Tuesday, October 28, 2008

কৃষককে সময়মতো সারের জোগান জরুরি

২৮.১০.০৮
অন্যস্বর
ডেসটিনি ।। এম জি মহিউদ্দীন আহম্মদ

জলবায়ুর পরিবর্তন বিশ্বে বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশ্বখাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও হুমকির কারণ হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তন বাংলাদেশে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, এটি সারা বিশ্বের অভিজ্ঞ মহলের অভিমত। তাই বাংলাদেশে বিশেষ সতর্কতাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। তা ছাড়া বাংলাদেশ বিপুল জনসংখ্যার দেশ। স্বল্প পরিসর ভূখ-ে এ বিপুল জনসংখ্যা ও একটি হুমকি। এ বিপুল জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও তাই অত্যাবশ্যকীয় এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার বিকল্প নেই। এ প্রেক্ষাপটে খাদ্য শস্য উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া গত্যন্তরও নেই। দেশের সীমিত পরিসরে ক্রমহ্রাসমান আবাদি জমিতে উৎপাদন বাড়াতে হলে খাদ্যের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। আর উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষিতে অব্যাহতভাবে প্রযুক্তির সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে এবং উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন কৃষি উপকরণ পর্যাপ্ত পরিমাণে জোগান নিশ্চিত করতে হবে। তা ছাড়া কৃষকগণ যেন সময়মত কৃষি উপকরণ পেতে পারে সে ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। কৃষি উৎপাদনের জন্য চাষের যন্ত্রপাতি যেমন ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, হালের গবাদিপশু, বীজ, সার, সেচ, কীটনাশক, কৃষি শ্রমিক, পণ্য পরিবহনের উপকরণ এসবের জোগান নিশ্চিত করা জরুরি। খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য এসব উপকরণ সংগ্রহের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সামর্থ্য বেশির ভাগ কৃষকেরই নেই। তাই এসব উপকরণ সংগ্রহের জন্য কৃষকের কাছে সময়মত আর্থিক জোগান নিশ্চিত করাও অপরিহার্য। অপ্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে আর্থিক সহায়তা ব্যয় বহুল বিধায় কৃষকের জন্য স্বার্থহানিকরও। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কৃষককে আর্থিক সহায়তার যে ব্যবস্থা আছে তা ত্রুটিপূর্ণ এবং অপর্যাপ্ত। এ ক্ষেত্রে সরকারের ঐকান্তিক পদক্ষেপ ফলদায়ক হবে। বর্তমান আলোচনায় কৃষি উপকরণের সব ক’টা নিয়ে আলোচনায় না গিয়ে শুধু সার সরবরাহের বিষয়াদি নিয়ে পর্যালোচনা করা হবে।
দেশের আবাদি জমির পরিমাণ সীমিত ও অপর্যাপ্ত বিধায় সব সময়ই চাষাধীনে থাকে। অব্যাহত চাষের আওতায় থাকায় জমির উর্বরতা হ্রাস পাওয়া স্বাভাবিক। এ প্রেক্ষাপটে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সার ব্যবহারের বিকল্প নেই। চাষাবাদে যথাসময়ে পর্যাপ্ত সারের জোগান নিশ্চিত করা তাই অত্যাবশ্যকীয়। কৃষক পর্যায়ে সময়মত ও পর্যাপ্ত পরিমাণে সারের জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন সম্ভব না হওয়াই স্বাভাবিক। কৃষক পর্যায়ে সময়মত ও পর্যাপ্ত সারের জোগান নিশ্চিত করা তাই জরুরি এ নিয়ে সংশয় থাকতে পারে না। কৃষক পর্যায়ে সারের জোগান নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে হয়ে থাকে। প্রথম ধাপে পর্যাপ্ত সারের সরবরাহ নিশ্চিত করার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণে সারের প্রাপ্তি। আর দ্বিতীয় ধাপে প্রাপ্ত সার কৃষক পর্যায়ে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সার সরবরাহের জন্য দেশজ উৎপাদন ও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকৃত সারের সরবরাহ নিশ্চিত করতে ভর্তুকি দিতে হয়। দেশজ সারেও ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। তবে সার আমদানির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা বাড়ার কারণে দেশে সার উৎপাদন করা ছাড়া সময়মত পর্যাপ্ত সার সরবরাহ করা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই পর্যাপ্ত সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে দেশেই সার উৎপাদন করার বিকল্প পথ সরকার বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট গুরুত্বসহ তৎপর রয়েছে। পত্রিকান্তরে জানা যায় সরকার সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে এবং সিরাজগঞ্জে একটি করে ইউরিয়া সার উৎপাদনের জন্য সার কারখানা স্থাপনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এ দু’টি সার কারখানায় প্রায় ১১ লাখ টন ইউরিয়া উৎপাদিত হবে বলেও জানা যায়। এ দুটি কারখানায় উৎপাদন শুরু হলে মাত্র দুই থেকে তিন লাখ টন ইউরিয়া সার আমদানি করার প্রয়োজন হতে পারে। কারখানাদ্বয় যত তাড়াতাড়ি উৎপাদনে যাবে ততই মঙ্গল। তবে উল্লেখিত পরিমাণ ইউরিয়া নতুন কারখানাদ্বয়ে উৎপাদন হলেও স্বল্প পরিমাণে হলেও আমদানি করার প্রয়োজন হতে পারে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, সারের জন্য বিদেশ নির্ভরতামুক্ত হওয়ার জন্য সব ধরনের সার দেশেই উৎপাদন নিশ্চিত করা উচিত। চাষাবাদে উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই বিধায় কৃষি উপকরণ বিশেষ করে সার সময়মত এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে কৃষকের হাতে পৌঁছানো নিশ্চিত করা অপরিহার্য। গত শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে চলমান সময় পর্যন্ত কৃষিতে রাসায়নিক সারের জোগান নিয়ে তৎপরতা চালানো হতে থাকে। কিন্তু জমিতে সার প্রয়োগে কি পরিমাণে সার প্রয়োগ করা দরকার তার মাত্রা সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়নি বরং কৃষক বেশি সার প্রয়োগের মাধ্যমে বেশি ফলন পাওয়ার প্রত্যাশা করছে। ফলে অতিরিক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহারও আবাদি জমির উর্বরতা হ্রাসে ভূমিকা রাখছে। সাম্প্রতিক সময়ে জৈব সার প্রয়োগের বিষয়টি নিয়ে সীমিত তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। মাটির জৈব উপকরণ রক্ষা করতে হলে জৈব সার প্রয়োগের বিকল্প নেই। তাই জৈব সার উৎপাদনে কৃষকদের প্রয়োজনীয় তথ্য প্রদানসহ বাস্তব সহায়তা করা জরুরি। জৈব সার উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের সাফল্য এবং জমির উর্বরতা রক্ষার পাশাপাশি রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরতা কমাতেও ভূমিকা রাখবে। উল্লেখ্য, খাদ্যের মান বাড়াতেও জৈব সারের ব্যবহার ভূমিকা রাখবে।
কৃষকদের পরিমিত সার প্রয়োগে সফল করতে হলে আবাদযোগ্য জমিতে কোন ফসলের জন্য কি পরিমাণে সারের দরকার এ তথ্য দেয়া অপরিহার্য হলেও বর্তমানে কৃষকরা এ ধরনের সহায়তা থেকে বঞ্চিত। পরিমিত সার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে কৃষক পর্যায়ে আবাদি জমির মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য এ বিষয়ে কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই। আশার কথা দেশের কোনো কোনো স্থানে অতি সীমিত পর্যায়ে মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। সব আবাদি জমির মাটি পরীক্ষার পর ফসল উৎপাদন করতে হলে অন্তত প্রত্যেক ইউনিয়নে মাটি পরীক্ষার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় এ কাজটি করতে এগিয়ে যাওয়া জরুরি। তাৎক্ষণিকভাবে অন্তত উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত মাটি পরীক্ষার যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে পদক্ষেপ নেয়া মঙ্গলজনক। স্থায়ীভাবে মাটি পরীক্ষার যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে পারার আগে পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়া জরুরিভাবে বিবেচ্য। মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করা আমাদের ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য বিধায় মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা জরুরিভিত্তিতে করতে হবে।
পর্যাপ্ত পরিমাণে সারের মজুদ দেশে বিদ্যমান থাকাই ফসল উৎপাদনের জন্য সহায়ক হবে না বরং কৃষকের হাতে সময়মত পর্যাপ্ত সার পৌঁছে দেয়া জরুরি। আর এ কাজটি করতে হলে সার সরবরাহ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলা দরকার। রাসায়নিক সারের প্রয়োগ শুরু করার পাশাপাশি কৃষক পর্যায়ে সার সরবরাহ করতে সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন স্থাপিত হয়েছিল। এ প্রতিষ্ঠানটির সাফল্য-ব্যর্থতা যাচাই না করেই দাতা সংস্থার পরামর্শ মোতাবেক এটির কার্যক্রম সার সরবরাহ ক্ষেত্রে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। চলমান সময়ে কৃষক পর্যায়ে সার সরবরাহ নিয়ে জটিলতার বিষয়টি প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে থাকে। জাতীয় পর্যায়ে সারের অভাব না থাকলেও কৃষকরা পর্যাপ্ত সার সময়মত পেতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ বিষয়টি অবশ্যই উদ্বেগের কারণ বিধায় নিরসনে ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে অবশ্যই এগিয়ে যেতে হবে। সুষ্ঠু সার সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ার ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কাঠামো গড়ার বিকল্প নেই।
কৃষকের কাছে সময়মত পর্যাপ্ত সারের জোগান নিশ্চিত করার কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি কৃষিবিদদের উদ্ভাবিত কালার চার্টের ব্যবহার নিশ্চিত করতে কার্যকর উৎপরতা চালানো দরকার। তা ছাড়া গুটি ইউরিয়া নিরঙ্কুশভাবে দ্রুত ব্যবহারের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়াও জরুরি। কৃষকদের সময়মত পর্যাপ্ত সারের জোগান নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের সার প্রয়োগে যথাযথভাবে দক্ষ করতে পারলে (১) আবাদি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত সারের ব্যবহার বন্ধ হবে, ফলে মাটির স্বাস্থ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব হতে পারে (২) কালার চার্টের ব্যবহারে কৃষকদের দক্ষ করতে পারলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সারের ব্যবহার রোধ হতে পারে (৩) গুটি ইউরিয়া সারের ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হলে সার কম পরিমাণে প্রয়োজন হবে এবং কৃষকের উৎপাদন ব্যয় কমার সুযোগ হবে (৪) মাটি পরীক্ষা করে সার প্রয়োগ করা সম্ভব হলেও অতিরিক্ত সার ব্যবহার রোধ হবে। কৃষক পর্যায়ে অতিরিক্ত সার ব্যবহার বন্ধ হলে জাতীয় পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ সার সাশ্রয় হতে পারে। যা জাতীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে।
এমতাবস্থায়, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শস্যের ফলন বাড়াতে সময়মত পর্যাপ্ত সার কৃষক পর্যায়ে জোগান নিশ্চিত করার বিকল্প নেই এবং এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অবহেলারও অবকাশ নেই। এ বিষয়ে সরকারি বেসরকারি কার্যকর তৎপরতা নিশ্চিত করতে অব্যাহত তৎপরতা চালানো জরুরি। য়
লেখক : সাবেক ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor