Friday, October 31, 2008

কৃষিঋণ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন নীতিমালা

৩১.১০.০৮
ইত্তেফাক ।। সম্পাদকীয়

কৃষিঋণের বর্তমান ভল্যুম বৃদ্ধি করিতে বাংলাদেশ ব্যাংক পুনঃঅর্থায়ন নীতিমালা সহজ করার চিন্তা-ভাবনা করিতেছে। চলতি অর্থ বছরের শুরুতে কৃষিঋণ বিতরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তাহা এ যাবৎ আশানুরূপভাবে বাস্তবায়িত হয় নাই। মূলত বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অর্থ সংকটই ইহার জন্য দায়ী। এই প্রেক্ষিতে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিকট পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা চাহিয়া আবেদন করিয়াছে। সরকারি বন্ডের বিপরীতে ব্যাংক রেট তথা ৫ শতাংশ সুদে এইসব ব্যাংকে এই সুবিধা প্রদানের বিষয়টি এখন বিবেচনাধীন। কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির তারল্য সংকট মোকাবিলায় দ্রুত এই পুনঃঅর্থায়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হইবে বলিয়া জানা যায়।

বলা নিষ্প্রয়োজন, কৃষিই আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। কিন্তু এই খাত যুগ যুগ ধরিয়া অবহেলিত। বিশেষ করিয়া কৃষিখাতে বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির বিনিয়োগ প্রবণতা বরাবরই কম। তবে বিশ্ব জুড়িয়া সাম্প্রতিককালের খাদ্য সংকটের প্রেক্ষিতে সকলেরই টনক নড়ে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে কৃষিখাতকে দেওয়া হয় অগ্রাধিকার। এই খাতের অন্যান্য সমস্যার মধ্যে পুঁজি স্বল্পতা সবচাইতে মারাত্মক। কৃষি মৌসুমে কৃষকদের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকে না। ফলে অনেকে বীজ ক্রয় হইতে শুরু করিয়া মাঠ প্রস্তুতিসহ প্রারম্ভিক নানা কাজে হাত দিতে পারে না। ইতিপূর্বে মহাজনের নিকট হইতে ঋণ লইয়া সর্বস্বান্ত হওয়ার নানা করুণ কাহিনী ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে কৃষক সমাজ কমবেশি পরিচিত হইয়াছেন। ফলে কোথা হইতে টাকা পাওয়া যাইবে এই চিন্তায় কিষাণ-কিষাণীর ঘুম হারাম হয়। সেক্ষেত্রে তাহারা উদ্যম হারাইয়া ফেলে। তাহাছাড়া বাংলাদেশে বর্গাচাষীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় যথাসময়ে পুঁজি প্রাপ্তির ব্যবস্থা করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গত অর্থ বৎসরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি কৃষিঋণ বিতরণ করা হইয়াছিল বলিয়াই বোরোসহ একাধিক ফসলের বাম্পার ফলন হইয়াছে। ফলে মূল্যস্ফীতি ও নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিপতিত হইলেও কৃষিই আমাদের শেষ পর্যন্ত রক্ষা করিয়াছে। তাই বলা যায়, সমস্যা জর্জরিত দেশটির প্রায় ১৫ কোটি মানুষের অন্ন-আহার নিশ্চিত করিতে হইলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ব্যতীত গত্যন্তর নাই।

সরকার ইতিমধ্যে দেশী-বিদেশী সকল ব্যাংকে কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করিয়াছে। ইহা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক উত্তম সিদ্ধান্ত। কিন্তু কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও যথাযথ তদারকি ব্যতীত এই কার্যক্রমের সফলতা আশা করা যায় না। ঋণের অর্থ সময়মতো প্রকৃত কৃষকের হাতে পৌঁছানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ। গত বছরের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ বাড়াইয়া এবার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এই পর্যন্ত সরকারী ব্যাংকগুলো মাত্র ৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা বাড়াইতে সক্ষম হইয়াছে। এই সূত্রে সরকারী ব্যাংকগুলি পুনঃঅর্থায়ন সুবিধার যে দাবি জানাইয়াছে তাহা অত্যন্ত যৌক্তিক। কিন্তু এই সুবিধায় পাওয়া ঋণ যাহাতে কেবল কৃষিখাতেই বিতরণ করা হয় তাহা সর্বাগ্রে নিশ্চিত করিতে হইবে। অপেক্ষাকৃত কম সুদে ঋণ বিতরণের বিষয়টিও এখানে উল্লেখ না করিলেই নয়। জানা যায়, দেশের মোট কৃষিঋণের প্রায় ৯০ শতাংশই বিতরণ করিয়া থাকে সরকারী ৮টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে বেসরকারী ব্যাংকের অংশগ্রহণ ও দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করিতে হইবে। অন্যদিকে বিদেশী ব্যাংকগুলি এনজিওর মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণ করিয়া থাকে। যাহা হউক, এ সকল ঋণের সুদ, বিতরণ হার ও পদ্ধতি স্বচ্ছ, যৌক্তিক বা সন্তোষজনক কিনা তাহা নিয়মিত মনিটরিং করা একান্ত প্রয়োজন।

বস্তুত ১৯৯০ সালে আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় নির্দেশিত ঋণপ্রথা বিলুপ্ত হইলে কৃষিখাতে ঋণ বিতরণের প্রবাহ কমিতে থাকে। কিন্তু অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরেই আবার কৃষির প্রতি অধিক মনোযোগ প্রদানের সময় আসিয়াছে। চলতি অর্থ বৎসরে সরকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় ৭ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করিয়াছে। কিন্তু ইহাই যথেষ্ট কিনা সেই বিষয়টিও ভবিষ্যতে ভাবিয়া দেখিতে হইবে। আবার অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে কৃষিঋণের উদ্দেশ্য ব্যাহত হউক, ইহা কাহারও কাম্য নয়। সাধারণত প্রকৃত কৃষকগণ ঋণ পরিশোধে খুবই আন্তরিক। শুধু ছদ্মবেশী কৃষক, টাউট-বাটপাড় ও মধ্যস্বত্বভোগীদের লুটপাট হইতে মুক্ত রাখিতে পারিলে কৃষিঋণ কার্যক্রমকে অবশ্যই সফল করা সম্ভব। ইতিপূর্বে সরকারী তরফ হইতে তিন বছর মেয়াদী আবর্তক শস্যঋণ ব্যবস্থা ও কৃষকদের জন্য আইডি কার্ড প্রবর্তনের কথা বলা হইয়াছে। আমরা শীঘ্রই ইহার বাস্তবায়ন দেখিতে চাই। পরিশেষে কৃষিঋণ বিতরণ নির্বিঘœ ও নিশ্চিত করিবার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলিকে পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা প্রদানের বিষয়টিকে আমরা জরুরি ও অপরিহার্য বলিয়া মনে করি।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor