Wednesday, September 3, 2008

উপকরণের দাম অস্বাভাবিক, আখচাষে কৃষকদের অনাগ্রহ চিনিশিল্প হুমকির মুখে : দেড় কোটি লোক কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কা

০২.০৯.০৮

।। ডেসটিনি ।। শফিকুল ইসলাম

দেশে ক্রমান্বয়ে আখচাষির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কৃষক। সার, কীটনাশকসহ অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি, অলাভজনক ও দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় কৃষকরা আখের আবাদ ফেলে স্বল্পমেয়াদি ও লাভজনক অন্য ফসল চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষকরা আখের আবাদ বন্ধ করে দিলে দেশের চিনিশিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় দেড় কোটি লোকের কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে পাটশিল্পের মতো চিনিশিল্প ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ আখচাষি ফেডারেশনের সভাপতি আলহাজ শাহজাহান আলী ওরফে পেপে বাদশা জানান, আগামীতে ২০০ টাকা কেজি চিনি কিনতে হবে। তিনি আরও বলেন, পাটশিল্পের মতো চিনি শিল্পকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পরামর্শে কৃষি উপকরণের দাম বাড়িয়ে চিনিশিল্পসহ কৃষিখাতকে ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে। চিনিশিল্পের সঙ্গে প্রায় দেড় কোটি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত উল্লেখ করে তিনি বলেন, চিনিশিল্প ধ্বংস হলে এদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। চিনিশিল্পকে রক্ষায় আখচাষ টিকিয়ে রাখতে অন্তত প্রতিমণ আখের জন্য কৃষককে ৮০ টাকা দাম দেয়া উচিত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক কৃষিবিদ ইব্রাহিম খলিল জানান, কৃষককে আখচাষে উৎসাহিত করতে এবং চিনিশিল্পক টিকিয়ে রাখতে আখের ভালো জাত উদ্ভাবন করতে হবে। এ বিষয় নিয়ে ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটকে ভাবতে হবে। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার খরচ কমাতে বেশি করে সহায়ক ভূমিকা রাখতে সরকারকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। কৃষকদের আখচাষ ধরে রাখতে সাথি ফসলের চাষ বৃদ্ধিতে একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বাংলাদেশ চিনি ডিলার অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল জানান, কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় আখচাষের খরচ অনেক বেশি পড়বে। চাষিদের ক্ষতি পোষাতে মণপ্রতি কমপক্ষে ১০ টাকা
বাড়ানো উচিত বলে তিনি মনে করেন। তা না হলে আখচাষে কৃষকরা অনুৎসাহিত হবে। এতে চিনির দাম অনেক বাড়বে।
জানা গেছে, সার, কীটনাশক ও ডিজেলের দাম বাড়ায় আখচাষে বর্তমানে একরপ্রতি ১১ হাজার ৬৬৯ টাকা খরচ বেড়েছে। আগে প্রতি একরে খরচ ছিল ৩১ হাজার ৬৬৯ টাকা। এবছর একরপ্রতি খরচ হবে ৪৩ হাজার ১৮৪ টাকা। এ হিসেবে উৎপাদিত আখে মণপ্রতি গত বছর খরচ ছিল ৩৯.২১ টাকা। এবছর প্রতিমণ আখ উৎপাদনে খরচ পড়বে ৫৩.৭৩ টাকা। এ মাস থেকে আখ রোপণের মৌসুম শুরু হচ্ছে। কিন্তু সার ও কীটনাশকসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বেশি হওয়ায় এবছর আখের আবাদ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
আখ উৎপাদনসহ মাড়াই পর্যন্ত ১৬ থেকে ১৮ মাস সময় লাগে। ওই একই সময়ের মধ্যে ধান, গম, তেল, ডাল জাতীয় ফসল অথবা ধান, ভুট্টা, তেল এবং ডাল জাতীয় ফসলের ৩টি আবাদ করা যায়। এতে ১ একর জমিতে সব খরচ বাদ দিয়ে বছরে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা কৃষকের লাভ থাকে। অন্যদিকে আখচাষ করে বছরে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এজন্য কৃষকরা ধীরে ধীরে আখচাষ কমিয়ে অন্য ফসলের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।
খাদ্য ও চিনিশিল্প করপোরেশনের সচিব মো. লুৎফর রহমান খান জানান, বর্তমান সরকারি দাম রয়েছে মণপ্রতি ৫৩ টাকা। এ বছর প্রতিটন আখচাষে খরচ পড়বে ৩৬ হাজার টাকা থেকে ৩৯ হাজার টাকা। কিন্তু কৃষকের কাছ থেকে দাম নির্ধারিত রয়েছে ৩১ হাজার টাকা। আখচাষে যাতে বিরূপ প্রভাব না পড়ে সেজন্য চিন্তাভাবনা চলছে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে। কৃষি উপকরণের দাম বেড়ে যাওযায় আখের দাম মণপ্রতি ৫ টাকা বাড়ানোর জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আখের দাম বাড়ানো হলে কৃষকরা উৎসাহিত হবে। তিনি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের পক্ষ থেকে আখচাষিদের ধরে রাখার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে এবছর আখচাষিদের জন্য ২৭২ কোটি ৬৯ লাখ ৭১ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
গত বছর আখচাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ২৭ হাজার ৫০০ একরে। এরমধ্যে চূড়ান্তভাবে অর্জিত হয় ২ লাখ ৪ হাজার ৪২৭ একর। আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪১ লাখ ৯২ হাজার ৪৪ মেট্রিক টন। এর মধ্যে অর্জিত হয় ২২ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন আখ মিলে সরবরাহের বাজেট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ থেকে ৭ দশমিক ৬২ ভাগ চিনি আহরণ হারে ১ লাখ ৭৩ হাজার ১০০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, প্রতিবছর আখচাষে ইউরিয়া প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন, টিএসপি ১২ হাজার মেট্রিক টন এবং এমওপি ১২ হাজার মেট্রিক টন প্রয়োজন হয়। গত বছর ৪ হাজার ৮০০ টাকা প্রতি মেট্রিক টন ইউরিয়া এবছর ১০ হাজার ৭০০ টাকা হয়েছে। গত বছর টিএসপি ভর্তুকি মূল্যে জেলা সার মনিটরিং কমিটির কাছ থেকে প্রতি মেট্রিক টন ১৯ হাজার ৫০০ টাকায় কেনা হয়। এবছর তা ৭২ হাজার থেকে ৭৪ হাজার টাকা হয়েছে। এমওপি গত বছর বিএডিসি থেকে ১৫ হাজার ৪৯১ টাকা, পরে দাম বেড়ে হয় ৩৫ হাজার টাকা প্রতি মেট্রিক টন। এবছর টেন্ডারের মাধ্যমে এমওপি ৬০ হাজার টাকা দামে প্রতি মেট্রিক টন কিনতে হচ্ছে।
চলতি মৌসুমে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে আখচাষের জন্য ইউরিয়ার চাহিদা নিরূপণ করা হয়েছে ২১ হাজার ১৮৫ মেট্রিক টন, টিএসপি ১৩ হাজার ৬৯৯ মেট্রিক টন ও এমওপি ১২ হাজার ৮৮৭ মেট্রিক টন। এর বিপরীতে মন্ত্রণালয়ে প্রাথমিকভাবে চাওয়া হয় ইউরিয়া ২০ হাজার মেট্রিক টন, টিএসপি ১৪ হাজার মেট্রিক টন ও এমওপি ১৩ হাজার মেট্রিক টন। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় ইউরিয়া ১৬ হাজার মেট্রিক টন, টিএসপি ১২ হাজার মেট্রিক টন ও এমওপি ১২ হাজার টন বরাদ্দ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সূত্র জানায়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত এই বরাদ্দ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের কাছে এসে পৌঁছেনি। বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনিশিল্প ঋণী আখচাষির সংখ্যা ৮০ হাজার ও অঋণী চাষির সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মো. শামছুল আলম দৈনিক ডেসটিনিকে জানান, ক্ষতি পোষাতে এবং লাভবানজনক করতে আখক্ষেতের মধ্যে আন্তঃফসল চাষের জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আখক্ষেতে আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ডাল ও তেল জাতীয় ফসলের আবাদ করে দ্বিগুণ লাভ করা সম্ভব। তিনি জানান, কৃষি অধিদফতর এ ব্যাপারে চাষিদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করছে। উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অনেক কৃষক আখের মধ্যে আন্তঃফসল আবাদ করে লাভবান হচ্ছেন।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor