Monday, October 6, 2008

জীবনমানের সব আছে কৃষকের ঘরে

০৬.১০.০৮
যায়যায়দিন ।। আলতাব হোসেন বেইজিং (চীন) থেকে ফিরে

বিশ্বের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর দেশ চীনের আর ১০টি গ্রামের মতোই একটি জুজেইয়ান। এ গ্রামে আছে হাসপাতাল। রয়েছেন সার্বক্ষণিক দুজন ডাক্তার। অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটারসহ হাসপাতালে আছে অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা। কৃষকের স্বাস্থ্যসেবায় ৮০ ভাগ ভর্তুকি দিয়ে থাকে চীন সরকার। গ্রামে আছে কমিউনিটি সেন্টার। সঙ্গে বড় পরিসরের একটি করে লাইব্রেরি। আছে বিনোদনের জন্য মিনিপার্ক ও বাচ্চাদের খেলার মাঠও।
প্রতিটি বাড়িতে যাচ্ছে সাপ্লাইয়ের পানি। ঘরে ঘরে পানি গরম ও ঠা-া করার মেশিন। আছে প্রচ- শীতে
তাপ দেয়ার ব্যবস্থা। এসি-ফ্রিজেরও দেখা মিললো কিছু ঘরে। মাঝারি মানের শপিং মলও আছে। আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে গ্রামের কৃষকসহ সাধারণ মানুষকে পরিচিত করার জন্য আছে আইসিটি সেন্টার। গ্রামের শিশুরা ইন্টারনেটে জেনে নেয় নিজেদের দরকারি তথ্য। প্রতিটি বাড়িতেই আছে গ্যাস সরবরাহ। গ্রামেই আছে গ্যাস স্টেশন। আর গ্রাম থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরেই মহাসড়ক। চীনারা এসব গ্রামের নাম দিয়েছে ‘সোশ্যাল ভিলেজ’।
বেইজিং শহর থেকে সাড়ে ৪ হাজার কিলোমিটার দূরের এ গ্রামটি হুবাই প্রদেশের গুনআন কাউন্টিতে (জেলা)। দেড় হাজার হেক্টর আয়তনের এ বিশাল গ্রামের লোকসংখ্যা মাত্র ২ হাজার ৪১২ জন। আর কৃষক পরিবারের সদস্য ৫৬০ জন। মোট জমির এক হাজার হেক্টরই আবাদি জমি। অপেক্ষাকৃত কম উৎপাদনশীল উঁচু-নিচু জমিতে থরে থরে সাজিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে লালচে রঙের কৃষকের ঘরবাড়ি। বাড়ির পাশের মহাসড়ক থেকে পাকা রাস্তা চলে গেছে কৃষকের দোরগোড়ায়।
তিন থেকে পাঁচ হাজার পাকা দালান নিয়ে ঘরে উঠেছে চীনের একেকটি গ্রাম। আর এসব গ্রামে মূলত কৃষকরাই বেশি বসবাস করেন। এসব কৃষকের বাড়ি দুই থেকে পাঁচ তলাই বেশি চোখে পড়ে। প্রতিটি বাড়ি রঙিন টাইলস দিয়ে তৈরি। সব বাড়িতেই শূকর পালা হয়। মানুষ ও শূকরের বিষ্ঠা থেকে তৈরি করা হয় বায়োগ্যাস (বায়ো ফুয়েল)। আছে সৌরবিদ্যুৎও। চোখে পড়লো কৃষকের পাকা উঠানে শুকাতে দেয়া তুলা, ভুট্টা আর লাল মরিচ।
বাড়ির পাশের সামান্য পতিত জমিতে কৃষক বুনেছেন নানা জাতের শাকসবজি। ফুটে আছে সর্ষে ফুল। রাস্তার পাশে ছোট নালায় ফুটেছে নীলপদ্ম। চোখে পড়লো কোথাও পাকা আবার কোথাও আধা পাকা ধানের ক্ষেত। দেখেই বোঝা যায় কৃষকের ব্যস্ততা। এর মধ্যে কৃষাণীদের ব্যস্ততা যেন একটু বেশিই। ধান কেটে সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেতেই তা যন্ত্রে মাড়াই হচ্ছে। আর বিছিয়ে রাখা হচ্ছে খড়, পরে তা পুরিয়ে ফেলা হবে। বিকালের সোনারঙা রোদ পড়ছে গ্রামের মাঠে। গাড়িতে করে কৃষককের ফসল চলে যাচ্ছে গ্রামের কোল্ড স্টোরেজে বা খাদ্য গুদামে। আর গ্রামের পুরো বিষয় তদারকি করেন গ্রামপ্রধান। এ গ্রামপ্রধান হলেন কমিউনিস্ট পার্টির এক তৃণমূল সদস্য।
এমন একটি স্বপ্নময় গ্রাম তৈরি করতে চীনাদের খুব বেশি সময় লাগেনি। গ্রামের এতোসব সুযোগ-সুবিধার পরেও চীনের বর্তমান এ অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সুফল কেবল শহরের মানুষ ভোগ করছে বলে অভিযোগের অঙুলি ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। গ্রাম ও শহরের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ছে বলেও অভিযোগ আছে।
গ্রাম ও শহরের আয়-বৈষম্য কমাতে চীনা সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন এনেছে। বর্তমানে ভূমির মালিকানা সরকারের হাতে থাকলেও তা দীর্ঘমেয়াদে লিজ দেয়া হচ্ছে কৃষকদের। আর কৃষকের নামে জমি লিজ নিয়ে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছে শহরের খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
গুনআন কাউন্টির ডেপুটি গভর্নর লি ফ্লুয়েন জানান, ৯০-এর পর শুরু হওয়া তাদের নতুন সোশ্যাল ভিলেজ সংগ্রামে হয়তো ছোটখাটো কিছু সমস্যা থাকবে, তবে নির্দিষ্ট একটা সময় পর এ বৈষম্য আর থাকবে না। তিনি জানান, এজন্য তারা কৃষিভিত্তিক শিল্প বিস্তারে প্রাধান্য দিচ্ছে।
১৯৬৪ সালে শুরু করা মাও সেতুংয়ের ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ সাফল্য পায়নি বলে একটা অনুযোগ আছে চায়না অর্থনীতিবিদদের। মাও সেতুংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মূল উদ্দেশ্যই ছিল মানুষের মনোযোগের জায়গায় ব্যাপক পরিবর্তন আনা। যার মাধ্যমে স্বেচ্ছাশ্রমে প্রতিটি উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালিত হবে। শিল্পভিত্তিক কৃষি খামারে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার মাধ্যমে বিশাল জনগোষ্ঠীর আয় নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু সে কর্মসূচি শেষ পর্যন্ত ‘ব্যর্থ’ হয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীনের বর্তমান অগ্রগতি যেভাবে এগোচ্ছে তাতে খুব অল্প সময়েই তা মার্কিন অর্থনীতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামার আশঙ্কা করছে আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদরা ভারত ও চীনের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। সম্প্রতি বেইজিং অলিম্পিকের ম্যানেজমেন্ট (ব্যবস্থাপনা) দেখে অবাক হয়েছে বিশ্ব। কারণ অর্থনৈতিক ভিত মজবুত না হলে এ ধরনের একটি বিশ্ব আসর এতো সুন্দরভাবে শেষ করা হয়তো সম্ভব হতো না।
চীনের রাজনীতি সমাজতান্ত্রিক হলেও বর্তমানে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় পুরোমাত্রায় ভর করেছে পুঁজিবাদ। দেশটির ছোট বড় প্রায় প্রতিটি শহরে এর প্রমাণ মিলেছে ম্যাগডোনালসের বার্গার শপ দেখে। বিশেষ করে ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ‘বিপর্যয়ের’ পর চীনা অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের অনুপ্রবেশ ঘটে, যা বর্তমানে দেশটির অর্থনীতিকে ‘চাঙ্গা’ করে রেখেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে চীন বিপ্লবের সংগঠিত হলেও খুব অল্প সময়ে চীনের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা বিশ্ব অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখছে।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor