Thursday, January 29, 2009

কৃষি উপকরণের মূল্য হ্রাস প্রসঙ্গে

২৯.০১.০৯
ইত্তেফাক ।। ড. জাহাঙ্গীর আলম

দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই নয়া সরকার যে বিষয়ে সবচে’ বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন সেটি হলো কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য উপকরণের মূল্য হ্রাস। তজ্জন্য ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে কৃষি উপকরণ খাতে। প্রথমে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমানো হয়েছে লিটার প্রতি ২ টাকা। পরে হ্রাস করা হয়েছে ইউরিয়া বহির্ভূত রাসায়নিক সারের মূল্য। জোট সরকার ও সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য দফায় দফায় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল লিটার প্রতি ৫৫ টাকায়। সম্প্রতি তেলের আন্তর্জাতিক মূল্য হ্রাসের প্রেক্ষিতে দু’দফায় ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য ৯ টাকা হ্রাস করা হয়। অত:পর মহাজোট সরকার আরো ২ টাকা কমিয়ে তা নির্ধারণ করেছে ৪৪ টাকায়। এটি তেমন উল্লেখযোগ্য হ্রাস বলা যায় না। তবে এটি সরকারের সদিচ্ছার বহি:প্রকাশ। ধারণা করা হচ্ছে ভবিষ্যতে তেলের দাম আরো কমানো হতে পারে। দেশে বর্তমানে ২৯ লাখ টন তেল ব্যবহৃত হয়। তার শতকরা ৯১ ভাগই ডিজেল ও কেরোসিন। ডিজেলের বেশী ব্যবহার সেচ কাজে, বোরো মৌসুমে। কেরোসিনও বেশী ব্যবহৃত হয় গ্রামে, জ্বালানীর কাজে। সেদিক থেকে ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য হ্রাসের সংগে গ্রামের মানুষের, বিশেষ করে কৃষকের স্বস্তি জড়িত। কাজেই আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দাম অনেক কমে গেছে তখন বাংলাদেশেও এর মূল্য বিশেষ করে কেরোসিন ও ডিজেলের মূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা উচিৎ। তাতে উপকৃত হবে গ্রামের সাধারণ মানুষ ও কৃষক। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে তেলের মূল্য হ্রাসের সুবিধাটুকু প্রকৃত কৃষকরা পায়। এটি যেন কেবলই সেচ যন্ত্রের মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীদের করায়ত্ব না হয়।

বাংলাদেশে বর্তমানে ৬১ শতাংশ আবাদযোগ্য জমিতে সেচ প্রদান করা হয়। এটা অনায়াসেই ৮০ শতাংশে বৃদ্ধি করা যায়। সে ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে গভীর ও অগভীর নলকূপের আওতায় সেচ এলাকা বৃদ্ধির উপর। কারণ ভূ-গর্ভস্থ পানি দ্বারা যে সেচ দেয়া হয় তার শতকরা ৭১ ভাগই গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সম্প্রতি এ পদ্ধতির সেচের অধীনে জমির পরিমাণ খুবই মন্থর গতিতে বাড়ছে। তার কারণ সেচ যন্ত্রের উচ্চ মূল্য, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধি ও বিদ্যুতের অনিশ্চয়তা। সেচ কাজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ ও ডিজেল খাতে এখন ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। কিন্তু সেচ যন্ত্রের উপর কোন ভর্তুকি নেই। তাই সেচ যন্ত্রের উপর বিশেষ করে গভীর নলকূপ ক্রয়ের ক্ষেত্রে ভর্তুকি চালু করা যেতে পারে। ভূ-উপরিস্থ পানি যাতে সেচের কাজে লাগানো যায় তজ্জন্য খাল খনন, ড্রেজিং এর মাধ্যমে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি এবং বর্ষা ও বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার নির্মাণ ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে রাসায়নিক সারের ক্ষেত্রে এবার বড় রকমের ছাড় দিয়েছে নয়া সরকার। ইউরিয়া ব্যতিত অন্যান্য রাসায়নিক সারের ক্ষেত্রে ভর্তুকি ঘোষণা করেছে ৫৫ শতাংশ। তাতে প্রায় অর্ধেক কমে গেছে টিএসপি, এমওপি এবং ডিএপি সারের মূল্য। আগে প্রতি কেজি টিএসপি ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করা হতো, বর্তমানে তা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ টাকায়। এমওপি সারের মূল্য ইতিপূর্বে ছিল ৬৮ থেকে ৭০ টাকা। বর্তমানে তা ৩৫ টাকা। প্রতি কেজি ডিএপি সারের পূর্বের বাজারদর ছিল ৮৭ থেকে ৯০ টাকা। এখন তা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫ টাকা। তাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে ২ হাজার ৭৫৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এছাড়া ইউরিয়া সারের দাম কমানো না হলেও আগের আন্তর্জাতিক মূল্যে বর্তমানে তাতে ভর্তুকি আছে কেজি প্রতি প্রায় ৩০ টাকা। ফলে এ খাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ৩ হাজার ৮শ কোটি টাকা। বর্তমানে ইউরিয়া সারের আন্তর্জাতিক মূল্যের সংগে আমাদের অভ্যন্তরীণ মূল্যের তেমন বেশী ফারাক নেই। ইদানিং ইউরিয়া বহির্ভূত রাসায়নিক সারের ভর্তুকি বৃদ্ধির একটা বিশেষ কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে টিএসপি এবং এমওপি সারের মূল্য প্রায় দুই তৃতীয়াংশ কমে যাওয়া। ইতিপূর্বে আন্তর্জাতিক বাজারে টিএসপি ও এমওপির মূল্য দ্রুত বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যথাক্রমে ১ হাজার ৬২ ডলার এবং ১ হাজার ডলারে। বর্তমানে তা নেমে গেছে যথাক্রমে ৪০০ ডলার এবং ৩৫০ ডলারে। ফলে দেশীয় বাজারে এসব সারের অতি উচ্চ মূল্যের কারণে আমদানিকৃত শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ নন-ইউরিয়া সার অবিক্রিত থাকে। এখন আন্তর্জাতিক বাজারের সংগে তাল মিলিয়ে এগুলোকে হ্রাসকৃত মূল্যে বিক্রির জন্য সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সাম্প্রতিক মূল্য ছাড়ের পরও এমওপি সার বাদে অন্যান্য নন-ইউরিয়া সারের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারে অনেক বেশী।

ইউরিয়া বহির্ভূত রাসায়নিক সারের মূল্য হ্রাসের ফলে স্বাভাবিকভাবেই কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ কমবে। তবে এই কারণে প্রতি কেজি কৃষি পণ্যে কত টাকা উৎপাদন খরচ কমবে তা নির্ভর করবে নন-ইউরিয়া সারের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং অনুবর্তী উৎপাদন বৃদ্ধির উপর। এখনই তা বলার বিষয়টি হবে কেবলই অনুমান নির্ভর, যার কোন বা কেতাবি ভিত্তি নেই। তবে ইউরিয়া বহির্ভূত অন্যান্য রাসায়নিক সারের মূল্য হ্রাস পাওয়ায় সুষম সারের ব্যবহার যে উৎসাহিত হবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাতে ত্বরান্বিত হবে বর্ধিত উৎপাদন।

বাংলাদেশে বর্তমানে যে পরিমাণ সার ব্যবহৃত হয় তার শতকরা ৭০ ভাগই ইউরিয়া। ফসফেট ও পটাশ সারের শরিকানা যথাক্রমে ১৪ ও ৭ শতাংশ। বাকি ৬.৫ শতাংশ মিশ্র সার ও ২.৫ শতাংশ জিংক ও জিপসাম। নন-ইউরিয়া সারের দাম কমে যাওয়ায় ভবিষ্যতে এই শরিকানায় পরিবর্তন আসবে। এদেশে বছরে সার প্রয়োজন হয় প্রায় ৩৫ লাখ টন। এর বিপরীতে ৬টি ইউরিয়া এবং ১টি টিএসপি কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ১৭ লাখ টন। বাকি সারের যোগান দিতে হয় আমদানির মাধ্যমে। বর্তমানে দেশীয় সার কারখানাগুলো পুরনো হয়ে গেছে। এগুলো নিত্যদিন চালিয়ে রাখা হচ্ছে মেরামতের মাধ্যমে। ভবিষ্যতে এগুলোর উৎপাদন আরো কমবে। তাতে বেড়ে যাবে সারের আমদানি নির্ভরতা। প্রয়োজন পড়বে আরো বেশী বৈদেশিক মুদ্রা খরচের। সে কারণে দেশে এখন নতুন কিছু সার কারখানা স্থাপন করা উচিৎ। এক হিসেবে দেখা যায়, প্রতিবছর সার আমদানি খাতে আমাদের ৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। তা দিয়ে যমুনা সার কারখানার চেয়েও বড় একটি কারখানা প্রতিষ্ঠিত করা যায়।

নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বর্তমান সরকার কৃষি উপকরণের মূল্য হ্রাস ও কৃষক পর্যায়ে এর পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য ইতিমধ্যেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করেছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারের অনুসরণে ধীরে ধীরে কৃষি পণ্যের মূল্যও হ্রাস পাচ্ছে অভ্যন্তরীণ বাজারে। তবে খাদ্য দ্রব্যসহ বিভিন্ন কৃষি পণ্যের দর পতন এখানে কতটুকু প্রয়োজন এবং কোন পর্যায়ে তা কৃষকের উৎপাদন প্রণোদনা যোগাবে তা বিবেচনার বিষয়। এ বিষয়ে সমীক্ষা ভিত্তিক তথ্য ও উপাত্তের উপর অধিকতর নির্ভরশীল হওয়া উচিৎ। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে কৃষি পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার বিষয়টিও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে রয়েছে।

[লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ]

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor