Thursday, October 2, 2008

সমস্যায় জর্জরিত কৃষিখাত

২৮.০৯.০৮
ইত্তেফাক ।। মুনসী কওছার উদ্দিন

কৃষি আমাদের বেঁচে থাকার সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ এবং অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। দেশের জাতীয় আয়ের বিরাট একটি অংশ আসে কৃষি খাত থেকে। বর্তমান জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান শতকরা ২৩.৪৬ ভাগ। কিন্তু এতকিছুর পরও বাংলাদেশের কৃষি খাত ও কৃষির উন্নয়নে নানাবিধ সমস্যার আবর্তে জর্জরিত।

আমি সহকারি কৃষি স¤প্রসারণ কর্মকর্তা (এখন অবসরপ্রাপ্ত) হিসেবে মাঠে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি- বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা পিছিয়ে থাকার অন্যতম প্রধান কারণ মান্ধাতার আমলের চাষ পদ্ধতি। অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে এখনও কাঠের লাঙ্গল ও বলদ দিয়ে চাষাবাদ করা হয়। এতে যেমন সময় অনেক বেশি লাগে তেমন পরিশ্রমও হয় কয়েকগুন বেশি। পৃথিবীতে কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তা আমাদের গ্রামাঞ্চলের কৃষকের কাছে অজানা। যে কারণে শারীরিক শ্রমের ওপর নির্ভরশীল কৃষি প্রত্যাশিত ফসল উৎপাদন করতে পারে না। আমাদের জমি যথেষ্ট উর্বরা হওয়া সত্ত্বেও আমরা আবাদী জমিকে ঠিকমত কাজে লাগাতে পারছি না। এখানে অজ্ঞতা অর্থাৎ শিক্ষার বিরাট একটা ঘাটতি রয়ে গেছে। আমাদের দেশের কৃষকদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আবাদী জমিতে ফসল ফলানো সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। পাশাপাশি এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে কৃষি যখন আমাদের উন্নয়নের মূলভিত্তি তখন রাজস্ব খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখতে হবে কৃষিতে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বারবার আমাদের দেশে আঘাত হেনে কৃষি এবং কৃষিখাতকে করছে বাধাগ্রস্থ। ভৌগোলিক কারণে প্রতিবছর বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস লেগেই আছে। ১৯৯৮ সালের বন্যা, স¤প্রতিকালের সিডর যার ক্ষত আমাদের এখনও শুকায়নি। বিআইডিএস-এর এক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল, ৯৮ এর বন্যায় দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫২টি জেলা প¬¬¬াবিত হয় এবং ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০ হাজার কোটি টাকা। স¤প্রতিকালের সিডরে যে ক্ষতি হয়েছে তার সঠিক চিত্র এখনও আমাদের অজানা।

বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা এখন পর্যš- অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। সব জায়গায় সেচ ব্যবস্থা না থাকার ফলে কৃষকদের প্রয়োজন অনুযায়ী পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি না হলে কৃষি কাজের ধারাবাহিকতা বাধাগ্রস্থ হয়। আবার মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়, এতে ফসলের ক্ষতি হয় বেশি। আবার গ্রামে দেখা যায় অনেক ধনী কৃষক সেচ মেশিন কিনে তা দিয়ে বিভিন্ন কৃষকের জমিতে পানি দেয়। এতে একটা শর্ত থাকে। শর্তটা হল ফসলী জমির তিনভাগের একভাগ সেই সেচ মালিককে দিতে হবে। এতে করে কৃষক যে ফসল ফলায় তার একটা অংশ ওই ধনী কৃষকের গোলাতে চলে যায়। ফলে প্রকৃত কৃষক দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে। এখানে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার খুব বেশি। ফলে আবাদী জমিগুলো ঘরবাড়ি তৈরিতে লেগে যাচ্ছে। খণ্ডিত হচ্ছে জমিগুলো। আর এই খণ্ড-বিখণ্ডের ফলে কলের লাঙল বা ট্রাক্টর ব্যবহার করা সম্ভব হয়ে উঠছে না। যার কারণে উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে।

আমাদের দেশের অধিকাংশ কৃষকই গরিব। তারা অনেক সময় গ্রামের মহাজনদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা ধার করে জমিতে ফসল ফলায়। এই টাকার চড়া সুদ গুনতে হয় কৃষককে। ফলে সে হয়ে পরে দিশেহারা। বিভিন্ন ব্যাংকে কৃষিঋণের ব্যবস্থা থাকলেও তা মুখ চিনে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে কৃষকের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করা হয় বলে অভিযোগ আছে। তাছাড়া কৃষিঋণ ব্যবস্থা সহজ নয়। এখানে অনেক বেগ পেতে হয়। স¤প্রতি দেশী-বিদেশী সব ব্যাংকগুলোর জন্য কৃষিঋণ দেয়া বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়মের কার্যকারিতা কতটুকু হবে তা দেখার বিষয়। কার্যকর হলে এটি অনেক কৃষকেরই সুদিন ফিরিয়ে দেবে এতে কোন সন্দেহ নেই।

আমাদের কৃষক আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত। তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাকে। হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিতে হবে তাদের। বালাই-দমন ব্যবস্থায় কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে সরকারকে। উন্নত গবেষণাক্ষেত্র তৈরি করতে হবে দেশে। যে গবেষণা থেকে বেরিয়ে আসবে নতুন নতুন প্রযুক্তি। কীটনাশক ব্যবহার না করে কীভাবে বালাই-দমন করা যায় কৃত্রিমভাবে তার ব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের দেশে অনেক কৃষিবিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করে চলছে নতুন নতুন জিনিস। তাদের আবিষ্কারের ফসল পৌঁছে দিতে হবে কৃষকের দোরগোড়ায়।

কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণেও সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। একমণ ধানের উৎপাদন মূল্য ৫০০ টাকা হলে বাজারের দাম যদি ৪৫০ টাকা হয় তাহলে কৃষক চরমভাবে মার খাবে। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে সরকারের বাজেট বাড়াতে হবে কৃষিতে। কৃষক যেন তার উৎপাদিত জিনিসের সঠিক মূল্য পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আমাদের দেশের কৃষককে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে বের করে আনতে হবে। প্রয়োজন মাফিক সার তাদের সরবরাহ করতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তাদের হাতের নাগালে দিতে হবে।



মুনসী কওছার উদ্দিন, কৃষক, সহকারি কৃষি স¤প্রসারণ কর্মকর্তা (অব:), লোহাগড়া, নড়াইল।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor