Wednesday, September 17, 2008

কৃষিঋণ: কৃষির জন্য খুবই ইতিবাচক একটি সিদ্ধান্ত

১৮.০৯.০৮
।।ইত্তেফাক।। সম্পাদকীয়

বিশ্ব জুড়িয়াই দেশে দেশে খাদ্য সংকট বিরাজমান। সংকট দিনদিনই বাড়িতেছে। এই প্রেক্ষাপটে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে দেশি-বিদেশি সকল ব্যাংকে কৃষিঋণ বিতরণ বাধ্যতামূলক করা হইয়াছে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের। পাশাপাশি, কৃষকদের জন্য তিন বৎসর মেয়াদী আবর্তক শস্যঋণ ব্যবস্থাও চালু করা হইতেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বর্গাচাষী এবং জেলেদেরও ঋণ দিতে আগ্রহী। আমাদের দেশে বর্গাচাষীর সংখ্যা ব্যাপক হইলেও তাহারা ব্যাংক হইতে ঋণ পায় না। তাই তাহাদেরকে জামানতবিহীন ঋণ দানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বেটার বিজনেস ফোরামের বৈঠকে সম্প্রতি এইসব প্রস্তাব অনুমোদিত হইয়াছে। অচিরেই এইসব সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন শুরু হইবে বলিয়া জানা গিয়াছে।

যুগ যুগ ধরিয়া কৃষি আমাদের অর্থনীতির প্রধান খাত হইলেও এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটির প্রতি সঠিক মনযোগ কোনকালেই দেওয়া হয় নাই। বাজেটওয়ারী বরাদ্দের ব্যাপারেও এই খাতের প্রতি তেমন সুবিবেচনা ও সুবিচার প্রদর্শন করা হয় নাই। অথচ অস্বীকার করার উপায় নাই গত কয়েক বছরে বিশ্ব বাজারে খাদ্যসামগ্রীর আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধির মুখে কৃষিই মহাদুর্যোগ হইতে আমাদের রক্ষা করিয়াছে। একই সাথে চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিয়াছে যে, সমস্যাজর্জরিত এই দেশটির প্রায় ১৫ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে হইলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়া গত্যন্তর নাই। উৎপাদন বাড়াইতে হইলে প্রথমত, কৃষিতে যথা সময়ে পুঁজি-প্রাপ্তির ব্যবস্থা রাখিতে হইবে। দ্বিতীয়ত, সেই অর্থ যাহাতে যথাসময়ে নির্ঝঞ্ঝাটে প্রকৃত কৃষকের হাতে পৌঁছে তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। তৃতীয়ত, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিশ্চিত করিতে হইবে কৃষকের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাসহ অপরাপর সুখ-সুবিধা। মনে রাখিতে হইবে যে, আমাদের কৃষি এখনও প্রকৃতিনির্ভর। যে-কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে তাহারা যেন আর্থিকভাবে টিকিয়া থাকিতে পারে এবং দ্রুত সেই বিপর্যয় কাটাইয়া উঠিতে পারে সেই অবকাঠামো ও ব্যবস্থা অবশ্যই থাকা দরকার। কৃষি আমাদের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত, অথচ কৃষির জন্য স্থায়ী পুঁজি-কাঠামো নাই বলিলেই চলে।

চলতি অর্থবৎসরে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হইয়াছে প্রায় সাড়ে নয় হাজার কোটি টাকা যাহা পূর্ববর্তী বৎসরের তুলনায় ১৩ শতাংশ বেশি। গত অর্থবৎসরে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি ঋণ বিতরণ করা হইয়াছিল। ইহার সুফলও আমরা পাইয়াছি। বোরোসহ একাধিক ফসলের বাম্পার ফলন হইয়াছে। তবে এই জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের তরফ হইতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলিকে বার বার তাগাদা দিতে হইয়াছিল। আশা করা যায়, এইবার পরিস্থিতির আরও উন্নতি হইবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলি স্বতঃপ্রণোদিতভাবেই কৃষকদের প্রতি সহায়তার হাত প্রসারিত করিবেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলিয়াছে, ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ এবং তাহা বিতরণের ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির স্বাধীনতা থাকিবে। ঋণ বিতরণের হার যৌক্তিক বা সন্তোষজনক না হইলেই কেবল তাহারা হস্তক্ষেপ করিবে। উল্লেখ্য যে, এই ধরনের কার্যক্রমের সফলতা বহুলাংশে নির্ভর করে কার্যকর ব্যবস্থাপনা ও যথাযথ তদারকির উপর। ঋণের অর্থ সময়মতো প্রকৃত কৃষকের হাতে পৌঁছানোই হইল সর্বাপেক্ষা বড়ো চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানাইয়াছেন, কৃষকের তিন বৎসরের জন্য ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হইতেছে। এই লক্ষ্যে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের পক্ষ হইতে কৃষকদেরকে পরিচয়পত্র বা আইডি কার্ড দেওয়া হইতেছে। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জটি হইল তদারকি। উপযুক্ত তদারকির অভাবে সরকারের বহু ভালো কর্মসূচিও সফলতার মুখ দেখে না। বলা হইয়াছে, কেন্দ্রীয়ভাবে কৃষি ঋণ কার্যক্রম তদারকি করিবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর মাঠ পর্যায়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারাই এই দায়িত্ব পালন করিবেন। অবশ্য তাহারা কতোটা কার্যকর ভূমিকা রাখিতে পারিবেন সেই প্রশ্ন থাকিয়াই যায়।

কৃষিঋণ বিতরণ করা লাভজনকও বটে। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর যথার্থই বলিয়াছেন, ‘আমার ধারণা, ইতিমধ্যে ব্যাংকগুলিও বুঝিতে পারিয়াছে যে, কৃষিঋণ বিতরণ করা তাহাদের জন্য লাভজনক।’ যদিও ২০০৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত খেলাপি কৃষিঋণের পরিমাণ দাঁড়াইয়াছে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা। ইহা বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির মোট খেলাপি ঋণের অর্ধেকেরও বেশি। ইহার মূল কারণ যে অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই বলিলেই চলে। বাংলাদেশ ব্যাংকও তাহাই মনে করে। ক্ষেত্রবিশেষে মাত্র ৫ হইতে ১০ হাজার টাকা ঋণ সংগ্রহ করিতে গিয়া কৃষককে ২ হইতে ৩ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হইয়াছে। তদুপরি, ঋণ পাইতে নজিরবিহীন ভোগান্তি তো আছেই। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বীকার করিয়াছে যে, বৃহদংকের ঋণখেলাপির ঘটনাগুলিতে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের অনাগ্রহ বা অবহেলাই মুখ্য হইলেও কৃষকদের ক্ষেত্রে বিষয়টি একেবারেই ভিন্নরকম। ঋণ পরিশোধে তাহারা যে আন্তরিক এনজিও পরিচালিত ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির সাফল্যই তাহার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

কৃষিঋণ কার্যক্রমকে অবশ্যই সব ধরনের দুর্নীতি এবং ছদ্মবেশী কৃষক, টাউট-বাটপাড় ও মধ্যস্বত্বভোগীদের লুটপাট হইতে মুক্ত রাখিতে হইবে। কৃষক ও কৃষিখাতের অর্থবহ উন্নয়নে দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলির পাশাপাশি পল্লী কর্মসহায়ক ফাউণ্ডেশনের মতো অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও আগাইয়া আসিতে হইবে। কৃষকই যে আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ড তাহা কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করিতে হইবে।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor