Saturday, February 14, 2009

কৃষক ও কৃষির দিন বদল চাই

১৫.০২.০৯
ইত্তেফাক ।। আলী ইদ্রিস

এদেশের ৮০% মানুষ যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সবার জন্য খাদ্য উৎপাদন করে তাদের দারিদ্র্য দূর করতে না পারলে দেশের দারিদ্র্য দূর হবে না। এদেশের কৃষকের জীবনে প্রবৃদ্ধি অর্থাৎ সঞ্চয় ও উন্নতি কখনও দেখা যায় না। সারা বছর মাঠে খেটে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ওরা ফসল ফলালেও ওদের নূন আনতে পান্তা ফুরোয় অথবা দাদন ব্যবসায়ীরা ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে। এর সুস্পষ্ট কতকগুলো কারণ রয়ে গেছে- (ক) ফরিয়া. দালাল মজুতদারদের দৌরাত্মে ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় না (খ) ওরা সময় মতো ও ন্যায্যমূল্যে বীজ, সার, সেচ ওষুধ ও কীটনাশক পায় না (গ) ওরা সময় মতো কৃষি দপ্তরের মাঠ কর্মীদের দ্বারা অথবা রেডিও, টেলিভিশনের মাধ্যমে কৃষি পরামর্শ পায় না (ঘ) বন্যা খরায় ফসল নষ্ট হলে ওদেরকে সময় মতো ঋণ বা বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ দেয়া হয় না (ঙ) উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবে ওরা শহরে বা ক্রয়কেন্দ্রে ফসল পরিবহন করতে না পেরে অথবা দাদন ব্যবসায়ীর ঋণ পরিশোধ করার জন্য মাঠেই ফরিয়াদের নিকট ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। ফলে একদিকে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়ে, অন্যদিকে সে ন্যায্য বাজারমূল্য না পেয়ে লোকসানের মুখোমুখী হয়। এজন্য দারিদ্র্য তার নিত্যসঙ্গী। সঞ্চয় বা উন্নতি তার স্বাপ্নাতীত ব্যাপার। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কৃষিতে বিপ্লব ঘটাতে হবে। শিল্পে উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি আনতে হলে অতিরিক্ত পূঁজি বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়, তথাপি শিল্পে আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় না, কিন্তু সামান্য ভর্তুকি বাড়িয়ে, উন্নতমানের উপকরণ সরবরাহ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে কৃষিতে বিপ্লব ঘটানো যায়। (ক) উন্নতমানের ও হাইব্রিড বীজ সরবরাহ করা বিএডিসি ও কৃষি বিভাগের দায়িত্ব, কিন্তু দু’টি প্রতিষ্ঠানই এ কাজে ব্যর্থ হয়েছে, এদেরকে আরও কার্যকরী করে তুলতে হবে। বেসরকারী সংস্থাগুলো যারা বীজ সরবরাহ করে তাদেরকে সরকারের কৃষি বিভাগের ছাড়পত্র নিতে হবে যাতে তারা কৃষককে খারাপ বীজ দিয়ে ঠকাতে না পারে। দ্বিতীয় উপকরণ সার। এই সার নিয়ে কেলেঙ্কারি হয় না এমন কোন বছর নেই। ডিলারদের দাম বেঁধে দিলেও তারা উচ্চমূল্যে ইচ্ছামতো গ্রাহকের নিকট সার বিক্রয় করে অথবা সার লুকিয়ে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরী করে। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে ডিলারের সংখ্যা দ্বিগুণ, তিনগুণ করতে হবে। প্রাকৃতিক জৈব সারের উপকারিতা সম্পর্কে কৃষকদেরকে ওয়াকেফহাল করে ঐ সারের উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়াতে হবে, জৈব সার উৎপাদনে কৃষকদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ডিজেলের দাম কমানোর পরও সেচে প্রকৃত কৃষক ফায়দা পায় না, যারা পানি বিক্রি করে তারাই ফায়দা লুটে। এজন্য একর প্রতি সেচের দাম নির্ধারণ করে দিতে হবে এবং তা যাতে পালিত হয় স্থানীয় প্রশাসনকে নজরদারী করতে হবে। ওষুধ ও কীটনাশকের সরবরাহ করা উচিত বিএডিসি ও কৃষি বিভাগের, প্রশিক্ষণ দেয়ার দায়িত্বও তাদের। কিন্তু দু’টি সংস্থাই এ ব্যাপারে ব্যর্থ। বাধ্য হয়ে কৃষককে সেবরকারী কীটনাশক বিক্রেতার নিকট ধরণা দিতে হয় যারা ভেজাল ওষুধ ও কীটনাশক সরবরাহ করে এবং কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করে। (খ) কৃষক কখনই তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পায় না। মাঠে যে পণ্যের দাম ৫ টাকা ঢাকা শহরে এসে সেটা বেড়ে হয় ২০ টাকা। মাঝখানে ফরিয়া, দালাল পাইকার মুনাফা লুটে। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে সরকারকে প্রতিটি উপজেলায় টিসিবি বা কৃষি বিভাগের মাধ্যমে ক্রয়কেন্দ্র খুলতে হবে যেখানে থেকে শহরের ক্রয়কেন্দ্রে পণ্য আসবে। অন্যথায় সমবায়ের মাধ্যমে কৃষকরাই যাতে একটি ক্রয়কেন্দ্র খুলতে পারে তার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এটা করলে সারাদেশে পণ্যের খুচরা মূল্যও কমবে। সমবায় মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। সমবায়ের মাধ্যমে বীজ, সার সংগ্রহ এবং সেচ কাজও পরিচালিত হতে পারে। (গ) একই জলবায়ু আবহাওয়া বিশিষ্ট পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল থেকে আমরা চাল, মাছ, পিঁয়াজ, রসুন, ডাল, মসলা সবজি ফলমূল আমদানি করছি, অথচ একই আবহাওয়ায় আমাদের দেশেএ সব উৎপাদন করা সম্ভব। অথচ ভাল জাতের বিভিন্ন রকম বীজ, বারমাসী ফসল উৎপাদন পদ্ধতি, আধুনিক উপায় উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন করে কৃষককে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দিলে আমাদের দেশেও প্রয়োজন মতো এবং রপ্তানি করার মতো চাল, ডাল, সবজি, ফলমূল উৎপাদন করা যেতে পারে। এ দায়িত্ব কৃষি মন্ত্রণালয়ের । তাদের আরও দায়িত্ব কৃষি রিসার্চ করে উন্নত মানের ও পরিমাণে অধিক উৎপাদনশীল ফসল উদ্ভাবনও বাস্তবায়ন। আমাদের কৃষি মন্ত্রণালয়কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় হিসাবে গণ্য করা উচিত। সার, বীজ, ওষুধ, সেচের সরবরাহ নিশ্চিত করার পরও এ সমস্ত উপাদানের সাশ্রয়ী ব্যবহার, আধুনিকায়ন, রাসায়নিক উপাদানের বিকল্প জৈব উপাদান উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন। এ সমস্ত কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে দেশে কৃষি উৎপাদনে বিপ্লব ঘটানোর দায়িত্ব কৃষি মন্ত্রণালয়ের। কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়ে দেশের প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছানো যায়। (ঘ) প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন বন্যা, খরা, পোকার আক্রমণ, এ সব আমাদের দেশে লেগেই আছে। এ সব থেকে পুরোপুরি বাঁচা না গেলেও ক্ষয়-ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়। প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নিয়ে বন্যাও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। খরার বিকল্প সেচ, পোকা-মাকড়ের আক্রমণে রাসায়নিক ও জৈব ওষুধ প্রয়োগ। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ যদি নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে এবং বেসরকারী এনজিও বা বিদেশের সাহায্য নিয়ে এসব দুর্যোগের প্রতিকার করে তাহলে কৃষির ক্ষয়-ক্ষতি কমানো যায়। অতঃপর ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে গেলেও কৃষককে সুদবিহীন ঋণ দিয়ে পরবর্তী ফসল ফলানোর জন্য উৎসাহিত করা যায়।

কৃষি এদেশের কেন, যে কোন দেশের মেরুদণ্ড। উন্নত দেশও কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। আমরা তাহলে কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারব না কেন, আমার মতে স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে একদিন কৃষি পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব। সেই দিন অতিসত্বর আসুক- এই কামনা করি।

[লেখক : কথাশিল্পী ও চার্টার্ড একাউনটেন্ট]

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor