Friday, November 28, 2008

জাতীয় কৃষি দিবস দিবস পালনেই যেন সীমাবদ্ধ না থাকে

২৫.১১.০৮
ডেসটিনি ।। ইয়াসরেমিনা বেগম সীমা

নিজের গোলায় তুলবো ধান, গাইবো গান ভরবে প্রাণ’Ñ এ সেøাগান দিয়ে গত ১৫ নভেম্বর, ১ অগ্রহায়ণ সারা দেশে পালিত হলো জাতীয় কৃষক দিবস। পৃথিবীর বহু দেশে অনেক আগে থেকে জাতীয়ভাবে কৃষক দিবস পালিত হলেও বাংলাদেশে এটা ছিল প্রথম। কৃষি সাংবাদিক শাইখ সিরাজের লেখা থেকে জানা যায় খোদ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে কৃষি দিবস পালনের রেওয়াজ আছে। আইওয়াতে ২০০৫ সাল থেকে কৃষি দিবস পালন শুরু হয়েছে। সেখানে তারা ১০ থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত ৩ দিনব্যাপী কৃষি দিবস পালন করে, উত্তর ক্যারোলিনাতে ৩১ জুলাই এবং ১ ও ২ আগস্ট এ ৩ দিন ১১ পর্বে উদযাপিত হয় কৃষি দিবস। এ বছর সেখানে ৫৩তম কৃষি দিবস উদযাপিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কিমব্যালে গত ২৭ সেপ্টেম্বর ১৩ পর্বে পালিত হয়েছে ৮২তম কৃষক দিবস। আফগানিস্তানে ইংরেজি ২০ মার্চ নওরোজ উদযাপনের দিন পালিত হয় কৃষি উৎসব। স্থানীয়ভাবে একে বলা হয় ‘যাসনি দেহকান’ বা কৃষকের উৎসব।
বহুকাল থেকেই আমাদের দেশে নবান্ন উৎসব পালন হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ নবান্ন উৎসব কৃষকের কাছে প্রায় স্মৃতির চিলেকোঠায় ওঠার উপক্রম হয়েছিল। ১ বৈশাখে পান্তাভাত খাওয়ার মতো শহরের উৎসাহী সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোই নবান্ন উৎসবকে মূলত জিউয়ে রেখেছিল। ১৯৮২ সাল থেকে বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কৃষিকে অবহেলা এবং বিএডিসিকে নিষ্ক্রিয় করে রেখে সবার মধ্যে এরূপ ধারণা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয় কৃষি আসলে একটা অলাভজনক খাত। গত বছর যখন বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট, বাংলাদেশে দুই দফা বন্যা এবং সিডরের মতো বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থাকে প্রায় ল-ভ- করে দেয় এমনিক আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত চাল রফতানির ক্ষেত্রে নজিরবিহীন টালবাহানা শুরু করে তখন আমাদের জাতীয় নেতাদের বোধোদয় হয়। তারা কিছুটা হলেও বুঝতে পারেন জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কৃষিকে গুরুত্ব দেয়ার বিকল্প নেই। এ সংকট সময়ে আমাদের দেশের কৃষকরা বোরো, আমন, আলুসহ শস্যের বাম্পার উৎপাদন করেন যার ফলে সংকট আয়ত্তের মধ্যে আসে।
দিনাজপুরে চেড়াডাঙ্গির কৃষক সমাবেশে প্রধান উপদেষ্টা কৃষককে জাতীয় বীর ও দেশের সবচেয়ে বড় নায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন আর এ কথার স্বীকৃতি দিতেই এ আয়োজন। এবারের প্রতিপাদ্য ‘কৃষিই সমৃদ্ধি’। ‘জাতীয় কৃষি দিবস’ পালনের জন্য সরকার নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে এর মধ্যে প্রধান আকর্ষণ ছিল ধান কাটার উৎসব। এছাড়া দিবসটি স্মরণ করে রাখার জন্য প্রধান উপদেষ্টা একটি স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন করেছেন। প্রথমবার জাতীয় দিবস পালন করতে ৯৩ লাখ টাকা বাজেট নির্ধারণ করা হয়েছে। এ দিবস পালন করতে প্রতিটি জেলা শহরে ৫০ হাজার টাকা এবং উপজেলায় ১০ হাজার করে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। কৃষককে কাজে উদ্দীপ্ত করতে প্রধান উপদেষ্টার আগ্রহে এ কৃষি দিবস পালন করা হচ্ছে বলে সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে। জাতীয় কৃষি দিবস উপলক্ষে প্রতিটি জেলা-উপজেলায় আয়োজন করা হয়েছে কৃষক শোভাযাত্রা, ধান কাটা উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আনন্দমেলা। শিশু একাডেমীর উদ্যোগে কৃষিভিত্তিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। দিবসটি পালনের জন্য কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, জেলা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়গুলো নানা সাজে সজ্জিত করা হয়েছিল। আনন্দ আয়োজন দিয়ে দেশের কৃষির এক নতুন অগ্রযাত্রা, কৃষকের কাক্সিক্ষত স্বপ্নের বিজয়। হাজারো দিবসের মধ্যে একটি দিবস নির্ধারিত হয়েছে, যাতে দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
হাজারো সমস্যার আবর্তিত হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষি, লাখো সমস্যায় জর্জরিত আমাদের কৃষক। সচেতনতার অবাবে প্রতিদিন ইঞ্চি ইঞ্চি করে কমছে কৃষিজমি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বার বার কেড়ে নিচ্ছে কৃষকের মুখের গ্রাস, দাদন ব্যবসায়ীর শোষণে আর সার্টিফিকেট মামলায় হাতছাড়া হচ্ছে প্রান্তিক কৃষকের কৃষিজমি। কোনো আগাম সঙ্কেত ছাড়াই বাড়ছে সার, ডিজেল, কীটনাশকের দাম, জমি বন্ধক রেখে দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা এনে চড়া দামে কিনতে হয় ভেজাল বীজ, ভেজাল সার ও কীটনাশক। এতে কখনো জমিতে গাছ হলেও ফসল ফলে না, মাটি হয় বিষাক্ত, অনাক্সিক্ষত পোকামাকড় বাসা বাঁধে ফসলের জমিতে, সর্বনাশ হয় কৃষকের। সরকার মাঝে মধ্যে কৃষিতে ভর্তুকি দেয়ার কথা ঘোষণা করে বা দেয়, কিন্তু কৃষক জানেস না ভর্তুকির মর্মার্থ কী? উপজেলা কৃষি অফিস ও ব্লক সুপারভাইজারের দায়িত্ব কী? এছাড়া কৃষক সরাসরি সরকারি বরাদ্দ আর ভর্তুকির সুফলও পায় না। সরকারি ভর্তুকি না হলে কৃষককে কত টাকার সার কত টকায় কিনতে হতো তাও জানেন না। তিনি জানেন না, জানার চেষ্টাও করেন না। কৃষক চান শুধু কৃষি উৎপাদনের জন্য কৃষি উপকরণ ও অনুকূল পরিবেশ। সেই উপকরণ আর পরিবেশ ছাড়াই প্রতিকূলতার মাঝে যে ফসল উৎপাদন করেন তার ন্যায্যমূল্যও তিনি পান না। কৃষকের ফসলের লাভের অংশ চলে যায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দখলে। এ কথা আজ সর্বজন স্বীকৃত, দেশের খাদ্য দিবস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পরে।
যেহেতু প্রতি বছরই কৃষি দিবস পালন করা হবে, সেহেতু গ্রামে গ্রামে কৃষি সমবায় সমিতি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এতে করে কৃষি দিবস উদযাপনে রাষ্ট্রের সঙ্গে কৃষকের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কৃষক জানতে পারবেন সরকারি ভর্তুকি তারা কী পরিমাণ পাচ্ছেন। উপজেলা কৃষি অফিসের দায়িত্ব কী, সরকার থেকে উন্নতমানের বীজ ও সার কীভাবে-কখন পাওয়া যাবে। তারা সরাসরি সরকারের কাছে অভিযোগ করতে পারবেন কখন-কীভাবে কৃষি উৎপাদনে হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথমদিকে রাজধানীতে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ঢাকায় বেশকিছু খোলাবাজার সৃষ্টি করা হয়েছিল। এত মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়িয়ে কৃষক ও রাজধানীর মানুষ উভয়েই উপকৃত হয়েছেন। যে বাজার সৃষ্টি করা হয়েছিল সে বাজার ব্যবস্থা আবার স্থায়ীভাবে চালু করতে হবে। প্রত্যেক উপজেলায় ফসল সংরক্ষণাগার গড়ে তুলতে হবে। প্রশাসনের সঙ্গে কৃষকের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে সময়মতো হয়রানি ছাড়া কৃষিঋণ প্রাপ্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে সরকার কৃষককে ডিজেলে ভর্তুকি বাবদ নগদ টাকা দিচ্ছে। এতে করে সরকার থেকে কৃষকের হাতে আসতে টাকার একটা অংশ যেমন মাঝপথে ইঁদুর খাচ্ছে অন্যদিকে ওই সামান্য পরিমাণ টাকায় তাদের কতটুকু সাশ্রয় হচ্ছে তা ভেবে দেখা দরকার। এ ব্যাপারে কৃষকের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে, তাদের হাতে নগদ টাকার চেয়ে ন্যায্যমূল্যে ডিজেল পৌঁছানো যায় কি না। নগদ টাকার ভর্তুকিতে সমস্যা অনেক, অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের কৃষকরা প্রান্তিক চাষি। অভাব তাদের নিত্যদিনের সহচর। এতে ডিজেল কেনার টাকা অনেক সময় অন্য খাতে খরচ হতে পারে। তাছাড়া ভর্তুকির টাকা সংগ্রহ ও তেল কিনতে আলাদাভাবে সময় ব্যয় করলে এতে তার চুলায় হাঁড়ি ওঠা বন্ধ হওয়ার অবস্থাই সৃষ্টি হতে পারে।
জাতীয় কৃষি দিবস গ্রামবাংলার কৃষকের মাঝে নতুন উদ্দীপনা সষ্টি করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কৃষকের এ উদ্দীপনাকে কাজে লাগোনো এবং বাস্তবরূপ দেয়া সরকারের দায়িত্ব। প্রতি বছর কৃষি দিবসে কৃষকের জন্য চমকপ্রদ ঘোষণা থাকতে হবে। কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে প্রকৃত কৃষক, প্রান্তিক কৃষক, বর্গাচাষি চিহ্নিত করে তাদের রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য কৃষিতে উচ্চশিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে কোটার ব্যবস্থা রাখতে হবে। ভবিষ্যতে বছরের এ দিনটিতে কৃষকের অভিযোগ শুনতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে তা সুরাহা করতে হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরকে অঞ্চল ভাগ করে ত্রৈমাসিক ওয়ার্কশপের আয়োজন করে কৃষককে অভিহিত করতে হবে। এ ব্যবস্থাগুলো বাস্তবরূপ দিতে পারলে কৃষি দিবস উদযাপন সফল হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেল, কসমেটিক থেকে শুরু করে সব কিছুই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। আর আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাচ্ছে এসব কিছু আমদানি করতেই। অথচ শুধু কৃষি খাতকে যদি আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারি তবে শিল্প খাতে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি সম্ভব হবে, আমরা পারবো উন্নতির সোপান পাড়ি দিয়ে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছাতে। অন্যথায় কৃষি দিবস যদি শুধু দিবস পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে তবে আমদানি আর সাহায্যনির্ভর জাতি হিসেবেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। য়
লেখক : কলাম লেখক ও সমাজকর্মী

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor