Friday, November 21, 2008

কৃষিতে বিনিয়োগ-ভর্তুকি প্রত্যাহার না করায় নাখোশ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক

২০.১১০৮
যায়যায়দিন ।। আলতাব হোসেন

বিশ্বের বৃহৎ অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রস্তাব সরকার আমলে না নেয়ায় নাখোশ হয়েছে সংস্থাটি। সম্প্রতি বাংলাদেশের কৃষি সেক্টরে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও সরাসরি ভর্তুকি পুরোপুরি প্রত্যাহারের পরামর্শ দিয়েছিল ওয়ার্ল্ড ব্যাংক। এর আগে সয়াবিন, ভুট্টা ও আখ থেকে জৈব জ্বালানি (বায়ো ফুয়েল) উৎপাদনেরও প্রস্তাব দিয়েছিল সংস্থাটি। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পরামর্শে সরকারও ভর্তুকির পরিমাণ বছরের পর বছর কমিয়ে আনছিল। তবে কৃষি সেক্টরে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি পুরোপুরি তুলে নেয়ার ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রস্তাব সরকার সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। আর এতেই নাখোশ সংস্থাটি।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার শর্ত অনুযায়ী, কোনো দেশের কৃষিতে সরকারের ১০ ভাগ ভর্র্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের চাপে তিন বছর ধরে বাংলাদেশে এ হার ছিল মাত্র ০.৩ ভাগ। চলতি বছর যা ০.২ ভাগে নেমে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ হারে কমাতে থাকলে এবং বিশ্বজুড়ে যে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে, তাতে ভর্তুকি কমালে খাদ্য সঙ্কট থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে আসতে পারবে না। কারণ একমাত্র কৃষি উৎপাদন বাড়িয়েই বাংলাদেশ পুরোপুরি আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে এনে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংক নব্বইয়ের দশকে আফ্রিকার কিছু দেশকে পরামর্শ দেয় কৃষি খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ প্রত্যাহারের। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক তখন বলেছিল, এতে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, বেসরকারি বিনিয়োগ হয়নি। তার ওপর ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের নীতি অনুসরণ করায় আফ্রিকান দেশগুলোর কৃষি খাত পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মুরুব্বিপনার ফলে সেসব দেশে কৃষি খাতে প্রজনন ক্ষমতাহীন হাইব্রিড বীজ, কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার বেড়ে যায়। আর এতে লাভবান হয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। কিন্তু ধ্বংস হয়ে যায় কৃষি সেক্টর।
একসময় কৃষি সেচের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ছিল বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন। বিএডিসির কার্যক্রমের মাধ্যমে বীজ ও সার সরবরাহ ব্যবস্থাপনাও গড়ে উঠেছিল। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই কৃষিতে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা হতো। কিন্তু ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পরামর্শে এ প্রক্রিয়াটিও বেসরকারিকরণ করা হয়। ১৯৯২ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জুট মিল আদমজী বন্ধের জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ২.৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছিল।
গত বছর বাজেটে ডিজেল ভর্তুকি খাতে ৭৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বিরোধিতায় শেষ পর্যন্ত ২৫০ কোটি টাকা করা হয়। এছাড়া সরকার ৩৫০ কোটি টাকার একটি এনডাউনমেন্ট ফান্ড গঠন করলেও এ টাকা ব্যয় করতে পারছে না। এ বছরও এসব খাতে সরকার বরাদ্দের পরিমাণ কমিয়ে আনে। অভিযোগ আছে, দেশে কোনো রাজনৈতিক সরকার না থাকায় দাতা সংস্থাগুলো চাপ দিয়ে এবং তোড়জোড় করে তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলো পাস করিয়ে নিচ্ছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের কৃষি সেক্টরে প্রভাব বিস্তার করতে সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক। শুরুর দিকে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যৌথভাবে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পরামর্শে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। ১৫ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ঋণ দেবে ১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। অথচ পরামর্শকদের বেতন-ভাতা, প্রশিক্ষণ, প্রকল্পের গাড়ি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ও বহুজাতিক কোম্পানির বীজ প্রদর্শনীর কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরামর্শক ব্যয়ই ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা।
তিন ধাপে পাঁচ বছর করে ১৫ বছর মেয়াদি ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রজেক্ট (এনএটিপি) নামে নতুন কর্মসূচি ২০০৭ সালের জুলাই থেকে অফিসিয়ালি শুরু হলেও চলতি মাসেই পুরোদমে কাজ শুরু হচ্ছে এ প্রকল্পের। এরই মধ্যে প্রকল্প পরিচালকসহ প্রকল্পের বিভিন্ন ইউনিটের লোকবল নিয়োগের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ করে আনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে ঋণ দিয়ে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার নামে বাংলাদেশকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, তৃণমূল ও জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে কৃষি হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন খাত। অর্থকরী খাত থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জিডিপির ২৬ ভাগ আসে, যা বিশ্ব অর্থনীতির চার ভাগেরও বেশি। তাই ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এ খাতটি নিজেদের দখলে নিতে আগ্রহী।
বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেন, কৃষি খাতে জিডিপির ২১.৭৭ ভাগ ও দেশের ৬৫ ভাগ কর্মসংস্থান হওয়ার পরও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের নীতি অনুসরণ করায় কৃষি খাতের বরাদ্দ বছর শেষে ছেঁটে ফেলা হয়। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটেও কৃষি খাতের বরাদ্দ ছেঁটে ফেলা হয়। গত বছরের মূল বাজেটে বরাদ্দ ছিল ৫ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা। কিন্তু সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে আনা হয় ৪ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা।
বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডাবলিউটিও) চুক্তি অনুযায়ী ভর্তুকির ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশগুলো কৃষি খাতে মোট উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ পর্যন্ত ভর্তুকি দিতে পারে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় কৃষি জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৪১ শতাংশ। অথচ ভারতে ব্যাপক হারে এ ভর্তুকি বাড়ছে। আর ইউরোপের অনেক দেশ প্রতিটি গাভীর জন্যই প্রতিদিন ৩ ডলার ভর্তুকি দিচ্ছে। কিন্তু ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আইএমএফের ঋণ শর্ত মানতে গিয়ে কৃষি ভর্তুকি বাড়াতে পারছে না বাংলাদেশ। অথচ দেশে কৃষি ভর্তুকি বাড়ানো না হলে অন্যান্য দেশের কৃষিপণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এদেশের কৃষি ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু খাতে পরিণত হবে বলে দেশের অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
তারা বলছেন, গত দুই দশকে কৃষি খাতের উন্নয়নে গড়ে বছরে ব্যয় করেছে ২ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা, যা উন্নয়ন খাতে সরকারি বিনিয়োগের ২৯ শতাংশ। এ সময় জাতীয় আয়ে কৃষি খাতের অবদান কমেছে ৪৫ থেকে ৩২ শতাংশ। বিনিয়োগকৃত অর্থের ৪০ শতাংশ পেয়েছে ফসল, মৎস্য, বন, পশুপালন উপ-খাতগুলো। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানিসম্পদ উন্নয়ন খাতে খরচ হয়েছে ৪৫ শতাংশ, ৫ শতাংশ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যার থেকে ধান ও গম ছাড়া অন্যান্য শস্য এবং কৃষির উপখাত অগ্রাধিকার তালিকায় অবহেলিত হয়েছে। পানিসম্পদ উন্নয়নের বেশির ভাগ অর্থ খরচ হয়েছে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে। সেচ অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছে সামান্যই।
সবদিক বিবেচনা করে সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও সরাসরি ভর্তুকি প্রত্যাহারের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, কৃষকদের উৎপাদনের মূল্য নিশ্চিত না করা হলে তারা উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারেন। এতে দেশ আবার খাদ্য সঙ্কটের দিকে যেতে পারে। তাই সরকার কৃষি ভর্তুকি প্রত্যাহার করার পথে এগোবে না।
উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার বলেন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক সব সময় বেসরকারিকরণের পক্ষে কাজ করে। তাই তারা কৃষি সেক্টরে সংস্কার করে বেসরকারিকরণের পথ উন্মুক্ত করার চেষ্টা করছে।
কৃষি উপদেষ্টা ড. সি এস করিম বলেন, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের সাবসিডি অব্যাহত রাখতে হবে। তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, শুধু ভর্তুকি বাড়ালেই চলবে নাÑ সরকারের অন্যান্য উন্নয়ন খাতের দিকেও নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বৃদ্ধির ফলে সরকারকে বিপুল পরিমাণে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। ফলে অন্যান্য খাতের বরাদ্দে টান পড়তে পারে।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor