Friday, November 21, 2008

মানসম্পন্ন বীজ

১৮.১১.০৮
যায়যায়দিন ।। এম জি মহিউদ্দীন আহম্মদ

মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন করা জরুরি গমবীজের উৎপাদনশীলতা বাড়াতেও গবেষণা চলছে। গমের উচ্চ ফলনশীল বীজ উৎপাদনেও এগিয়ে যাওয়া জরুরি। পাশাপাশি রবি মৌসুমে চরাঞ্চল, হাওর, দেশের উত্তর জনপদে গম উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত করা জরুরি। শস্য বহুমুখী করার সুফল সম্পর্কে কৃষকদের অবগত করানো দরকার, যার মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে গম চাষ ও অন্যান্য রবিশস্যের আবাদ চলতে পারে। খাদ্যনিরাপত্তার জন্য গমের উৎপাদন বাড়ানোও অগ্রাধিকার পেতে পারে।
===========================
বাংলাদেশ পললঘটিত বিশ্বের সেরা ব-দ্বীপগুলোর একটিতে অবস্থিত বিধায় সুপ্রাচীনকাল থেকেই এ দেশে কৃষি উৎপাদন চলে আসছে। বহুমাত্রিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় এদেশে মাঝে মধ্যে হয়ে থাকে বিধায় এ দেশের জনগোষ্ঠী সাহসী ও উদ্যমী। তাই শত বাধাবিপত্তি মোকাবেলা করেই এ জনগোষ্ঠী জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। কৃষিতে ধারাবাহিক উৎপাদন নিশ্চিত করতে এ দেশের কৃষক সেই সুদূর অতীতকাল থেকে বীজ উৎপাদন ও বীজ সংরক্ষণে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। তবে জনসংখ্যা বাড়ার প্রেক্ষাপটে আবাদি জমিতে উৎপাদিত ফসল থেকে সবার খাদ্যের জোগান অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে খাদ্য আমদানি করতে হয়। জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে তাই উৎপাদন বাড়ানোর তৎপরতা চলতে থাকে। খাদ্যনিরাপত্তা গড়তে আন্তর্জাতিক তৎপরতার সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব সৃষ্টি হয় ষাটের দশক থেকে। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ওজজও)-এর সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। পাশাপাশি বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট, উদ্যান গবেষণা ইন্সটিটিউট এসব প্রতিষ্ঠানও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুরুতে ইরি থেকে বীজ সংগ্রহ করে চুক্তিবদ্ধ চাষের মাধ্যমে এ দেশেই ধানের বীজ উৎপাদন করা হয় এবং কৃষকের মাঝে সরবরাহ হতে থাকে। বাড়তে থাকে ধানের উৎপাদনশীলতা। পরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের অব্যাহত গবেষণার মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল ধান বীজ উদ্ভাবন, উৎপাদন ও কৃষকদের কাছে জোগান দেয়া চলমান আছে। কৃষকরা এ দেশের বীজ ব্যবহার করে ধানের উৎপাদন অব্যাহতভাবে বাড়াতে সক্ষম হচ্ছে। তবে ইতিমধ্যে হাইব্রিড খ্যাত উচ্চ ফলনশীল ধানবীজও কৃষকদের সরবরাহ করা হচ্ছে। হাইব্রিড ধানবীজ বহুজাতিক কোম্পানির মাধ্যমে কৃষকদের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে, যা থেকে কৃষকরা আবার বীজ উৎপাদন করতে পারছে না। এ প্রেক্ষাপটে এ ধরনের হাইব্রিড বীজ ব্যবহারকারী কৃষককে কোম্পানির সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করা হচ্ছে। বর্তমানে কৃষকরা হাইব্রিডের প্রতি ঝুঁকে পড়লেও দুটি কারণে ভীতও বটে। একটি কারণ হলো উচ্চ মূল্যে বীজপ্রাপ্তি এবং কোম্পানির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হলে অব্যাহত ব্যয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা। অন্য কারণটি হলো বীজের মান নিয়ে। জমিতে বীজ বপন বা রোপণের পর সন্তোষজনক উৎপাদন বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট উদ্ভাবিত বীজ বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে পৌঁছানো হয়, যার মান সম্পর্কে কোনো সংশয় নেই। এ বীজের ওপর কৃষকদের নিয়ন্ত্রণ বিদ্যমান থাকায় কৃষকশ্রেণীর কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা দীর্ঘকাল থেকেই রয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ছাড়াও বিনা (ইওঘঅ) উদ্ভাবিত ধানবীজও উচ্চ ফলনশীল। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ও বিনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান দুটির কার্যক্রম অব্যাহত সম্প্রসারণের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে ধানের বীজ উৎপাদন ও কৃষকের কাছে জোগান দেয়ার তৎপরতা বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সাফল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বহুজাতিক কোম্পানির ওপর কৃষকদের নির্ভরশীলতা সৃষ্টি হবে না এবং কৃষকরা সাশ্রয়ী মূল্যে বীজের জোগানও পেতে পারবে।
আন্তর্জাতিক করপোরেট তৎপরতা ধানবীজ গবেষণায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান দুটির সম্প্রসারণ তৎপরতায় বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করতে তৎপর হতে পারে। এ ধরনের অবস্থায় দেশজ বিনিয়োগের মাধ্যমে ধান গবেষণা কার্যক্রম সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখা দরকার, পাঁচ দশক ধরে এ দেশের কৃষক উচ্চ ফলনশীল ধান উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণেও তাদের অভিজ্ঞতা কম নয়। এ অবস্থায় উচ্চ ফলনশীল বীজের ওপর এ দেশের কৃষকদের স্বনির্ভরতাকে সংরক্ষণ করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। উল্লেখ্য, দাতাগোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করে এ দেশের পাট উৎপাদন ও পাটনির্ভর শিল্পকারখানা বিলীন হওয়ার পথে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশে দাতাগোষ্ঠীর সহায়তায় পাটের উৎপাদন ও শিল্পের প্রসার অব্যাহতভাবে চলমান। দেশের পাট গবেষণা ইন্সটিটিউট চলমান সময়ে মৃতপ্রায়। এটিকেও জীবিত করা জরুরি। এখান থেকেও উচ্চ ফলনশীল পাটবীজ উদ্ভাবনের তৎপরতা চালানো জরুরি। বিশ্বে পরিবেশ সচেতনতা বাড়ার ফলে পাটের চাহিদা বাড়বে এতে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। শুধু কাঁচা পাট নয় পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ারও বিপুল সম্ভাবনা বিরাজমান। তাই পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠানটিকে বহুমাত্রিক গবেষণায় সম্পৃক্ত করার ব্যবস্থা নেয়াও জরুরি। পাটের বহুমাত্রিক ব্যবহারের ওপর নিবিড় গবেষণা কাজ পরিচালনা করা বিবেচ্য। এক সময় এ দেশে পাট ও পাটজাত পণ্য ছিল শীর্ষ রপ্তানি খাত, যা বর্তমানে সারির শেষদিকে অবস্থান করছে। এ অবস্থার পরিবর্তন করা অসম্ভব নয় বরং অব্যাহত কার্যকর তৎপরতা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে স্বল্পতম সময়েই পাট নিজ অবস্থান ফিরে পেতে পারে। এ তৎপরতায় প্রথমেই উচ্চ ফলনশীল পাটবীজ উদ্ভাবনের নিমিত্ত পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠানটিকে তাৎক্ষণিকভাবে ঢেলে সাজানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
গমবীজের উৎপাদনশীলতা বাড়াতেও গবেষণা চলছে। গমের উচ্চ ফলনশীল বীজ উৎপাদনেও এগিয়ে যাওয়া জরুরি। পাশাপাশি রবি মৌসুমে চরাঞ্চল, হাওর, দেশের উত্তর জনপদে গম উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত করা জরুরি। শস্য বহুমুখী করার সুফল সম্পর্কে কৃষকদের অবগত করানো দরকার, যার মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে গম চাষ ও অন্যান্য রবিশস্যের আবাদ চলতে পারে। খাদ্যনিরাপত্তার জন্য গমের উৎপাদন বাড়ানোও অগ্রাধিকার পেতে পারে। গমের পাশাপাশি ভুট্টা চাষেও নজর দেয়া দরকার। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভুট্টা চাষে কৃষকরা সক্রিয় হচ্ছে। ভুট্টা চাষে ব্যয়ের পরিমাণ কম হয় বিধায় কৃষকরা অধিক লাভবান হতে পারে। মাছের খাদ্য, পোলট্রি ফিড এবং গোখাদ্য উৎপাদনে ভুট্টার ব্যবহার রয়েছে বিধায় ভুট্টাচাষ অব্যাহতভাবে বাড়ার সম্ভাবনা বিরাজমান। এ প্রেক্ষাপটে ভুট্টা বীজের উচ্চ ফলনশীলতা নিশ্চিত করতেও গবেষণা জরুরি।
আমাদের দেশে উৎপাদিত ডালের স্বাদ বেশি বিধায় ডালবীজের ক্ষেত্রেও গবেষণার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। তৈল উৎপাদন বাড়াতেও বীজের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো জরুরি।
শাকসবজির মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হলে উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। শাকসবজির উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো সম্ভব হলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ইতিবাচক ভূমিকা থাকবে। কেননা আন্তর্জাতিক বাজারে শাকসবজির বিপুল চাহিদা বিদ্যমান। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে শাকসবজি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানি বাজার বিরাট বিধায় শাকসবজির উৎপাদন অব্যাহতভাবে বাড়ানো সম্ভব হলে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়ানো জরুরি। এ কাজের জন্য বহুমাত্রিক তৎপরতার মাঝে মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনে স্বাবলম্বী হওয়া জরুরি। মানসম্পন্ন বীজের জন্য বিদেশনির্ভরতা ছাড়তে হবে। উন্নতমানের বীজ উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব হলে এ দেশের কৃষকরা কৃষির প্রতিটি উপখাতে উৎপাদন বাড়ানোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সাফল্য নিশ্চিত করতে পারবে। তাই এ কাজটি গুরুত্ব সহকারে করা উচিত।

এম জি মহিউদ্দীন আহমদ: কলাম লেখক, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor