Saturday, October 11, 2008

কৃষি খাতে রূপান্তর ও পুঁজির বিকাশ

১০.১০.০৮
ডেসটিনি ।। জাহাঙ্গীর আলম

আশ্বিন মাসের দিনগুলো দ্রুত চলে যাচ্ছে। গ্রামের কৃষকদের এখন অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটছে। রোপা আমনের চারা গুঁজে দেয়ার লগ্ন ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায় ইতিমধ্যেই আমন ধানের চারা গুঁজে দেয়া শেষ হয়েছে। অতঃপর সবুজ রং ধারণ করছে বিবর্ণ ও ফিকে হয়ে যাওয়া ধানের চারা গাছগুলো। তবে নিচু এলাকায় এখনো শেষ হয়নি চারা গুঁজার কার্যক্রম। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে অতি দ্রুত জমি চাষ করতে পারছে না অনেক কৃষক। মাঠে পশুশক্তির চাষ এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। কৃষক গরু পালছে মূলত দুধের জন্য অথবা মোটাতাজা করার জন্য। কেবল হালের জন্য বলদ কিংবা গাভী পালার দৃষ্টান্ত এখন বিরল। গরু পালনকারী গ্রামীণ পরিবারের সংখ্যাও ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। হালের জন্য এখন কৃষকরা নির্ভর করছে প্রধানত যন্ত্র শক্তির ওপর। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে ট্রাক্টর কিংবা পাওয়ার টিলারের সরবরাহ খুবই অপ্রতুল। প্রতিটি ট্রাক্টর কিংবা পাওয়ার টিলার হাল চাষের কাজ করছে দুই শিফটে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমি চাষ করছে একজন ড্রাইভার। আবার ড্রাইভার পাল্টে দ্বিতীয় শিফটে একই কলের লাঙ্গল ব্যবহার করে জমি চাষ হচ্ছে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত। মাঠে বিরতিহীনভাবে চলছে ওই কলের লাঙ্গলগুলো। এরপরও কৃষকদের চাহিদামাফিক জমি চাষ করতে পারছে না যন্ত্রের মালিকরা। আগাম ভাড়ার টাকা পরিশোধ করেও প্রতিটি কৃষককেই ৩/৪ দিন, কোথাও সপ্তাহকাল অপেক্ষা করে থাকতে হচ্ছে জমি চাষের জন্য। ফলে জমিতে চারা গুঁজার সময় পিছিয়ে যাচ্ছে। হালের জন্য পশুশক্তির ব্যবহার থেকে যন্ত্র শক্তির ব্যবহারে উত্তরণের এই ক্রান্তিলগ্নে আর বেশি ট্রাক্টর ও টিলার সরবরাহ করা দরকার। আমাদের ছোট ও মাঝারি কৃষকনির্ভর স্বল্প পুঁজির কৃষি ব্যবস্থায় স্ব-নিজ উদ্যোগে কৃষকরা এ সংকট মোকাবিলা করতে পারবে বলে মনে হয় না। এর জন্য চাই সরকারি উদ্যোগ। চাই প্রয়োজনীয় পুঁজির সরবরাহ। নতুবা সামনের বোরো মৌসুমে এ সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করতে পারে।
এবার জমি থেকে বর্ষার পানি বেশ আগেভাগেই সরে গেছে। তদুপরি তায়ে তায়ে বৃষ্টি হচ্ছে। তাতে পানি সেচের তেমন প্রয়োজন হচ্ছে না কোথাও। তা ছাড়া আমাদের দেশে রোপা আমন অনেকটাই বৃষ্টিনির্ভর। ফলে সামনে আর একটা বাম্পার ফলন অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কিন্তু আগামী দিনগুলোতে খরা হলে কোথাওবা সেচের প্রয়োজন হবে। সম্প্রতি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এর অভিঘাত এসে লাগবে কৃষিতে। সামনে বোরো মৌসুমে তা আরও বেশি করে অনুভূত হবে। পানি সেচের জন্য যে ভর্তুকি দেয়া হয় তা সেচের ভাড়া হ্রাসের জন্য তেমন সহায়ক নয়। কৃষককে তার জমিতে পানি নিতে হলে সেচ যন্ত্রের মালিককে আগেভাগেই সেচের মাশুল নগদ টাকায় পরিশোধ করে দিতে হয়। কিন্তু ছোট কৃষক ও বর্গা চাষিদের ক্ষেত্রে পুঁজির অপর্যাপ্ততা প্রয়োজনীয় পানি সেচের সরবরাহকে অনিশ্চিত করে তুলছে। রোপা ও বোরো মৌসুমে ধানের চারা গুঁজে দেয়ার কাজটি খুবই শ্রমবহুল। আগে মানুষ বদলা দিত। কয়েকটি কৃষক পরিবার একসঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে মাঠে পালাক্রমে রুইয়ে দিত ধানের চারা। এখন আর সেই বদলার দিন নেই। এখন চুক্তি হয় নগদ অর্থে। বছর কামলা আর রোজ কামলা দিয়ে মাঠে কাজ করানোর দিন প্রায় শেষ। বিদেশে অদক্ষ শ্রমিক রফতানি বৃদ্ধির ফলে আমাদের জন্য যে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ সুগম হয়েছে এ কথাটি সত্য, কিন্তু সেই সঙ্গে কৃষি শ্রমিকের সরবরাহও হ্রাস পেয়েছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে কৃষি শ্রমিকের মৌসুমী সংকট। বেড়ে যাচ্ছে মজুরি। চুক্তিবদ্ধভাবে নগদ টাকায় ধানের চারা রোপণের কাজ তাতে বিঘিœত হচ্ছে। কারণ আমাদের ছোট কৃষকদের হাতে প্রয়োজনীয় পুঁজির বড় অভাব। ধানের চারা গজানোর কাজও সব কৃষক প্রয়োজনমতো করতে পারে না। কারো জমি থাকে না। কারো থাকে না বীজ। অধিকাংশ কৃষককেই চারা কিনে নিতে হয় বাজার থেকে। সেখানেও দরকার পুঁজি। প্রয়োজন হয় নগদ অর্থের। ছোট কৃষক ও ভূমিহীন বর্গাচাষিদের জন্য এটি একটি সংকট, একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।
চাষাবাদের আর একটি বড় উপকরণ রাসায়নিক সার। সামগ্রিকভাবে ম্যাক্রো পর্যায়ে দেশে তেমন সার সংকট কখনোই দৃশ্যমান হয় না। গাণিতিক হিসাবে প্রয়োজনের তুলনায় সারের সরবরাহ বেশিই থাকে। কিন্তু সংকট অনুভূত হয় মাঠ পর্যায়ে। যে কৃষক জমি চাষ করে, অপ্রতুল সার সরবরাহের জন্য আক্ষেপ ও অভিযোগ থাকে তারই। অনেক ক্ষেত্রেই তা সত্য বলে প্রতীয়মান। এবার সরকারি পর্যায়ে সারের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। গ্রামে গিয়ে তা আরও বেড়ে যাচ্ছে একধাপ। তাতে পুঁজির সংকট তীব্রতর হচ্ছে। তদুপরি প্রায়ই প্রয়োজনীয় পরিমাণে সারের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে না ডিলাররা। এটি জমি চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহের কারণ।
ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার ও ধান কাটার বিষয়টিও এখন পুঁজিবহুল। অনেক ক্ষেত্রেই এ কাজগুলো চুক্তির ভিত্তিতে করিয়ে নিতে হয় কৃষকদের। তাতে প্রয়োজন হয় নগদ অর্থের। কিন্তু ছোট কৃষকদের হাতে নগদ অর্থ প্রায়ই থাকে না।
পারিবারিক শ্রমিকের অপ্রতুলতা এবং কৃষি উপকরণের উচ্চ মূল্যের কারণে অনেক কৃষক নিজে আর জমি চাষ করতে সাহসী হচ্ছে না। তারা অন্যদের কাছে পত্তন দিয়ে দিচ্ছে জমি। এ নাগাদ একসনা জমি লিজের মূল্য তেমন বেশি ছিল না। বেশ সহনীয় মূল্যে গ্রামাঞ্চলে এতদিন কৃষি জমি লিজ দেয়া হতো। কিন্তু কৃষি পণ্যের সাম্প্রতিক মূল্য বৃদ্ধি জমির লিজ মূল্য অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তাতে চাষের জমি হাতে নিতে প্রয়োজন হচ্ছে অনেক পুঁজির। এ পুঁজি সংগ্রহ করতে খুবই হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের ছোট ও ভূমিহীন কৃষকদের।
বাংলাদেশের কৃষি কাজ এখন বেশ পুঁজিঘন। প্রায় সব কৃষি উপকরণই বাজার মূল্যে ক্রয় করতে হচ্ছে নগদ অর্থে। কিন্তু দেশের ছোট কৃষক, জমির পত্তন গ্রহীতা ও বর্গাচাষিদের অনেকে নগদ টাকার অভাবে প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ জোগাড় করতে পারছে না। গত কয়েক বছর ধরে মোট বিতরণকৃত কৃষি ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকসহ বাংলাদেশে কার্যরত সব তফসিলি ব্যাংকে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ কার্যক্রমে অংশ নিতে নির্দেশনা পাঠিয়েছে। এটি একটি উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। এর ফলে কৃষি ঋণের প্রবাহ আরও অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু তাতে ছোট কৃষক ও বর্গাচাষিদের ঋণ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভবপর হবে কি না সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। জানা যায়, বর্গাচাষিদের জন্য বিনা জামানতে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আসল সমস্যাটি হলো এই যে, ঋণের জন্য ছোট কৃষক ও বর্গাচাষিরা ব্যাংকের দুয়ারে সাধারণত যেতে চায় না। তারা ব্যাংক ঋণ সম্পর্কে অহেতুকই আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। এটি দূর করতে হবে। ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যেতে হবে ছোট কৃষকদের কাছে। তাদের সঙ্গে মিশতে হবে। ঋণ নেয়ার বিষয়ে সহজ-সরলভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে তাদের। যাতে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের বিষয়টি তাদের কাছে সহজ ও নিরাপদ মনে হয়।
কৃষি খাতে বর্তমানে একটি রূপান্তর ঘটছে। এ রূপান্তর ক্রমেই পুঁজিবহুল হচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমাদের কৃষি ব্যবস্থাকে সঠিকভাবে প্রস্তুত করে তোলা দরকার। য়
- লেখক : কৃষি গবেষক

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor