Wednesday, November 12, 2008

কৃষি-শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি আইন ও কিছু সুপারিশ

১.১১.০৮
যায়যায়দিন ।। জাহিদ রহমান
একথা সত্য যে, জাতীয় উন্নয়ন অগ্রগতির যে লক্ষ্যই নির্ধারণ করা হোক না কেন, দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ লোক তথা গ্রামীণমজুরের জীবন ও জীবিকার দাবিকে উপেক্ষা করে তা অর্জন করা সম্ভব নয়। কৃষি-শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের মাধ্যমে তার শ্রমের যথার্থ মূল্যায়ন করা জরুরি। কৃষিশ্রম (ন্যূনতম মজুরি) অধ্যাদেশ ১৯৮৪ প্রবর্তিত হলেও সেটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আইন থাকা সত্ত্বেও কৃষি-শ্রমিকের শ্রমের মূল্যায়ন হচ্ছে না।

বাংলাদেশে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণী কৃষি শ্রমিক বা ক্ষেতমজুর। কৃষিকর্মে শ্রম বিক্রি করাই মূলত যাদের আমৃত্যু পেশা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা বিভিন্ন ধরনের কৃষিকর্মে শ্রম বিক্রি করে থাকেন। শ্রম বিক্রির মাধ্যমে প্রাপ্ত মজুরি তাদের জীবন ও জীবিকার প্রধান অর্থনৈতিক উৎস। শ্রম বিক্রির সুযোগ না থাকলে তাদের বেকার থাকা ছাড়া বিকল্প কোনো কর্ম নেই। অথচ শ্রমিক হিসেবে তাদের ন্যায্য মজুরি বা পারিশ্রমিক পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ শ্রমিকের জন্য কোনো কার্যকর সুনির্দিষ্ট মজুরিনীতি নির্ধারণ হয়নি। দুই দশকেরও বেশি আগে এরশাদ জমানায় কৃষি শ্রমিক তথা ক্ষেতমজুরদের ন্যায্য শ্রমমজুরি নিশ্চিত করার জন্য সরকার ‘কৃষিশ্রম (ন্যূনতম মজুরি) অধ্যাদেশ ১৯৮৪’ নামে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হলেও তার প্রয়োগ কোথাও হয়েছে বলে প্রমাণ নেই। স্বভাবতই দেশের বিপুল সংখ্যক কৃষি শ্রমিক তাদের ন্যায্য অধিকার ও পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
১৯৯৬ সালের সবশেষ কৃষিশুমারি অনুযায়ী গ্রামের প্রায় ৬৫ ভাগ পরিবার গ্রামীণ-মজুরের সংজ্ঞার আওতাভুক্ত। বাংলাদেশে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণী। সরকারিভাবে তাদের বলা হয় গ্রামীণ দরিদ্র। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৬-এর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী প্রত্যক্ষ ক্যালোরি গ্রহণ পদ্ধতিতে বাংলাদেশে গ্রামীণ দরিদ্রের হার ৪০.১ ভাগ। এর মধ্যে ১৮.২ ভাগ রয়েছে চরম দরিদ্রাবস্থায়। ১৯৯৯-২০০০ সালের হিসাব অনুযায়ী কৃষি-অকৃষি উভয় খাত মিলিয়ে বাংলাদেশে গ্রামীণ মজুরের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি।
দেশ বিভাগের আগে বা পরে প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে কৃষিমজুর বা একজন ক্ষেতমজুরের শ্রম ও তার ন্যূনতম মজুরি সম্পর্কে কোনো বিধিবদ্ধ আইন ছিল না। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ১৯৮৪ সালে এ সম্পর্কে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। ‘কৃষিশ্রম (ন্যূনতম মজুরি) অধ্যাদেশ ১৯৮৪’ হলো, কৃষি-শ্রমিকদের জন্য অর্থাৎ কৃষিজ শস্য উৎপাদনে নিয়োজিত যে কোনো ব্যক্তির মজুরির নিম্নতম হার স্থিরকরণের জন্য বিধান প্রণয়নকল্পে অধ্যাদেশ। একজন কৃষি-শ্রমিকের একদিনের মজুরি হিসাবে ৩ কেজি ২৭০ গ্রাম চাল অথবা স্থানীয় বাজারে ওই পরিমাণ চালের যে বাজার মূল্য, তার সমপরিমাণ টাকা প্রদান করতে হবে; সরকার ৪ ধারার ১ নম্বর উপধারার অধীনে গঠিত কৃষিশ্রমের ন্যূনতম মজুরি ও মূল্য পরিষদের সুপারিশক্রমে স্থিরকৃত মজুরির ন্যূনতম হার সময়ে সময়ে অফিসিয়াল গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে পুনর্নির্ধারণ করতে পারে; সরকার ২ নম্বর উপধারার অধীনে পুনর্নির্ধারণক্রমে বিভিন্ন এলাকার জন্য, কৃষি শ্রমিকদের বিভিন্ন শ্রেণীর জন্য, কৃষি শ্রমিকদের বিভিন্ন প্রকারের জন্য ন্যূনতম মজুরির বিভিন্ন হার স্থির করতে পারে; ন্যূনতম মজুরির হার স্থির করার নির্দিষ্ট তারিখের পর থেকে পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে পুনর্নির্ধারণ করা যাবে না, যদি না বিশেষ পরিস্থিতি সে রকম বাধ্য করে।
কৃষি-শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ সম্পর্কে বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তিকে কৃষি-শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ করলে ওই শ্রমিককে তার প্রাপ্য মজুরি/পারিশ্রমিক দিতে বাধ্য থাকবেন। কৃষিশ্রমে নিয়োজিত শ্রমিক তার প্রাপ্য মজুরি না পেলে ‘গ্রাম আদালতে’ মামলা করে তার অর্থ আদায় করতে পারেন। এক্ষেত্রে যে পরিমাণ পারিশ্রমিক ওই শ্রমিকের প্রাপ্য ছিল, তার দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে তিনি পেতে পারেন। কিন্তু এসব নথিপত্রে থাকলেও বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই।
এদিকে দেশে চাষ বা আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ কমে যাওয়ায় ক্ষেতমজুর বা কৃষিমজুরের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বংশ পরম্পরায় কৃষির সঙ্গে যুক্ত থাকায় অন্য কোনো পেশায় চট করে যুক্ত হতে পারছে না এসব খেটে খাওয়া মানুষ। সারাজীবন লাঙল আর মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত এসব মানুষ মাটি ছেড়ে অন্য কোনো পেশায় যুক্ত হওয়ার কথা চিন্তাও করে না। কিন্তু আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে ক্রমে কোণঠাসা হয়ে আসা এসব মানুষ কৃষি থেকে ক্রমে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। কৃষকের হালের স্থলে জায়গা করে নিয়েছে কলের লাঙল। ডিজেলচালিত এসব যন্ত্রদানব চষে বেড়াচ্ছে কৃষকের ক্ষেত। প্রকৃতিকে হার মানিয়ে মানুষ মাটির নিচ থেকে তুলে আনছে সেচের প্রয়োজনীয় পানি। ক্ষেতে বীজ রোপণের কাজটিও করছে ড্রামসিডারের মতো যন্ত্র। যন্ত্রের যান্ত্রিকতায় কৃষকের উপকার কতোটুকু হয়েছে, সেটা হয়তো পরিসংখ্যানের মাধ্যমে বের করা যাবে; কিন্তু এতে করে গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ তথা ক্ষেতমজুরদের উপার্জন যে কমে গেছে, তা কোনো উচ্চমানের পরিসংখ্যান ছাড়াই বলে দেয়া সম্ভব। যন্ত্র আমাদের কৃষিতে আশীর্বাদ, না অভিশাপ সে হিসাব না করেও বলা সম্ভব, এটা ক্ষেতমজুরদের জন্য কোনো আশীর্বাদ বয়ে আনেনি। এতে করে তাদের চাহিদা কমেছে; কমেছে আয়। উদয়াস্ত পরিশ্রম করেও দুমুঠো ভাতের সংস্থান করতে তাদের এখন ত্রাহি অবস্থা। এদিকে দারিদ্র্যের কারণে অনেকে আবার আগাম শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হন। অর্থাৎ জমির মালিকের কাছ থেকে কিছু টাকা নেন, যেটি পরে ফসল তোলার মৌসুমে শ্রম দিয়ে শোধ করতে হয়। অনেকেই বিভিন্ন সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছেন দারিদ্র্যের কারণে। সেসব টাকা দিয়ে উপার্জনমূলক কোনো কাজ করতে পারেননি। দেশের উত্তরাঞ্চল এবং উপকূলীয় অঞ্চলে এ অবস্থা সবসময়ই বিদ্যমান।
বাংলাদেশে ৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ এ মুহূর্তে ‘দারিদ্র্যসীমার’ নিচে বসবাস করছে। যাদের এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ দুই কোটির বেশি আবার ‘অতি দরিদ্র’। এ অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই দেশের ক্ষেতমজুর। তারা এখন গ্রামীণ সর্বহারা বা গ্রামীণ শ্রমিক। অথচ শ্রমিক হিসেবে তাদের নেই কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। তাদের নিয়ে রাষ্ট্রীয় মনোযোগ কম হলেও এ কৃষি-শ্রমিকদের অবদান জাতীয় অর্থনীতিতে কম নয়। জিডিপির প্রায় ৩২ ভাগ আসে কৃষি থেকে। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৬৩ ভাগ ক্ষেতমজুর বা গ্রামীণ শ্রমজীবী। গ্রামাঞ্চলে এ মানুষের ১৪ ভাগের বাস্তুভিটা পর্যন্ত নেই। তবে জমি নয়, কাজ এবং ন্যায্য মজুরিই এ মানুষদের আকাক্সক্ষার প্রধান ক্ষেত্র।
ক্ষেতমজুরদের বর্তমান মজুরি ও বাজারদরের মধ্যে ব্যবধান ক্রমে বাড়ছে। এলাকা ও সময় ভেদে তাদের মজুরি ৫০ থেকে ১০০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। তাদের গড় মজুরি ৭৫ টাকা। কিন্তু ৪ সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিবারের জন্য এ মজুরি নিতান্তই অপ্রতুল, কারণ তিন-চতুর্থাংশ ক্ষেতমজুর পরিবারে আয় করার মতো সদস্য আছে মাত্র ১ জন। উপরন্তু উল্লিখিত মজুরিতে সারাবছর কাজ পাওয়া সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ ৯ মাস তারা কাজ পেয়ে থাকেন। গবেষক ও নীতিনির্ধারকরা দৈনিক ১,৬০০ ক্যালোরি পরিমাণ খাদ্য উপাদান গ্রহণকে দারিদ্র্য পরিস্থিতি পরিমাপের যে মানদ- নির্ধারণ করেছেনÑ ক্ষেতমজুর পরিবারগুলো সেই মানদ-ের নিচের দিকে পড়ে গেছে। গত পাঁচ বছরে চালের দাম গড়ে ৫০ ভাগ বেড়েছে। ২০০০ সালেও দৈনিক মজুরি দিয়ে ৯ কেজি চাল কেনা যেতো; কিন্তু বর্তমানে ৫ কেজির বেশি নয়। ফলে অতি দরিদ্র ক্ষেতমজুর শ্রেণীর মানুষ সারাবছর এক ধরনের কম খেয়ে দিন কাটায়।
সাম্প্রতিক এক জরিপে (ঋড়ড়ফ ঝবপঁৎরঃু ধহফ ঐঁহমবৎ রহ ইধহমষধফবংয, জউজঝ ধহফ ড়ঃযবৎং) দেশে ১৯টি জেলা শনাক্ত করা গেছে, যেখানে উচ্চমাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বিদ্যমান। একই জরিপে দেখা যায় ক্ষেতমজুর পরিবারগুলোর মধ্যে তারা ক্যালোরি গ্রহণে পিছিয়ে, যারা ভূমিহীন এবং যাদের কোনো ধরনের আবাদি জমি নেই। এসব পরিবারের নিচের দিকের ২০ ভাগ (৭০ লাখ) পরিবারের মাসিক আয় এক হাজার টাকার কম। মজুরি সংক্রান্ত অন্যায্য বাস্তবতার আরেকটি দিক হলো, নারী ও পুরুষ ক্ষেতমজুরদের মধ্যে রয়েছে মজুরি বৈষম্য। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানের মধ্যকার মজুরি ফারাকও অন্যতম একটি সমস্যা। কিন্তু কোথায় যে মজুরি বেশি, সেটি জানার মতো, পাওয়ার মতো বা দেয়ার মতো সরকারি কোনো দাপ্তরিক সুবিধা দেশের কোথাও নেই।
এদিকে বর্তমানে যে কৃষিনীতিটি কার্যকর রয়েছে, তা ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে তৈরি। এ কৃষিনীতি এবং তার আলোকে অনুসৃত কৃষি অনুশীলনের তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্য রয়েছেÑ কৃষির ক্রমাগত যান্ত্রিকীকরণ, আবাদের ক্ষেত্রে পুঁজি নির্ভরতা বাড়ানো এবং ফসল উৎপাদনে রপ্তানিমুখিতাকে প্রাধান্য দেয়া। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষেতমজুরের স্বার্থের বিপক্ষে গেছে। কারণ একটা পাওয়ারটিলার বা একটি ড্রামসিডার অনেকের বেকারত্বের কারণ হয়েছে। পাশাপাশি উফশী জাতের ব্যাপকতা চারা আবাদের সার্বিক কর্মকা-কে ব্যবসায়ীদের কর্তৃত্বে নিয়ে গেছে। এর প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে ভূমিহীন মানুষের শহরমুখী অভিবাসন বেড়ে গেছে। কাজের সন্ধানে মানুষ শুধু শহরের দিকে ছুটছে। আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী ক্ষেতমজুরদের স্বাধীন সংগঠন ও যৌথ দর কষাকষির আইনগত অধিকার এখনো বাস্তবায়িত হয়নি এদেশে। এদিকে রাজনৈতিকভাবেও ক্ষেতমজুররা চরম অসংগঠিত। ফলে ক্ষেতমজুরদের স্বার্থে বর্তমানে রাজনৈতিক ময়দানে কোনো দাবি-দাওয়া সক্রিয় নেই। ক্ষীণ ধারায় বহমান দেশের কিছু ক্ষেতমজুর সংগঠন ক্ষেতমজুরদের কর্মসংস্থান ও উন্নয়নের জন্য কিছু কিছু দাবি করছে। কিন্তু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এসব দাবির প্রতি বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেয়নি কখনো। আবার কিছু উন্নয়ন সংগঠন এ বিষয়ে আগ্রহী হলেও তাদের কাজকর্ম একবারেই দাতানির্ভর। দাতারা টাকা দিলে তারা অনেক কিছু পারে আর না দিলে কিছুই পারে না। আর এ কারণেই অনেক এনজিও এ বিষয়ে কাজ শুরু করলেও পরে তা মায়াকান্নায় পরিণত হয়েছে।
একথা সত্য যে, জাতীয় উন্নয়ন অগ্রগতির যে লক্ষ্যই নির্ধারণ করা হোক না কেন, দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ লোক তথা গ্রামীণমজুরের জীবন ও জীবিকার দাবিকে উপেক্ষা করে তা অর্জন করা সম্ভব নয়। কৃষি-শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের মাধ্যমে তার শ্রমের যথার্থ মূল্যায়ন করা জরুরি। কৃষিশ্রম (ন্যূনতম মজুরি) অধ্যাদেশ ১৯৮৪ প্রবর্তিত হলেও সেটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আইন থাকা সত্ত্বেও কৃষি-শ্রমিকের শ্রমের মূল্যায়ন হচ্ছে না। কৃষি-শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নির্ধারণ এবং এটিকে ফলপ্রসূ করতে নিম্ন লিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। ক্ষেতমজুরদের অধিকার রক্ষায় সহায়ক আইন প্রবর্তন এবং পুরনো আইন সংস্কার করতে হবে। বেকারত্বের মাসগুলোতে ক্ষেতমজুররা বিশেষত কম মজুরির এলাকাগুলোতে বাজার মূল্যের অর্ধেকে আগাম শ্রম বিক্রি করে দেয়। কম মজুরি এবং আগাম শ্রম বিক্রির মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের পুঁজিপতি, জোতদার ও ধনী কৃষকরা বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করছে। এ ধরনের শ্রম-শোষণ বন্ধ করতে এসব কর্মকা- আইনগতভাবে বেআইনি ঘোষণা করতে হবে। কৃষি-শ্রমিকদের শহরমুখী অভিবাসন ঠেকাতে বছরের সবসময় কিছু না কিছু কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। যেসব খানায় জমির পরিমাণ সর্বোচ্চ ০.২ হেক্টর পর্যন্ত, তারা কার্যত ভূমিহীন। এ রকম খানার সংখ্যা দেশে প্রায় ৫০ ভাগ। সমাজে যাদের অতি দরিদ্র বলা হচ্ছে এবং যাদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ ভাগ অর্থাৎ প্রায় তিন কোটি, তাদের ৯৭ ভাগের কৃষিকাজের মতো কোনো জমি নেই। মোট জনসংখ্যার ৪৭ ভাগের শুধু বসতবাড়িটুকু আছে। অথচ দেশে ৩.৩ মিলিয়ন একর খাসজমি রয়েছে, যা থেকে প্রতিটি ভূমিহীন কৃষিজীবী পরিবারকে কিছু জমি দিতে হবে। খাসজমি, চর ও উপকূলের জমি, সিলিং উদ্বৃত্ত জমি বিত্তবান ও টাউটদের দখল থেকে উদ্ধার করে তা কৃষি মজুরসহ গ্রামীণমজুর, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে ‘বিক্রয় ও হস্তান্তর অযোগ্য’ শর্তে স্থায়ী বন্দোবস্ত দিতে হবে। পাশাপাশি চলতি পুঁজির সহায়তা দিয়ে সমবায়ী উদ্যোগকে জোরদার করতে হবে। ক্ষেতমজুরদের জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উন্নয়ন বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন। ক্ষেতমজুর সংগঠনগুলো উন্নয়ন বাজেটে ১২.৫ ভাগ বরাদ্দের দাবি করছে; কিন্তু বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় এ বরাদ্দের পরিমাণ ন্যূনতম ৩০ ভাগ হওয়া প্রয়োজন। কৃষি-শ্রমিক বা ক্ষেতমজুরদের জন্য মজুরির একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ (ন্যূনতম ১২০ টাকা) নির্ধারণ করা প্রয়োজন। বছরের সবসময় সেই নির্দিষ্ট পরিমাণ মজুরি শ্রমিক যাতে পায় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। শ্রম-বৈষম্য কমিয়ে আনতে নারী-পুরুষ সমান কাজে সমান মজুরি দেয়ার জন্য আইন করতে হবে। জরুরি ভিত্তিতে কৃষিশ্রমের ন্যূনতম মজুরি ও মূল্য পরিষদ গঠন করতে হবে। অর্থনৈতিক অবস্থা, জীবন ধারণের ব্যয় ও আনুষঙ্গিক বিষয়াবলী বিবেচনায় রেখে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। কৃষিতে নিয়োজিত শ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কৃষি-শ্রমিকদের জন্য আইডেনটিটি কার্ড দিতে হবে। কৃষি-শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই।

জাহিদ রহমান: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor