Saturday, November 22, 2008

জাতীয় কৃষক দিবস এনেছে নতুন মাত্রা ।। রাউজান, নন্দীগ্রাম ও মিঠাপুকুরের মাঠে মাঠে সোনালি হাসি, পিঠা-পুলির ঘ্রাণ

২১.১১.০৮
ডেসটিনি ।। রাউজান (চট্টগ্রাম), নন্দীগ্রাম (বগুড়া) ও মিঠাপুকুর (রংপুর) প্রতিনিধি

দুঃখের পর সুখ আসেÑ এ কথা সত্য মেনে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে কৃষকরা আমন ধানের চাষ করেছিল সেই ফসল এখন ঘরে আসতে শুরু। আর তাই কৃষকের চোখে-মুখে হাসি যেন ধরছে না। এমন চিত্র রাউজানের কৃষাণ-কৃষাণিদের মাঝে। ইতিমধ্যেই তাদের গোলায় উঠতে শুরু করেছে রোপা আমন ধান। মাঠে মাঠে চলছে চলতি মৌসুমের ধান কাটা। উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়নের গ্রামগুলোয় কৃষকরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মাঠে। আর কৃষাণিরা সেই ধান মাড়াইয়ের জন্য বাড়ির উঠোনে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। এ বছর রাউজান উপজেলার ১২ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের চাষ করেছেন কয়েক হাজার কৃষক। ধান বীজ বপনের শুরু থেকেই রোগবালাই, ঝড়-ঝাপ্টা, জলোচ্ছ্বাসসহ সর্বশেষ কার্তিক মাসে টানা দুদিনের বৃষ্টি আর দমকা হাওয়ায় রাউজানের বহু এলাকায় পাকা, আধাপাকা ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কিন্তু বাড়তি মনোবল নিয়ে রাউজানের কৃষকরা মাঠে ফলিয়েছে আমন ধান। আর তাই কৃষকদের ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব। ইতিমধ্যে নতুন চালের পিঠা বানানোর ধুম পড়েছে কৃষাণিদের মাঝে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ফলন ভালো। গত বছর একটানা বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে ৬ থেকে ৮ হাজার হেক্টর ফসলী জমির ধানের চারা নষ্ট হয়ে গেছে। তবে এবার ফলন ভালো হলে গত বছরের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে যাবেÑ এমন আশা করছেন নোয়াপাড়ার সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. সোহেল, আনোয়ার ছবুর ও মিল্টন। তবে রাউজান দক্ষিণ অংশের কয়েকটি ইউনিয়নের নিচু এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে থাকায় ঝরে যাওয়া ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান সমিতির সভাপতি চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম জানান, হালদা ও কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সংযোগ খালগুলোয় পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ায় নিচু এলাকার পানি ঠিক সময়ে সরতে না পারায় ধানের ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া আগামী শুষ্ক মৌসুমে খালে পানি ঢুকতে না পারলে বহু এলাকায় বোরো চাষ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, কোনো কোনো এলাকায় নতুন নতুন ঘরবাড়ি, দালান-কোটা গড়ে তুলেছে। কৃষি জমির ওপর এসব বাড়ি এবং চলাচলের নতুন রাস্তা গড়ে তোলায় পানি চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে কোনো কোনো স্থানে চাষ হচ্ছে না। আবার কোথাও চাষ হলেও পরেরবার পানি জমে ধান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। কোথাও কোথাও নদীর ব্যাপক ভাঙনে বহু ফসলী জমি নদীগর্ভে চলে যাচ্ছে। এরপরও কৃষকরা থেমে নেই।
কৃষকের ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব আমাদের নন্দীগ্রাম প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। কৃষকের ঘরে ঘরে চলছে হেমন্তের নবান্ন উৎসবের আমেজ। কৃষকরা অগ্রহায়ণের প্রথম দিকেই আমন ধান কেটে বাড়ির উঠানে নিয়ে আসেন। ধান কাটার পর বাংলার কৃষক সমাজ প্রাচীনকাল থেকে নবান্ন উৎসব পালন করে আসছে। কালের বিবর্তনে অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও কৃষকরা নবান্ন উৎসবের কথা ভুলে যাননি। গ্রাম-বাংলার কৃষকরা নবান্ন উৎসব পরিপূর্ণভাবে উদযাপনের জন্য জামাই-ঝি আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আমন্ত্রণ করে এনে নতুন চালের পিঠা, পোলাও, পায়েসসহ বিভিন্ন রকমারি নিত্যনতুন খাবার তৈরি করে ভোজের আয়োজন করে। গ্রাম্যবধূরা জামাইকে সঙ্গে নিয়ে বাপের বাড়িতে নবান্নের জন্য আগ্রহে অপেক্ষা করেন। নবান্ন উৎসবে গ্রামের কৃষকরা মিলেমিশে গরু, মহিষ, খাসি জবাই করে এবং হাট-বাজারের সেরা বড় মাছ কিনে আনেন। বাংলার মুসলিম কৃষক সমাজে অগ্রহায়ণের প্রথম শুক্রবার থেকে নবান্ন উৎসব শুরু হয়। অপরদিকে সনাতন (হিন্দু) সমাজের কৃষকরা তাদের পঞ্জিকা অনুসারে পয়লা অগ্রহায়ণ নবান্ন উৎসব পালন করেন।
নন্দীগ্রাম উপজেলার তেঁতুলীয়াগাড়ীর কৃষক আলহাজ আ. সামাদ জানান, এ বছর প্রতি বিঘা জমিতে জাতভেদে ১৩/১৪ মণ ধান উৎপাদন হয়েছে। তিনি জানান, ধানের দাম খরচের তুলনায় বেশ কম। দলগাছা গ্রামের কৃষক আলহাজ মোখলেছার রহমান জানান, চলতি মৌসুমে আমি ৪৫ বিঘা জমিতে বিআর-৩২, বিআর-৩৪, শিলকুমার, পাইজাম ধান আবাদ করেছি। ধান কাটা শুরু হয়েছে। ফলন ভালো, তবে বাজারে ধানের দাম কম বলে হতাশ হচ্ছি। প্রতি বিঘা জমিতে এবার খরচ করতে হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা, অথচ ধান বিক্রি করে আবাদের খরচ তোলাই কঠিন হয়ে পড়েছে। বর্তমান বাজারে ধানের মূল্য বিআর-৩২, ৪৫০-৫০০ টাকা, পাইজাম (নেপালি) ৫৫০-৬০০ টাকা, পাইজাম (সাদা) ৫০০-৫৫০ টাকা ও পাইজাম ৬৫০-৭০০ টাকা।
চলতি আমন মৌসুমে নন্দীগ্রাম উপজেলায় ২১ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ৭৮ হাজার ৩৪৫ মেট্রিকটন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।
মিঠাপুকুর (রংপুর) প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় এবার আমন ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। মাঠজুড়ে যেদিকে চোখ যায় শুধু সোনালি ধানের সমারোহ। কৃষকের ঘরে ঘরে চলছে নবান্নের উৎসব। এবার পয়লা অগ্রহায়ণে প্রথমবারের মতো জাতীয় কৃষি দিবস পালিত হওয়ায় কৃষকদের আনন্দে নতুনমাত্রা পেয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা জানান, প্রস্তাবিত মিঠাপুকুর পৌর এলাকাসহ উপজেলার ১৭টি ইউনিয়নে ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। এবার বন্যায় দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় আমন ক্ষেত বিনষ্ট হলেও রংপুরের মিঠাপুকুর ও পাশের উপজেলায় বন্যার প্রভাব পড়েনি এবং বর্ষণের ফলে প্রাকৃতিকভাবে জমিতে নাইট্রোজেনের অভাব পূরণ হয়েছে। এ কারণে অল্প পরিমাণে ইউরিয়া প্রয়োগেই ফল হয়েছে ভালো। এবার আমন ক্ষেতে রোগ-বালাই ও পোকামাকড়ে আক্রমণ ছিল কম। ইতিমধ্যে বিস্তৃত মাঠের সোনালি আমন ধান পেকেছে। এলাকায় কাটা ও মাড়াই শুরু হয়েছে। বুজরুক, সন্তোষপুর ও পলাশটাড়ী গ্রামের আবুল কাশেম, বেলকোলা গ্রামের আনিছার রহমান, আবুল কালাম আজাদ, পলাশটাড়ী গ্রামের রেজবানুল ইসলাম, আন্দারকোটা গ্রামের সেরাজুল ইসলামসহ অন্যরা জানান, এবার একরপ্রতি উন্নত জাতের ধান-৬৫-৭০ মণ, ব্রি জাতের ধান-৪৫-৫০ মণ হারে ফলন হয়েছে। মিঠাপুকুর উপজেলার প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা শুকুরের হাটে প্রতিমণ নতুন ধান বিক্রি হচ্ছে ৪৯০ থেকে ৫০০ টাকা দরে।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor