Friday, November 28, 2008

খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির প্রশ্নে অগ্রাধিকার দিতে হইবে

২৪.১১.০৮
ইত্তেফাক ।। সম্পাদকীয়

বৃষ্টি কম হইলে, এমনকি সেচ ছাড়াই খরাপ্রবণ জমিতে দ্বিগুণ ধান উৎপাদনের সম্ভাবনা খুঁজিয়া পাইয়াছেন যুক্তরাষ্ট্রের আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক। ফিলিপিনসের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ইরি) এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলে তিনি এই গবেষণা কর্মটি পরিচালনা করেন। গবেষক দেখিতে পান যে, ধানের মধ্যে এমন কিছু জিন রহিয়াছে, যেইগুলি শুষ্ক মাটির গভীর হইতে পানি শুষিয়া নিয়া ভালভাবে ফলবতী হইয়া উঠিতে পারে। গত ২৩ নভেম্বর, রবিবার একটি ওয়েবসাইটের বরাত দিয়া খবরটি ছাপা হইয়াছে পত্রিকান্তরে।

খাদ্য সমস্যা যখন বিশ্বজুড়িয়া প্রবল হইয়া দেখা দিতে শুরু করিয়াছে, তখন শুষ্ক জমিতে দ্বিগুণ ধান উৎপাদনের সম্ভাবনার খবর নিঃসন্দেহে কৌতূহল উদ্দীপক এবং উৎসাহব্যঞ্জক। বিশ্ব প্রেক্ষাপটে খাদ্যশস্য হিসাবে গমের পরেই ধানের অবস্থান। পৃথিবীর প্রায় ৪০ শতাংশ লোকের প্রধান খাদ্য ধান হইতে প্রাপ্ত চাউল। ভাতই হইল এশিয়ার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রিয় ও প্রধান খাদ্য। ভাতে ক্যালরির মাত্রাও বেশি। বাংলাদেশে বলিতে গেলে শতকরা একশতভাগ মানুষই ভাতের উপর নির্ভরশীল। কাজেই ধানের উৎপাদন বাড়াইতে না পারিলে, কিংবা কোনো কারণে উৎপাদন হ্রাস পাইলে এইখানে প্রকট হইয়া দেখা দেয় খাদ্য সমস্যা। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করিতে হইলে আমাদের ধানের উৎপাদন বাড়াইতেই হইবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় যে, উচ্চ ফলনশীল ধানের আবাদ, সেচ সম্প্রসারণ এবং অন্যবিধ আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির কল্যাণে গত সাড়ে তিন দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশে বৎসরে ধানের উৎপাদন দ্বিগুণ হইয়াছে। বিঘাপ্রতি ফলন যেমন বাড়িয়াছে, তেমনই বাড়িয়াছে ধান চাষের জমি, যদিও মোট আবাদী জমির আয়তন কমিয়া গিয়াছে। রবিশস্য ও পাটের চাষ হ্রাস পাওয়ায় ধানের জমি বাড়িয়াছে। অন্যদিকে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দ্রুত কমিয়া যাইতেছে আবাদি জমি। প্রতিদিনই কিছু না কিছু ফসলের জমি চলিয়া যাইতেছে শিল্প-কারখানা, বাড়িঘর কিংবা নানা স্থাপনার কাজে। ইহা এমন এক বাস্তবতা, যাহা রুখিয়া দেওয়া সহজ নয়।

এমতাবস্থায় কম জমিতে অধিক ফসল ফলাইবার নীতি-কৌশল আমাদের গ্রহণ করিতে হইয়াছে এবং ইহা বাস্তবে খুবই ফলপ্রসূ বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে। তবে কৃষি ও খাদ্যোৎপাদনে এই যাবৎ যেটুকু সাফল্য অর্জিত হইয়াছে তাহা সন্তুষ্ট হওয়ার পক্ষে মোটেও যথেষ্ট নহে। অধিক খাদ্যোৎপাদনের একটি স্থায়ী ও মজবুত অবকাঠামো এখন সম্পূর্ণভাবে গড়িয়া তোলা সম্ভব হয় নাই। এই ক্ষেত্রে আমাদের কৃষির সমস্যাবলি যেমন সঠিকভাবে চিহ্নিত করা দরকার, তেমনই এই দেশের জমির বৈশিষ্ট্যের সহিত মিল রাখিয়া সদ্ব্যবহার করিতে হইবে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির। বাংলাদেশে জমির প্রকৃতি সর্বত্র একরূপ নয়। কিছু উঁচু এলাকা আছে, যেইখানে সেচ ছাড়া ধানের আবাদ করা কঠিন। সময়মত বৃষ্টিপাত না হইলে এবং পর্যাপ্ত সেচের ব্যবস্থা করা না গেলে সেইসব জমিতে ফসল মার খায়, কোন কোন ক্ষেত্রে জমি পতিত পড়িয়া থাকে। আবার নিচু এলাকায় ফসলের এমন মাঠও রহিয়াছে, যেইখানে বর্ষাকাল আসিতে না আসিতেই জলমগ্ন হইয়া যায়। ফসল নষ্ট হইয়া যায়। এই ধরনের প্রতিকূল অবস্থার কারণেও বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন কমিয়া যায়।

এই পরিস্থিতিতে খরা ও বন্যা সহনশীল জাতের ধান আবাদ করিলে অবশ্যই সুফল পাওয়া যাইবে। দেশি জাতের এমন অনেক ধান অতীতে এইখানে ছিল যেইগুলি এই দেশের প্রকৃতির সহিত খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ। অধিক উৎপাদনে অত্যন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ সেইসব ধানের জাত অধিকাংশই হারাইয়া গিয়াছে। হারানো সেই ধানগুলির পুনরুদ্ধার এবং জাত উন্নয়নের মাধ্যমে সুফল পাওয়া যাইতে পারে। ধানের মধ্যে মাটির গভীর হইতে পানি বা রস শুষিয়া নিতে সক্ষম যে জিনের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে, সেই সূত্র ধরিয়া দেশি ধানের জাত উন্নয়ন সম্ভব কিনা, তাহা এই দেশের আমাদের কৃষি বিজ্ঞানীদেরও গবেষণার সুযোগ করিয়া দিবে। নতুবা কয়েকটি দেশে সাম্রাজ্যবাদী কায়দায় বীজ সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের যে গোপন চেষ্টা চলিতেছে, সেই ফাঁদে পড়িয়া যাইতে পারে বাংলাদেশ। বন্যা ও খরা সহনশীল এবং উচ্চফলনযোগ্য ধানবীজ উদ্ভাবিত হইলে, অথবা দেশি ধানের জাত উন্নয়ন করা সম্ভব হইলে এই দেশে ধানের উৎপাদন বাড়িবে নিশ্চয়ই। এই ব্যাপারে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের আগাইয়া আসা উচিত। মনে রাখিতে হইবে যে, ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করিতে না পারিলে অদূর ভবিষ্যতে খাদ্য সমস্যা আরও প্রকট হইবে। খাদ্য আমদানি খাতে ব্যয় বাড়িবে, সমস্যা দেখা দিবে নানা দিক দিয়া। বলাই বাহুল্য, খাদ্য সমস্যার সহিত দারিদ্র্যের সম্পর্ক ওতপ্রোত। খাদ্যাভাব দারিদ্র্যের পরিধি বাড়াইয়া দেয়। জাতীয় উন্নয়নের পথে দারিদ্র্যই সবচাইতে বড় বাধা। কাজেই উৎপাদন বাড়াইয়া খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের বিষয়টিকে আমাদের গ্রহণ করিতে হইবে অগ্রাধিকারভিত্তিতে।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor