Wednesday, September 24, 2008

কৃষির ওপর নির্ভর করে মঙ্গা মোকাবিলার চেষ্টা

২৪.০৯.০৮
ডেসটিনি ।। আফরোজা নাজনীন
প্রতি বছর উত্তরবঙ্গে ‘কমন’ দুর্যোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে মঙ্গা। অনাকাক্সিক্ষত এ মঙ্গার চরম খাদ্য সংকট এখানকার বাসিন্দাদের ওপর বয়ে আনে স্থায়ী দুর্ভোগ। যার ফল ভোগ করতে হয় সারাবছর।
বৃহত্তর রংপুরে বাংলা মাসের আশ্বিন কার্তিকে মঙ্গা দেখা দেয়। ইংরেজি মাসের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। সরেজমিনে দেখা গেছে, আমন চাষের পর মঙ্গাকবলিত এলাকায় কাজের অভাব দেখা দেয়। এর প্রভাব পড়ে সাধারণ হতদরিদ্র মানুষের ওপর। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক জরিপে বলা হয়, মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষ কৃষিক্ষেত্রে শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু এ সময় তাদের শ্রম বিক্রির কোনো সুযোগ থাকে না। তখন কাজ থাকে না, থাকে না তাদের হাতে টাকা। মঙ্গার কারণে দারিদ্র্যের স্ফীতি ঘটে। খাদ্য ঘাটতি হয়, মানুষ অনাহারে থাকে, স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। নারী ও শিশুর মৌলিক চাহিদা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও সামাজিক নিরাপত্তা বিঘিœত হয়। মঙ্গা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর নারী ও শিশু স্বাস্থ্যের। শিশুরা দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টিহীনতার শিকার হয়। রংপুর সিভিল সার্জন দফতর সূত্রে শুধু মিঠাপুকুর উপজেলায় অপুষ্টির বর্তমান পরিস্থিতির কিছু পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। সূত্র মতে, এখানে দু’বছরের নিচের বয়সের শিশু হালকা অপুষ্টিতে ভুগছে ৩ হাজার ৪৭৭ ছেলে, ৩ হাজার ৪৮৫ মেয়ে। মাঝারি অপুষ্টিতে ভুগছে ২ হাজার ৩০০ ছেলে এবং ১ হাজার ৯৭৭ মেয়ে। চরম অপুষ্টিতে ভুগছে ৯৮২ ছেলে ও ৯৫৬ মেয়ে। অপুষ্টিতে ভোগা গর্ভবতী নারীর সংখ্যা ৩ হাজার ৩৫০ জন। সূত্র আরও জানায়, বৃহত্তর রংপুরে রাতকানা রোগে ভুগছে শতকরা ০.২৫ ভাগ।
রংপুর ও কুড়িগ্রামের বিভিন্ন সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, গত ২০০৬ সালে মঙ্গা এলাকায় মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর হার ছিল শতকরা ৭০.৯২ জন। জন্মকালীন কম ওজন শিশুর শতকরা হার ৭০.৫৭। শতকরা ৩৯ ভাগ গর্ভবতী নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছে।
এদিকে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চেলের গ্রামগুলোতে অপুষ্টিতে আক্রান্ত ৩০ লাখ নারী, পুরুষ ও শিশু দৃষ্টিস্বল্পতায় ভুগছে। প্রতি বছর ৪০ হাজার বিকলাঙ্গ, হাবাগোবা শিশু জন্মগ্রহণ করছে। এসব অঞ্চলের মানুষ বেশিরভাগই ভূমিহীন, চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। কামলা খেটে জীবন চালায়। কাজ না পেলে অনাহারে থাকে। অপুষ্টি থেকে রক্ষায় ও মঙ্গা মোকাবিলায় এখানে প্রতি বছরই নতুন নতুন উৎস উদ্ভাাবিত হচ্ছে। প্রধানত কৃষির ওপর নির্ভর করেই এখানকার না খাওয়া মানুষগুলো মঙ্গা মোকাবিলার চেষ্টা করছে। সূর্যের হাসির মতো অতটা উজ্জ্বল না হলেও চাঁদের একফালি আলোর মতো সাফল্য গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের বালুচরে দেখা দিয়েছে। বালু মাটিতে এখন লাখ টাকার ফসল ফলছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, তিস্তা ও ঘাঘট নদীর মোহনার চরে এখন ফসলের বাগান। এখানকার মাটি বালুজাতীয়। ফসল ফলানো কষ্টকর। এ মাটিতে কষ্ট করেই ফলানো হচ্ছে মিষ্টি কুমড়া। প্র্যাকটিকেল অ্যাকশন বাংলাদেশ ও একতা নামের দুটি এনজিও ৯০ সালে থেকে এখানে মিষ্টি কুমড়া চাষে চরবাসীকে সহায়তা করছে। গাইবান্ধার চারটি উপজেলার নয়টি চরে মিষ্টি কুমড়া চাষ হচ্ছে। এখানকার মোট ১৭৭টি গৃহহীন পরিবার মিষ্টি কুমড়া চাষ করে বেঁচে আছে। গত দুবছরে ওরা ৬৭ হাজার মিষ্টি কুমড়া পেয়েছে। যার বাজার মূল্য ২০ লাখ টাকা। গত বছর ৪৬০টি গৃহহীন পরিবারকে ৫ লাখ মেট্রিক টন কুমড়া দেয়া হবে। যার দাম তিন কোটি টাকা। চরে মিষ্টি কুমড়া চাষে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দেয়ার দরকার হয় না বলে এটি পুরোপুরি অর্গানিক সবজি। এদিকে এখানকার স্বাস্থ্য কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, শূন্য থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের ভিটামিন খাওয়ানোর হার শতকরা ৯৫ ভাগ। ৮৮ সালের বন্যার পর তিস্তা অববাহিকায় জেগে ওঠে নতুন চর। নদীভাঙা মানুষ এসে এখানে গড়ে তোলে বসতি। জীবন বাঁচাতে শুরু করে বাদামের চাষ। সেই থেকে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাপাসিয়া এলাকার বালুর চর বাদামের চর নামে পরিচিত। লোকসংখ্যা দুহাজারের একটু বেশি। এ চরে নারী-পুরুষ চাষ করেন বাদাম, মুসুর, কালাই, চীনা জোয়ার, খেসারি, কালাই, ভুট্টা, গম, পটল, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, মরিচ, কুশিয়ার ও বেগুন। বাদামের চরে শুধু আমন মৌসুমে ধান ফলে। নদীর কাছের জমিনে বোরো ধান হয়। আগের দিনে এই তিস্তা পাড়ের প্রধান ফসল ছিল আউশ ধান। এখন আউশ ধান হয় না। ৫-৬ বছর হলো আমনের জাতগুলো কমে গিয়ে এ চরভূমিতে উফশি ধানের চাষই হচ্ছে বেশি। ব্রি-ধান ২৮ এখানে বেশি আবাদ হয়। বিভিন্ন ফসল ও সবজির আবাদে এখানকার হতদরিদ্ররাও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে। আখতারজান (২৯) বলেন, ‘মঙ্গা আইলে শহরের মানুষ কতা কয় বেশি। সাহায্য পাই কম। খাওন নাই। কিন্তু এহন এইহানে কাম পাইছি। এহন থিকা আর খাওনের কষ্ট হইবো না।’ এখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, কুড়িগ্রামের অধিকাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অসম জমি বণ্টন, কৃষি কাজের নিম্নমুখিতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এখানকার বাসিন্দারা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার চরাঞ্চলের কৃষকরা মঙ্গাকে জয় করতে বালুচরে ভুট্টাচাষ শুরু করেছে। জানা যায়, হাতীবান্ধায় গত বছর ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে ভুট্টার আবাদ করা হয়। চরে সিন্দুনার চাষি ইসমাইল আলী জানান, ধানচাষে যে খরচ হয় ভুট্টায় তার চেয়ে কম। ফলনও দ্বিগুণ। এদিকে সরেজমিনে রংপুর ঘুরে দেখা গেছে, শুধু লালমনিরহাট নয়, বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে ভুট্টা চাষে নীরব বিপ্লব ঘটে যাওয়ায় পাল্টে গেছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা। সব ধরনের পতিত জমিতে চলছে ভুট্টা চাষ। জানা গেছে, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধা জেলায় মোট ৩৪ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হচ্ছে। চাষিরা জানিয়েছেন, উৎপাদন ব্যয় বাদ দিয়ে লাভ থাকে দ্বিগুণেরও বেশি। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কাঞ্চিপাড়া ইউনিয়নে বেসরকারি সংস্থা একতা চালু করছে মহিলা সমবায় সমিতি। একতার সমন্বয়কারী আসিফ ইকবাল জানান, স্থায়ীভাবে মঙ্গা মোকাবিলায় ১৬০ জনের একটি দল গঠন করা হয়েছে। দলের প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৫শ টাকা নিয়ে জমি বন্ধক ও ক্রয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ জমিতে চাষ করেই মঙ্গা মোকাবিলার প্রচেষ্টা নেয়া হয়।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor