Wednesday, September 24, 2008

কলার চারা রোপণের সেরা সময় আশ্বিন মাস

২৪.০৯.০৮
ডেসটিনি ।। কৃষিবিদ খোন্দকার মো. মেসবাহুল ইসলাম


কলা বাংলাদেশের জনপ্রিয় এবং সারা বছর পাওয়া যায় এমন একটি ফল যা পুষ্টিকর এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ এই ফলটি বাংলাদেশের মোট ফল উৎপাদনের প্রায় ৪২ ভাগ ও জমির ব্যবহারের দিক দিয়ে মোট ফলের জমির প্রায় ২১ ভাগ। এবং সুস্বাদু ও মিষ্ট গন্ধযুক্ত কলার গড় ফলন হেক্টর প্রতি প্রায় ১৬ টন। বাংলাদেশের বরিশাল, খুলনা, রংপুর, দিনাজপুর, নরসিংদী, ঢাকা, ফরিদপুর, বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, যশোর, ঝিনাইদহ, ময়মনসিংহ, জামালপুর, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলায় ব্যাপক হারে কলার চাষ হয়। তবে অন্যান্য অঞ্চলেও কিছু না কিছু কলার চাষ হয়ে থাকে। পৃথিবীর ১২০টি দেশে কলা উৎপাদন হলেও ভারতেই সবচেয়ে বেশি কলা (প্রায় ১৪ হাজার টন) উৎপাদন হয়। অন্যান্য অন্যতম কলা উৎপাদনকারী দেশ হচ্ছে চীন, ব্রাজিল, ইকুয়েডর, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, কোস্টারিকা, পানামা, ফিজি, পেরু, হাওয়াই, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া।
বর্ষায় পানি জমে না এবং ভালো পানি নিকাশযুক্ত উর্বর দো-আঁশ ও বেলে দো-আঁশ জমি কলা চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। অন্য ধরনের মাটিতে কলার শিকড় ভালোভাবে বাড়তে পারে না অথবা কলা গাছের জন্য খাদ্য উপাদান প্রাপ্তি সহজলভ্য হয় না। এ ক্ষেত্রে মাটির পিএইচ বা অম্ল ৬.০ থেকে ৭.৫ থাকলে সবচেয়ে ভালো হয়। বাংলাদেশে প্রায় সারা বছরই কলার চারা রোপণ করা গেলেও অতিরিক্ত বর্ষা বা অতিরিক্ত শীতের সময় কলার চারা রোপণ না করাই ভালো। কারণ এ সময়ে রোপণ করা কলার চারা বেশি রসের বা বেশি শীতের জন্য ঠিকভাবে বাড়তে পারে না। শিকড়ের বিস্তার ভালোভাবে না হওয়ার কারণে অনেক চারা মারাও যেতে পারে। সে জন্য বর্ষার শেষে এবং শীতের আগে আশ্বিন মাসই কলার চারা রোপণের উপযুক্ত সময় বলে কৃষি বিজ্ঞানীরা মত প্রকাশ করেছেন। আশ্বিন মাসে মাটিতে যথেষ্ট রস থাকে, ফলে সেচের প্রয়োজন প্রায় হয়ই না। চারা খুব সহজেই মাটিতে খাপ খাইয়ে নেয় এবং শীতের আগেই চারার কিছুটা বাড়-বাড়তি হয়ে যায়। চারা রোপণের মাস দেড়-দুইয়ের মধ্যেই শীত শুরু হওয়ায় ওই সময়ে গাছের বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু শীতের শেষে গরম পড়া শুরু হলে উপরি সার ব্যবহার করে সেচ প্রদান করলেই রোপণ করা কলা গাছের বৃদ্ধি আবার দ্রুত হয়। এই সময়ে রোপণ করা চারা থেকে ১১ থেকে ১৩ মাসের মধ্যেই কলা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। কলার চারা রোপণের জন্য অসি তেউর সবচেয়ে উত্তম। এ চারা মাটিতে লেগে যেতে খুবই কম সময় নেয়। এর কারণ এ চারার গোড়ায় ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য মজুদ থাকে। ফলে মাতৃগাছ থেকে আলাদা করার পরও এ চারার খাদ্যের অভাব হয় না এবং রোপণের পর প্রয়োগকৃত সার থেকে খাদ্য গ্রহণের আগে নিজের মজুদ করা খাদ্য থেকেই কাজ চালিয়ে যায়। অন্যদিকে পানি তেউড়ের চারা মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হতে বেশ সময় লাগে এবং কখনো কখনো বেশ কিছু চারা মারাও যায়। তবে এই ২ প্রকারের চারাই মাটিতে লেগে গেলে ৩-৪ মাস পরে আর এদের আলাদাই করা যায় না। যে ধরনের চারাই রোপণ করা হোক না কেন চারার বয়স প্রায় ৩ মাস এবং চারা সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত বাগান থেকে সেগুলো সংগ্রহ করতে হয়। রোপণের আগে চারার মোথার পুরনো শিকড় ও গোড়ার শুকনো পাতা ফেলতে হয়।
চারা রোপণের আগে ৪-৫ বার আড়াআড়িভাবে জমি চাষ ও মই দিয়ে সমান করে নিতে হয়। এর পর কলা গাছের জাত (দৈহিক গঠন ও বৈশিষ্ট্য) অনুযায়ী সাগর কলার ক্ষেত্রে ২ মিটার এবং সবরি কলার ক্ষেত্রে ২.৫ মিটার দূরত্বে ৬০ সেমি (২ ফুট) ব্যাসার্ধের গর্ত খনন করতে হয়। এই হিসাবে একর প্রতি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২৫০টি কলার চারা রোপণ করা যায়। গর্তটি খনন করার পর গর্তের মাটির সঙ্গে জৈব সার মিশিয়ে কমপক্ষে ৫-৭ দিন রেখে দিতে হয়। চারা রোপণের আগে গর্ত ভরাট করার পর গর্তের মাঝখানে চারার গোড়া অনুযায়ী মাটি সরিয়ে চারাটি সোজাভাবে স্থাপন করে চারদিকে কিছু আলগা মাটি দিয়ে চেপে দিতে হয়। রোপণ কাজ শেষ হলে গোড়ার মাটি পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হয়। কলা গাছ দ্রুত বর্ধনশীল হলেও আশ্বিন মাসে রোপণ করা চারা শীতের কারণে দ্রুত বাড়তে পারে না। তাই শীতের শেষে সার উপরি প্রয়োগ করতে হয়। আশ্বিন মাসে চারা রোপণের আগে গর্তে সার দিতে হয়। গর্তে এবং উপরি হিসেবে নিম্নরূপ পরিমাণে সার প্রয়োগ করতে হয়।
সারের নাম প্রতি গাছে প্রয়োগের পরিমাণ (গ্রাম)
জৈব সার ১০,০০০
ইউরিয়া ৩০০
টিএসপি ১৫০
এমওপি ২৫০
জিপসাম ২০০
জিংক অক্সাইড ১.৫
বোরন সার ২.০
কলার চারা রোপণের পর গর্তে উল্লিখিত পরিমাণের সম্পূর্ণ জৈব সার, টিএসপি, বোরিক সার ও জিংক অক্সাইড এবং অর্ধেক এমওপি এবং অর্ধেক জিপসাম সার দিতে হয়। রোপণের ৩ মাস পর এক-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া এবং ৫-৬ মাস পর বাকি দুই-তৃতীয়াংশ ইউরিয়া, বাকি অর্ধেক এমওপি ও জিপসাম সার গাছের চারপাশে ছিটিয়ে দিয়ে হালকা করে কুপিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয়। মাটি কোপানোর সময় এমনভাবে কোপাতে হবে যেন শিকড় কেটে না যায়। জমির রস বুঝে সার দেয়ার পর সেচ দিতে হয়। তবে ফল বের হওয়ার পর সার প্রয়োগ করা উচিত নয়। কলার চারা রোপণের পর মাটির আর্দ্রতা বা রসের অবস্থা বুঝে সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। আবার বর্ষায় অতিরিক্ত পানি যাতে সহজেই বের হয়ে যায় সে জন্য নিকাশের ব্যবস্থাও করতে হয়। অধিক ফলন ও ভালোমানের কলা পেতে হলে রোপণের ৪-৫ মাস পর থেকে কলা গাছের গোড়া থেকে বের হওয়া চারাগুলো কেটে ফেলতে হয়। একটি কলা গাছে ২০টি পর্যন্ত চারা বের হতে পারে। ফুল বের হওয়ার পর মুড়ি ফসলের জন্য ১টি এবং বিক্রির জন্য ১টি চারা রেখে বাকিগুলো কেটে ফেলা উচিত। কলা বাগানে কোনো আগাছা জন্মাতে দেয়া ঠিক না। এতে কলার ফলন ৫০-৭০ ভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। গাছের অপ্রয়োজনীয় পাতা বা নিচের দিকের হলুদ হয়ে যাওয়া বা শুকনো পাতা কেটে ফেলতে হয়। বর্ষায় গোড়ার মাটি সরে গেলে শিকড় বেরিয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে সারির দুপাশ থেকে অগভীর নালা করে নালার মাটি দিয়ে শিকড় ঢেকে দিতে হয়। কখনোই গোড়া ঢেকে মাটি দেয়া উচিত নয়। মোচা থেকে কলা বের হওয়ার পর শেষোক্ত ফানার ৫-৭ সেমি নিচে থেকে মোচা কেটে দিতে হয়। ঝড়ো বাতাসের থেকে কলার গাছকে রক্ষা করতে অনেক সময় বাঁশের খুঁটি দিয়ে গাছকে ঠেকা দিতে হয়, এতে কলার কাঁদির ভারে গাছ ভেঙে পড়ে না। বিটল পোকা থেকে কলাকে রক্ষা করতে স্বচ্ছ বা নীল পলিথিন ব্যাগ দিয়ে কলার কাঁদি ঢেকে দেয়া যেতে পারে। এতে কলার কাঁদি ধুলাবালি থেকেও রক্ষা পেতে পারে। জাত ভেদে ও পরিচর্যার উপর ভিত্তি করে কলার ফলন বিভিন্ন হতে পারে। যেমন একর প্রতি গড়ে অমৃত সাগর ১০ টন, সবরি, চাঁপা ও কাঁচা কলা ৬ টন, বারি কলা-১ ১৪ টন এবং বারি কলা-২ ৮ টন হয়।
-

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor