Monday, September 15, 2008

দেশের দক্ষিণাঞ্চলে রবি মওসুমে ৮ লক্ষাধিক হেক্টর জমি অনাবাদি থাকে আবাদের আওতায় আনতে কর্মপরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে

১৬.০৯.০৮
।।ইত্তেফাক।। নিজামুল হক

অনিয়মিত জোয়ার ভাটা, ক্ষতিকর মাত্রার লবণাক্ততা, বিলম্বিত ও স্বল্প স্থায়ী শীত মৌসুম, জোয়ারের পানিতে জমি তলিয়ে থাকায় আবাদ করতে না পারা, রবি মওসুমে ধান পাকার আগেই জোয়ারের পানি বেড়ে ফসল তলিয়ে যাওয়া, সেচের অভাব ও দারিদ্র্যতার কারণে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন মওসুমে অধিকাংশ জমিই অনাবাদি থাকে। দীর্ঘদিন থেকে এ অবস্থা বিরাজ করলেও এ ব্যাপারে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। স্থান, মাটি ও জলবায়ু ভিত্তিক জাত উদ্ভাবন করে অনাবাদি জমি চাষের আওতায় এনে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। তারা বলছেন, দক্ষিণাঞ্চলের অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আনতে সঠিক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং উপযোগী জাত উদ্ভাবন করে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। বরিশাল. পটুয়াখালীর ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ভোলা, বরগুনা ও বাগেরহাট দক্ষিণাঞ্চলের এই সাত জেলায় এই বিলের পরিকল্পনা নেয়া দরকার।

নদী তীরবর্তী ধূসর, মৃদু ক্ষারীয় এবং এঁটেল দো-আাঁশ প্রকৃতির দক্ষিণাঞ্চলের মাটিতে রোপা আমন, বোনা আমন, মুগ, আউশ, খেসারী, সরিষা, তিল, বাদাম, মসুর, মিষ্টি আলু, ছোলা, ভুট্টা, মরিচ, পালং শাক, ডাঁটা, মিষ্টি কুমড়া, ঢেড়শ, বেগুন, বাঁধা কপি, ফুলকপি, তরমুজের আবাদ হয়ে থাকে। কিন্তু বহুমুখী সমস্যার কারণে এ অঞ্চলে কৃষি উৎপাদনে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে রবি মওসুমে মোট আবাদি জমির এক-তৃতীয়াংশ এবং খরিপ-১ মওসুমে অর্ধেকেরও বেশি আবাদি জমি পতিত থাকে।

চলতি বছরের শুরুর দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দক্ষিণাঞ্চলে গিয়ে পতিত জমি দেখে বিস্মিত হন। তিনি পতিত জমি চাষের আওতায় আনার নির্দেশ দেন। এ লক্ষ্যে সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয় দক্ষিণাঞ্চলের বাগেরহাটসহ বরিশালের সাতটি জেলার পতিত জমির পরিমাণ নির্ধারণ, পতিত থাকার কারণ এবং আবাদের আওতায় আনার ক্ষেত্রে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের ৭ টি জেলায় আবাদি জমির পরিমাণ ৯ লাখ ৬১ হাজার ৯৪৪ হেক্টর। এর মধ্যে রবি মওসুমে ৩ লাখ ৩১ হাজার ২৫৮, খরিপ-১ মওসুমে ৫ লাখ ১২ হাজার ৭৭৩ এবং খরিপ-২ মওসুমে ৫৭ হাজার ২৯০ হেক্টর জমি অনাবাদি থাকে।

সরকারি এক হিসাবে দেখা যায়, দক্ষিণাঞ্চলের বরিশাল জেলায় ১ লাখ ৮৬ হাজার ২২০ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে রবি মওসুমে ৩০ শতাংশ, খরিপ-১ মওসুমে ৫৭ শতাংশ, খরিপ-২ মওসুমে ১৩ শতাংশ অনাবাদি বা পতিত থাকে। এভাবে পটুয়াখালির ২ লাখ ২০ হাজার হেক্টর আবাদি জমির রবি মওসুমে ৪১ শতাংশ, খরিপ-১ মওসুমে ৬৫ শতাংশ, খরিপ-২ মওসুমে ৪ শতাংশ, বরগুনা জেলার ১ লাখ ৪ হাজার আবাদি জমির মধ্যে রবি মওসুমে ৫১ শতাংশ, খরিপ-১ মওসুমে ৫৫ শতাংশ , ভোলা জেলায় ১ লাখ ৭৫ হাজার আবাদি জমির রবি মওসুমে ৯ শতাংশ, খরিপ-১ মওসুমে ৫৩ শতাংশ, পিরোজপুর জেলার ৮৮ হাজার ৪শ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে রবি মওসুমে ৫৩ শতাংশ, খরিপ-১ মওসুমে ৫৭ শতাংশ, ঝালকাঠি জেলার ৫৩ হাজার ৫৭১ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে রবি মওসুমে ৪৮ শতাংশ, খরিপ -১ মওসুমে ৪৩ শতাংশ, বাগেরহাট জেলার ১ লাখ ৩৪ হাজার আবাদি জমির মধ্যে রবি মওসুমে ৩১ শতাংশ এবং খরিপ মওসুমে ৫৩ শতাংশ জমি অনাবাদি থাকে।

বরিশাল জেলায় উঁচু জমি কম হওয়ায় রবিশস্য ও শাকসবজির আবাদ সীমিত। মার্চ এপ্রিল মাসে ভরা জোয়ার থাকায় জমিতে রবিশস্য ও শাক-সবজির আবাদ কম হয়। সেচের পানির ব্যবস্থা না থাকায় ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাস পর্যন্ত ফসল খরায় আক্রান্ত হয়। এ জেলায় শীতের স্থায়ীত্ব কম হওয়ায় গম, মসুর, ছোলা ইত্যাদি রবিশস্য সময়মত চাষ করা সম্ভব হয় না।

পিরোজপুরে রবি মৌসুমে লবণাক্ততা ক্ষতিকর পর্যায়ে থাকায় চাষ করা যায় না। আগাম জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকায় কৃষকরাও চাষ করতে আগ্রহী নয়। এ জেলায় খরিপ-১ ও খরিপ-২ মওসুমে নিচু ও মাঝারি নিচু জমিতে ধান পাকার আগে জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়।

ঝালকাঠি জেলায় আগাম জোয়ারের কারণে পানিতে তলিয়ে যাওয়া, সেচের পানি ও সেচ যন্ত্রের অভাবের কারণে খরিপ-১ ও খরিপ-২ মওসুমে বোরো ও রোপা ধানের মধ্যবর্তী সময়ে চাষাবাদের সুযোগ থাকে না। কেবলমাত্র বোরোর চাষ হয় এরূপ জমিতে খরিপ -১ ও খরিপ-২ মওসুমে পানির গভীরতা বেশি হওয়ায় রোপা আউশ ও রোপা আমন চাষ করা সম্ভব হয় না।

বাগেরহাট জেলায় রবি মওসুমে জমিতে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে । অত্যধিক লবণাক্ততা অসহিষ্ণু হওয়ায় রবি মওসুমে জমি পতিত থাকে। এছাড়া ৪ ফুটের অধিক পানি এবং চিড়িং চাষের জন্য অন্য ফসল চাষের সুযোগ থাকে না। বরগুনা জেলায় জমিতে সময়মত সেচের ব্যবস্থা থাকে না। জোয়ারের পানিতে জমি তলিয়ে থাকায় ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা মুগ, তিল, মরিচ, চীনাবাদামে চাষে আগ্রহী নয়।

বরিশাল জেলায় রোরো ধান আবাদের ৬ মাসের বেশি সময় পতিত থাকে ৩১ হাজার ৬৯৭ হেক্টর জমি। এ ছাড়া রোপা আমন চাষ করার পর ৭ মাস জমি পতিত থাকে। পিরোজপুর জেলায় রোপা আমন চাষের পর ৭ মাস জমি পতিত থাকে। এমন জমির পরিমাণ ২৫ হাজার ৮২১ হেক্টর। বোরো ধান চাষের পর ৬ মাসের বেশি সময় জমি পতিত থাকে ৮ হাজার ৮৩২ হেক্টর।

কৃষি বিশেষজ্ঞ ও কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক নির্র্বাহী চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বরিশাল অঞ্চলে স্থানীয় জাতের শস্য আবাদ হয়। স্থানীয় জাতের শস্য আবাদ করতে দেরি হয়, ফলে জানুয়ারি মাসে ফসল কাটার পর রবিশস্য আবাদের সময় থকে না। তিনি দক্ষিণাঞ্চলে হাইব্রিড আবাদের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি আরো বলেন, বরিশাল অঞ্চলে বোরোর আবাদ বেশি হয়। বোরো সেচের ওপর নির্ভরশীল। তাই সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। বৃষ্টির পানি সেচের জন্য ধরে রাখতে হবে। তিনি বলেন, এসব কাজ পরিচালনার জন্য সরকারকে বাস্তবমুখী কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তিনি এ অঞ্চলে বিআর-৪৭ জাতের আবাদ বাড়ানোর তাগিদ দেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ শামসুল আলম বলেন, বরিশাল অঞ্চলে মওসুম ভিত্তিক কয়েক লাখ জমি পতিত থাকে। এ অঞ্চলে লবণাক্ততা জমি পতিত থাকার প্রধান কারণ। তিনি বলেন, এছাড়া চর এলাকায় জমির মালিকরা জমি চাষ না করে অনাবাদি রাখে। তাদের আশংকা জমি কাউকে বর্গা বা লিজ দিলে জমি বেদখল হয়ে যেতে পারে। অনিয়মিত জোয়ার ভাটার কারণে অনেক জমি পতিত থাকে। জোয়ারের সময় পুরো ফসল পানিতে ডুবে থাকে। আবার ভাটার সময় পানি সংকটের কারণে আবাদ করা যায় না। তিনি বলেন, এ অঞ্চলের জমি আবাদের আওতায় আনার লক্ষ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে। অচিরেই এটি মন্ত্রণালয়ে পেশ করা হবে। তিনি বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে পতিত অধিকাংশ জমি আবাদের আওতায় আনা সম্ভব হবে।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor