের নতুন প্রজাতির একটি চিংড়ি কম দামে বিক্রি হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কাজেই আমাদের নতুন, উচ্চ উৎপাদনক্ষম এবং ভাইরাসের সংক্রমণমুক্ত ‘ভেনামি’র কথা বিবেচনা করে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আধুনিক ও উন্নত প্রযুক্তির যুগে চিংড়ি সেক্টরে আমরা আধুনিকায়ন করতে না পারলে পিছিয়ে পড়বো। ফলে থাইল্যান্ড, ফিলিপিন্স ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের কাছে একসময় আমরা প্রতিযোগিতায় মার খেতে বাধ্য হবো। থাইল্যান্ড যে দামে ভেনামি চিংড়ি বিক্রি করছে সে রকম দাম হলে আমাদের চাষীরা নিঃস্ব-রিক্ত হবেন, পথে বসবেন। আমরাও বিশ্ববাজার হারাবো। চরম বিপর্যয় ও হুমকির মুখে পড়তে পারে আমাদের দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। বাগেরহাটের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. নিত্যানন্দ দাস জানান, তিনি কিছুদিন আগে থাইল্যান্ডের কয়েকটি (১০টি) ভেনামি চিংড়ি খামার পরিদর্শন করেন। সেখানে চিংড়ি পোনা মজুদ, খাদ্য সরবরাহ, তাপমাত্রার সহনীয় ক্ষমতা, লবণাক্ততার মাত্রা, চাষ থেকে আহরণের সময়ের যে ব্যবধান লক্ষ্য করা গেছে তাতে বাগদার তুলনায় ভেনামি বেশি লাভজনক। আমরা ছোট আকারের বাগদা চাষে মনোনীবেশ না করে বড় আকারের বাগদার দিকে বেশি বেশি নজর দিতে পারি। তাহলে লাভবান হবো। এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, ভেনামির বিষয়ে অনেক নেগেটিভ-পজেটিভ তথ্য আছে। এটি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের ব্যাপার। তবে ভেনামি প্রজাতির চিংড়িকে বাংলাদেশে পরিচিত করা বা চাষের অনুমোদন দেয়া হবে না মর্মে মৎস্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor