Saturday, September 20, 2008

কৃষিতে জৈব সারের প্রয়োজনীয়তা ও বাণিজ্যিক প্রসারে জটিলতা

২১.০৯.০৮
ইত্তেফাক ।। মো. রফিকুল ইসলাম

জৈব সার বলতে জৈব পদার্থ থেকে সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত অথবা রূপাš-রিত করা সারকে বুঝায়। অন্যভাবে বলতে গেলে উদ্ভিদ বা উদ্ভিদের অংশ বিশেষ, জীবজন্তুর বিষ্টা ও মূত্র, প্রাণীজাত পচনশীলের অংশবিশেষ এবং নানা প্রকার আবর্জনা নির্দিষ্ট অনুপাত ও পদ্ধতিতে পচিয়ে যে সার তৈরি করা হয় তাকে জৈব সার বলে।

দিন দিন আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে ফলে কমে যাচ্ছে আবাদী জমির পরিমাণ। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের চাহিদা মেটাতে বছরে একই জমিতে আমরা বিভিন্ন ফসল করতে বাধ্য হচ্ছি। আগের দিনে যেখানে জমিতে বছরে এক থেকে দুবার ফসল তোলা হত, এখন প্রয়োজনের তাগিদে খাদ্যের চাহিদা মেটাতে সেই জমিতে বছরে তিন থেকে চার বার, কোন কোন জমিতে পাঁচ থেকে ছয়বার ফসল ফলাতে হচ্ছে, যার ফলে জমি বিশ্রাম পাচ্ছে না। আবার বেশি সার গ্রহণ করে এমন বিভিন্ন ফসলের দিকেও ঝুঁকছি আমরা। যেমন- উফশী, হাইব্রিড ইত্যাদি। অপরদিকে পূর্বের তুলনায় মাঠে গরু-মহিষ বিচারণের সুযোগ এবং গরু-মহিষের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে জমিতে গোবর ও গো-চুনা কমে যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে জ্বালানীর অভাব হওয়ায় ফসলের উচ্ছিষ্টাংশ মাঠে পড়ে থাকে না, তাই আগের মত স্বাভাবিক নিয়মে জমি জৈব পদার্থ পাচ্ছে না। ফলে আমাদের জমির উর্বরতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কৃষক ভাইয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ফসল উৎপাদনের জন্য পুষ্টি পদার্থের প্রকৃত চাহিদা না জেনে আন্দাজমত সার ব্যবহার করেছে। এর ফলে মাটির পুষ্টি ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, অনেক উপকারী অনুজীব মরে যাচ্ছে, পুষ্টি পদার্থের প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে, উপকারী পোকামাকড়ের অ¯ি-ত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে, মাটি দিনে দিনে উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।

রাসায়নিক সারের আন্দাজনির্ভর ব্যবহার এভাবে চলতে থাকলে একসময় আমাদের ফসল উৎপাদন সম্পূর্ণ ব্যহত হয়ে পড়বে। তাই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, টেকসই কৃষি উন্নয়ন ও মাটির স্বাস্থ্য পুণরুদ্ধারের জন্য আমাদের জৈব সার ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। আদর্শ মাটিতে শতকরা পাঁচ ভাগ জৈব পদার্থ থাকার কথা। সেখানে আমাদের মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কোথাও কোথাও এক ভাগেরও কম রয়েছে। মাটির এমন অবস্থা ভবিষ্যতে কৃষির জন্য হুমকিস্বরূপ। তার কিছু নমুনা আমরা লক্ষ্য করলে পাব। যেমন- উত্তরাঞ্চলে কাঁকরোল আগের মত হচ্ছে না, আমাদের বসতবাড়িতে আগের মত চাল কুমড়া, শসা, লাউ, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি হচ্ছে না, পান চাষে দেশের কৃষক আজ ক্ষতিগ্রস্থ। অনেক জায়গায় ভূট্টার ফলন কমে গেছে, জমিতে রাসায়নিক সার দিয়েও কাঙ্খিত ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। জমিতে জৈব পদার্থের ঘাটতিই এর মূল কারণ। অধিক হারে জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করার ফলে পোকামাকড়ের আক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করছে। সবজি থেকে বিষক্রিয়া যেতে না যেতে সেগুলো খেয়ে নানান রকম কঠিন অসুখে আক্রাš- হচ্ছে মানুষ। মূলকথা মাটির স্বাস্থ্যরক্ষা, অধিক ফসল ও পরিবেশ সম্মত খাবারের জন্য জৈব সারের বিকল্প নেই। তাছাড়া বর্তমানে রাসায়নিক সারের উর্ধ্বমূল্যে জৈব সার ব্যবহারের যুক্তিসঙ্গত কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের গরু মহিষের সংখ্যা কমে যাওয়ায় গৃহস্থরা নিজের বাড়িতে যে জৈব সার উৎপাদন করে তা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। আজকের দিনে বাংলাদেশের কৃষির প্রেক্ষাপটে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জৈব সার উৎপাদন ও বিপণন খুবই জরুরি। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জৈব সার উৎপাদন ও বিপণন করতে দরকার প্রযুক্তিগত জ্ঞান আইনগত বৈধতা ও পুঁজি।

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জৈব সার উৎপাদনের প্রযুক্তিগত জ্ঞান স¤প্রসারণে সরকারের কোন উদ্যোগ আছে কিনা আমার জানা নেই। তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জৈব সার উৎপাদনে আইনগত জটিলতা আছে এটা জানি। সরকারের বর্তমান আইন অনুযায়ী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জৈব সার উৎপাদনের আইনগত বৈধতার জন্য (লাইসেন্স পাওয়ার জন্য) ৮-১০ মাস সময় লাগার কথা। আমার জানা মতে নাটোরের ড. ইলিয়াছ সাহেব গত ২৫/০৩/০৭ ইং তারিখে দরখা¯- করেও লাইসেন্স পাওয়ার নয়টি ধাপের পাঁচটি ধাপও ষোল মাস পরেও শেষ করতে পারেনি। ইতোমধ্যে তিনি দশলক্ষ টাকা তার ব্যবসাতে বিনিয়োগ করেছেন। ইলিয়াছ সাহেবের উৎপাদিত জৈব সারের মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু আইনগত বৈধতার অভাবে উৎপাদন ও বিক্রি করতে পারছে না তিনি। ড. ইলিয়াস সাহেবের এই জটিলতা অনেক জৈব সার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনকারীকে নিরুৎসাহী করবে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে জৈব সারের রেজিষ্ট্রেশন (লাইসেন্স) দেয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে আইগত জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা। সরকারি পর্যায়ে আš-রিকভাবে সহযোগিতার অভাব, খোঁজা হয় আইনের ফাঁক। যারা বলছে, এদেশের কৃষিতে জৈব সারের গুরুত্ব অপরিসীম। তারাই জৈব সার স¤প্রসারণে আš-রিকভাবে কাজ করছে না। বাংলাদেশের কৃষির প্রেক্ষাপটে এমন অবস্থা পরিবর্তন, আজকের দিনে খুবই জরুরি।

লেখক : মো. রফিকুল ইসলাম, কৃষক ও কৃষক সংগঠক, রামপুর, নাটোর। সম্পাদক, এলজিইডির ক্ষুদ্রাকার পানি সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পাধীন রামপুর পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor