Saturday, September 13, 2008

ভেষজ: গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ উদ্ভিদ অর্জুন হৃদরোগে অত্যন্ত কার্যকর

১৪.০৯.০৮
।।ইত্তেফাক।। ড. মো. জিয়াউল করিম

মানব জীবনে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম তথা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য উদ্ভিদের কোন বিকল্প নেই। প্রাণের বিকাশ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই পৃথিবীতে উদ্ভিদ জীবনের পরিশুদ্ধি বৃদ্ধি ও অফুরন্ত সম্পদ দিয়ে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে মানুষকে সরবরাহ করে চলেছে নির্মল অক্সিজেন। আমাদের সুস্থ ও সবলভাবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য উদ্ভিদ তার সমস্ত গুণ উজাড় করে দিয়েছে। বর্তমান প্রযুক্তি, বস্তুবাদী আধুনিক মানুষদের কোনভাবেই উদ্ভিদের এই নিরব অবদানকে অস্বীকার করার উপায় নেই। অন্য সকল অবদানের পাশাপাশি রোগ মহামারীতেও উদ্ভিদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নানা জটিল রোগ নিরাময়ে মানুষ উদ্ভিদ থেকে আহরণ করছে বিভিন্ন পথ্য। অর্জুন এমনি এক ধরনের ভেষজ উদ্ভিদ যা মানব কল্যাণে ব্যবহৃত হচ্ছে বহু যুগ ধরে।

বৃহদাকৃতির বহুবর্ষজীবী এই উদ্ভিদটি প্রায় ১৮-২৫ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট হয়ে থাকে এবং এর বৈজ্ঞানিক নাম ঞবৎসরহধষরধ ধৎলঁহধ বাংলায় এটিকে অর্জুন বলা হয়। গাছটির মাথা ছড়ানো ডালগুলো নীচের দিকে ঝুলানো থাকে। পাতা দেখতে অনেকটা মানুষের জিহবাকৃতির। কান্ত সাধারণত খুব লম্বা ও সোজা হয় না। ছাল খুব মোটা এবং ধূসর বর্ণের। গাছ থেকে সহজেই ছাল উঠানো যায়। ফল দেখতে কামরাঙ্গার মত, পাঁচ খাঁজ বিশিষ্ট কিন্তু আকৃতিতে অনেক ছোট।

গ্রীষ্মের সময় অর্জুন গাছে ফুল ধরতে দেখা যায় এবং শীতকালে এর ফলে পাকে। সংগৃহীত বীজ থেকে সহজেই চারা উৎপন্ন করা যায়। ২০-২৫ দিনের মধ্যে বীজ থেকে চারা গজাতে শুরু করে। বীজ থেকে চারা গজানোর হার সাধারণত ৫০-৬০%। মাটির সহিত (৩:১) গোবর মিশ্রিত করলে চারা গজানোর হার বৃদ্ধি পাই। ৪-৫ মাসের চারা লাগানোর জন্য উত্তম এবং বর্ষার শুরুতে এর চারা লাগানো উচিত। পলি ও দোআঁশ মাটি এর বৃদ্ধির জন্য অনুকূল। সামান্য ছায়া সহ্য করতে পারলেও এর ফলন উন্মুক্ত স্থানেই ভাল হয়। অর্জুনের মূল মাটির ভিতর খুব বেশি দূর বিস্তৃত হয় না। কিন্তু গাছ বেশ বড় হয়। সেজন্য গাছ হতে গাছের দূরত্ব ৪.৫ মিটার হতে ৫.৫ মিটারের কম হওয়া উচিত নয়।

ছাল প্রধাণত ব্যবহৃত হলেও পাতা ফলসহ সম্পূর্ণ গাছটি নানাবিধ কাজে ব্যবহৃত হয়। হৃদরোগ নিরাময়ে অর্জুনের ছালের ব্যবহার সর্বজন স্বীকৃত। বর্তমানে বাজারে এর অনেক পেটেন্ট ওষুধও পাওয়া যায়। অর্জুন ছাল ভালভাবে পেষণ করে চিনি ও গরুর দুধের সহিত প্রত্যেহ সকালে সেবন করলে যাবতীয় হৃদরোগ উপকার পাওয়া যায়। অনেক সময় দেখা যায় বুক ধড়ফড় করে অথচ উচ্চরক্তচাপ নেই সে ক্ষেত্রে অর্জুন ছাল দুধ ও পানির সাথে মিশিয়ে পরিমাণ মত নিয়মিত সেবন করলে উপকার পাওয়া যায়। রক্ত নিম্নচাপ থাকলেও এর ছাল বেশ উপকারী। কোথাও থেকে রক্ত পড়লে ৫/৬ গ্রাম ছাল রাত্রিতে পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে ছেঁকে পানি টুকু খেলে আরোগ্য হয়। শ্বেত বা রক্ত প্রদাহে ছাল ভিজানো পানি আধা চামচ কাঁচা হলুদের রস মিশিয়ে খেলে রোগের উপশম হয়। ক্ষয় কাশে অর্জুন ছালের গুড়ো বাসক পাতার রসে ভিজিয়ে ঘি, মধু ও মিছরি মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যায়। রক্ত আমাশয়ে অর্জুন ছালের চূর্ণ তৈরি করে ছাগলের দুধ মিশিয়ে খেলে রোগ সেরে যায়। মচকে গেলে বা হাড়ে চিব খেলে এর ছাল ও রসুন বেটে বেঁধে রাখলে সেরে যায়। অর্জুন ছালের মিহি গুঁড়ো মধুর সঙ্গে মিশিয়ে লাগালে মুখে মেচতার দাগ মিলিয়ে যায়। এর ফল হার্নিয়া এবং হাঁপানি নিরাময়ে বেশ কার্যকর। উপরন্তু অর্জুন কাঠ আসবাবপত্রসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হয়।

উল্লেখিত গুণাবলী থেকে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, অর্জুন গাছ আমাদের জন্য কতটা উপকারী। বহুবিধ গুণে গুণান্বিত হলেও আমাদের দেশে এই উদ্ভিদটির বিস্তার মোটেই সন্তোষজনক নয়। বাণিজ্যিক উৎপাদন নেই বললেই চলে। বিচ্ছিন্নভাবে যেটুকু উৎপন্ন হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। পরিতাপের বিষয় হল আমাদের দেশের জলবায়ু অর্জনসহ অন্যান্য ভেষজ উদ্ভিদের জন্য অনুকূল হওয়া সত্ত্বেও কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে এই সমস্ত উদ্ভিদ আমরা আমদানী করছি বিদেশ থেকে যা কারো কাম্য হতে পারে না। চীন, ভারত এবং নেপালের মত দেশ যেখানে ভেষজ উদ্ভিদ রপ্তানি করে আয় করছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সেখানে বাংলাদেশে ভেষজ উদ্ভিদের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও আমরা বিশ্ব বাজারে এক টাকারও বাণিজ্যির সঙ্গে জড়িত নয়। জরিপ মতে বিশ্ব বাজারে ৬২ মিলিয়ন ডলারের ঔষধি উদ্ভিদের বাজার রয়েছে এবং প্রতি বছর ১৫ শতাংশ হারে এর চাহিদা বেড়ে চলেছে। আমাদের দেশে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ঔষধি উদ্ভিদের অভ্যন্তরীন বাজার রয়েছে যার প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানীকৃত কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। অতিগুরুত্বপূর্ণ ভেষজ উদ্ভিদ অর্জুনের প্রতি গুরুত্ব দেয়া একান্ত জরুরী। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই এই উদ্ভিদটির বাণিজ্যিক বিস্তার অতি প্রয়োজন। আমাদের দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেড়ে চলেছে আশংকাজনকহারে।

সুতরাং মূল্যবান ভেষজ উদ্ভিদ অর্জুন আমাদের দেশে পরিকল্পিত উপায়ে ব্যাপকভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হলে একদিকে যেমন জনগণের স্বাস্থ্য সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে অন্যদিকে তেমনি বিদেশে রপ্তানি করেও অর্জন করা যেতে পারে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। পাশাপশি পরিবেশের ওপর পড়বে এর ইতিবাচক প্রভাব। [ লেখক: জৈব প্রযুক্তিবিদ ]

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor