Friday, February 27, 2009

উত্তরাঞ্চলের আলুচাষিদের মাথায় ১০ হাজার কোটি টাকা দেনা

১৯.০২.০৯
ডেসটিনি ।। সুমন হাসান/নজরুল মৃধা, রংপুর থেকে

‘আলুর দাম যেমুন কমতছে তাতে মোর বস্তা প্রতি প্যারায় ৩০০ টাকা লোকসান হবার নাগছে। গেলোবার ভালো দাম পাইছিনু। তাই এইব্যার ধারদেনা করি আলু খেতত নাইগাইসিনু। কিন্তু আশা মতন ফলন না হওয়ায়, আর দাম কমি যাওয়ায় মোরগুলার অবস্থা ক্যারাসিন। মুই দেনা কি করি শোধ করিম। ছৈল, পৈলক কি খিলাইম। এই চিন্তাত মুই অস্থির। এবার ঠাঁইমোক মরা খাইবে।’ সারা মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথাগুলো বললেন রংপুরের পীরগাছা উপজেলার কল্যাণী ইউনিয়নের স্বচাষ গ্রামের আলু চাষি বুলবুল। এমন অবস্থা কেবল বুলবুলেরই নয়, পুরো উত্তরাঞ্চলের দেড় লক্ষাধিক আলু চাষির। তারা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে এখন দিশেহারা। চলতি মৌসুমের শুরু থেকেই অনেক প্রত্যাশা নিয়ে চাষিরা মাঠজুড়েই আরম্ভ করেছিল আলু চাষ। কারণ একদিকে গেল বছর হয়েছিল আলুর বাম্পার ফলন ও পেয়েছিল ভালো দাম। তাই এবার কৃষকরা দেনা করে হলেও জোরালোভাবে আলু চাষে ঝুঁকেছিল। ধারদেনা করতেও পিছপা হয়নি। এমনকি অনেকে জমি লিজ নিয়েও আলু আবাদ করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা হওয়ার তাই হয়েছে। বিভিন্ন এনজিও, দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আজ তারা বড় বেকায়দায়। আর এর অন্যতম কারণ লেটব্লাইট রোগের সংক্রমণে ফলন ও দাম কমে যাওয়া। ফলে ঋণের দায় থেকে মুক্ত হতে চাষিরা অপরিপক্ব আলু জমি থেকে তুলে বাজারে বিক্রি করছে উৎপাদন খরচের চেয়ে প্রতি বস্তায় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা লোকসানে।
রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট কুড়িগ্রাম, নীলফামারীসহ এ অঞ্চলের মাঠপর্যায়ের কৃষকদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে প্রকাশ, গত বছর এক বিঘা আলু আবাদ করতে চাষ থেকে আরম্ভ করে আলু উত্তোলন পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। আবার এলাকাভেদে তা ২০ হাজার ছাড়িয়েছিল। কিন্তু এবার সমপরিমাণ জমি আবাদ করতে চাষিদের খরচ হয়েছে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, গত বছর বাম্পার ফলন হওয়ায় উৎপাদিত ৮৫ কেজির বস্তার খরচ পড়েছিল ৪৮০ টাকা থেকে সাড়ে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার টাকায়। এর অন্যতম কারণ হিসেবে জানা গেছে, গত বছর প্রতি বস্তা টিএসপি সারের দাম ছিল সাড়ে ৭০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা; যা এবার কৃষকদের কিনতে হয়েছে সাড়ে ৩ হাজার থেকে প্রায় ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। তেমনি ২৯৫ টাকার ইউরিয়া এবার কিনতে হয়েছে প্রায় ৬০০ টাকায়। ১২০০ টাকার ভিটামিন গ্রুপের ওষুধ কিনতে হয়েছে আড়াই থেকে ৩ হাজার টাকায়। এভাবে বিভিন্ন বালাইনাশক ওষুধ কিনেছে দ্বিগুণেরও অধিক দামে। এ ছাড়াও লেবার, সেচসহ অনান্য খাতে খরচ হয়েছে গতবারের তুলনায় অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, অধিক দামে ওষুধ কিনে তা জমিতে ব্যবহারের মাধ্যমে মড়ক রোগ দমন করতে গিয়ে আলুর গাছ জীবিত থাকলেও মাটির নিচের আলু পচে গেছে। আলুর সাইজ হয়েছে ছোট। যার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। তা ছাড়াও ফলন আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কায় অপুষ্ট আলু জমি থেকে তুলতে মরিয়া হয়ে পড়েছে। এসব আলু কোল্ড স্টোরেজ করার উপযোগী না হওয়ায় সংরক্ষণের অভাবে বাজারে কমমূল্যে ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন চাষিরা। যার কারণে বাজারে আলুর দাম কমে গেছে অনেকের মন্তব্য।
স্থানীয় বাজার ঘুরে দেখা গেছে, নতুন আলু বিক্রি হচ্ছে প্রতি বস্তা ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। অথচ গত বছর এ সময়ে প্রতি বস্তা আলু বিক্রি হয়েছিল ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। ফলে প্রতি বস্তা আলুতে চাষিরা লোকসান গুনছেন ৩৫০ থোক ৪০০ টাকা। এ অবস্থার উত্তোরণ করা না গেলে উত্তরাঞ্চলের ৪০ হাজার ক্ষুদ্র, ২০ হাজার বর্গা ও ২৫ হাজার জমি লিজে নেয়া চাষি লাভ তো দূরে থাক উৎপাদন খরচই তুলতে পারবে না বলে চাষিরা বলছেন।
আঞ্চলিক খামারবাড়ি একটি সূত্র জানায়, অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত বছর উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ হয়। যা থেকে আলু প্রতি হেক্টরে গড়ে ২০ মেট্রিক টন করে অর্থাৎ ৫০ লাখ টনের ওপরে আলু উৎপাদন হয়েছিল গত বছর। আর আলু উত্তোলনের সময় যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এবার ২ লাখ ৮৬ হেক্টর অর্থাৎ ৮ লাখ ৫৮ হাজার একর জমিতে আলুর চাষ করেছেন চাষিরা।
পীরগাছা উপজেলার আলু চাষি আফতাব হোসেন জানান, উৎপাদন খরচের সঙ্গে ফলন ও বিক্রয় মূল্যের আকাশ-পাতাল ব্যবধানের কারণে আমাদের ঘুম নেই। ভারত থেকে যদি আলু আরো অধিকহারে দেশে প্রবেশ করে তবে আলুর দাম প্রতি বস্তা ৫০০ টাকার নিচে নেমে যাবে, যা হবে এই অঞ্চলের আলু চাষিদের জন্য বড় সমস্যা। তার দাবিÑ এ অঞ্চলের চাষিদের কাছ থেকে সরকারিভাবে হাজার টাকা দিয়ে প্রতি বস্তা আলু ক্রয় করা হোক। অন্যদিকে রাজশাহীর গোদাগাড়ীর হরিশংকপুরের চাষি আবুল কালাম, লালমনিরহাটের আদিতমারির মহিশখোচা চাষি ওবায়দুল ইসলাম, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের তিস্তা চরের চাষি আবদুল কুদ্দুস এমন ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
রংপুর চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী জানিয়েছেন, উত্তরাঞ্চলে বিকাশমান আলু উৎপাদনে ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থেই সরকারের কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ প্রয়োজন। নইলে আগামী মৌসুমে চাষিরা হয়তো আলু আবাদ থেকে সরে দাঁড়াবে।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor