Friday, January 30, 2009

সার সংকট নিরসনে আশার আলো

৩০.০১.০৯
ডেসটিনি ।। ইয়াসরেমিনা বেগম সীমা

বিশ্ব বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য সহনীয় রাখার জন্য খাদ্য উৎপাদনের বিকল্প নেই একথা সবাই স্বীকার করে নিয়েছে। পাশাপাশি এও স্বীকার করেছে উৎপাদন সামগ্রীর মূল্য না কমালে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব নয়। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সব ধরনের কৃষি উপকরণের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি জমি কমে যাওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানি প্রভৃতি কারণে বিশ্বজুড়েই চলছে খাদ্য সংকট। আর এ সমস্যা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন অল্প জমিতে অধিক উৎপাদন। আর এই অধিক উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন উন্নতমানের বীজ এবং রাসায়নিক নাইট্রোজেন সার। গত শতাব্দীতে পৃথিবীতে মানুষ বেড়েছে প্রায় ৫০০ কোটি। এই বর্ধিত জনগোষ্ঠীর জন্য অতিরিক্ত খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে কেবল উন্নতমানের বীজ, সেচ, আধুনিক চাষাবাদ আর নাইট্রোজেন সারের গুণে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ইন্টারন্যাশনাল ফার্টিলাইজার ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে সারের ব্যবহার বেড়েছে ৩১ শতাংশ আর বাংলাদেশে বেড়েছে ৪০ শতাংশ। বাংলাদেশে ’৮০’র দশকের শুরুতে বছরে সারের ব্যবহার ছিল প্রায় ১০ লাখ টন; বর্তমান দশকের শুরুতে প্রায় ৩৩ লাখ টনে পৌঁছায়; বর্তমানে এই চাহিদা প্রায় ৪০ লাখ টনের কাছাকাছি।
স¤প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে বর্তমানে বাংলাদেশে কৃষিখাতে সারের চাহিদা ৩২ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদিত হয় ১৫ লাখ টন। বিদেশ থেকে আমদানি করে অবশিষ্ট চাহিদা পূরণ করা হয়। আমদানি করা হয় এমওপি ও জিঙ্ক পুরোটা, ৮০-৯০ শতাংশ টিএসপি এবং ১০-২৫ শতাংশ ইউরিয়া। ফসলের উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারের উৎপাদন ও আমদানি দুটোই বেড়েছে। আশির দশকের শুরুতে দেড় কোটি টন খাদ্যশস্যসহ তিন কোটি টন ফসল উৎপাদনে হেক্টরপ্রতি ৭০ কেজি সার ব্যবহার হয়েছে আর ২০০০ সালের শুরুতে প্রায় তিন কোটি টন খাদ্যশস্যসহ পাঁচ কোটি টন ফসল উৎপাদনে হেক্টরপ্রতি সারের ব্যবহার দাঁড়িয়েছে ২৭০ কেজি। এ হিসাবে বলা যায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের জন্য সারের ব্যবহার ভবিষ্যতে বাড়বে বই কমবে না এবং খাদ্যদ্রব্যের দামও গগনচুম্বী হবে। সরকার খাদ্যদ্রব্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার তাগিদে অব্যাহতভাবে সারে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র ইউরিয়া সার আমদানিতেই সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয় ২ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়াও দেশে যে ১৫ লাখ টন সার উৎপাদন হয়, সেই সারও ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের কাছে পৌঁছানো হয়। এ ক্ষেত্রে ভর্তুকি বাবদ সরকারের খরচ হয় আরো ৩ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এ খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয় ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ’৮০’র দশকের শেষে এবং ’৯০’র দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে যে সার উৎপাদিত হতো- সেই সার দিয়ে দেশের চাহিদা সম্পূর্ণ মিটানো যেত। কিন্তু এরপর চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু দেশে কোনো নতুন সার কারখানা স্থাপন করা হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে সদ্য বিদায় নেয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিভিন্ন প্রকার সারের দাম দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে। দাম বৃদ্ধি হলেও সার হয়ে যায় আক্রা। সারের দাবিতে মিছিল, সড়ক অবরোধ, পুলিশের লাঠিচার্জ সবই সমানতালে চলতে থাকে। টাকা দিয়েও যখন সার পাওয়া যাচ্ছিল না তখন জৈবসার, গুটি ইউরিয়ার ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিকল্প সারের ব্যবহার মানুষ খুঁজতে থাকে। এ সময়ে জৈব সার এবং গুটি ইউরিয়ার ব্যবহার বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
বতমান সরকার ক্ষমতাসীন হয়েই নন-ইউরিয়া সারের দাম প্রায় ৫০ শতাংশ কমিয়েছে, ফলে অতীতে যেখানে এ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৬শ’ কোটি টাকা, এখন সেখানে দিতে হবে ২ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া ইউরিয়া খাতে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে ৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা। ফলে ৬ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। ভর্তুকি দিয়ে সারের দাম কম রাখা হয়েছে।
কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশে এই কম দামের সার পাচার হয়ে যাচ্ছে যার জন্য কর্তৃপক্ষকে পাচার রোধেও গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। এ ছাড়া আরো খবর আছে তৈজসপত্র, পারটেক্স, প্লাইউড, ইটভাটা, ডাইং কারখানায় তৈরি রং পাকা করতে এবং গরু মোটা-তাজাকরণ, মৎস্য চাষসহ বিভিন্ন কারখনার পণ্য তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। শিল্পোৎপাদনের জন্য কল-কারখানায় ইউরিয়ার জোগান দেয়াও সরকারের দায়িত্ব। সুতরাং ভর্তুকিই শেষ কথা নয়; সারের অপচয় রোধ ও ব্যবহার হ্রাসই সর্বোত্তম উপায়।
এছাড়া যেহেতু দীর্ঘদিন ধরে জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার হয়ে আসছে সেহেতু একদিকে জমি যেমন রাসায়নিক সারনির্ভর হয়ে উঠছে অপরদিকে তেমনি মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির গুণাগুণও হুমকির মুখে পড়ছে। এর সঙ্গে পোকা-মাকড়ের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষার তাগিদে কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহারে প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষণের প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে যা নিয়েও বিশেষজ্ঞরা আছেন বিশেষ ভাবনায়। সারের অপচয় ও ব্যবহার হ্রাস করে ফসলের উচ্চফলনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গবেষণা চলছে সেই ১৯৩০ সাল থেকে। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট আশির দশকে ইউরিয়া সারের অপচয় রোধের ওপর গবেষণা চালিয়ে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে গুটি ইউরিয়া প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে।
যার মাধ্যমে ইউরিয়া সারের অপচয় কমিয়ে প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ সাশ্রয় করে এবং সারের কার্যকারিতা বেড়ে যাওয়ায় ধানের ফলনও ২৫-৩০ ভাগ বাড়ানো যায়।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor