Wednesday, September 17, 2008

আদিবাসীদের জীবন, সংগ্রাম ও জীবিকায় কৃষি

১৭.০৯.০৮
কৃষি ও পরিবেশ
।।ডেসটিনি।। কৃষিবিদ সরকার মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ

উপজাতিদেরই আদিবাসী বলা হয়। এদের রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ধর্ম ও সংস্কৃতি। তারা বাংলাদেশের পাহাড়ি ও অরণ্য এলাকায় বসবাস করে। আবার কিছু কিছু উপজাতি নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে বাস করে। তবে শত শত বছর ধরে তারা বাঙালি জাতির পাশাপাশি বসবাস করছে বলে তারাও বাঙালি। তাদের বড় পরিচয় তারা এই দেশের সন্তান। আজকের দিনে সব উপজাতির মধ্যেই পরিবর্তনের ঢেউ এসেছে। ফলে তাদের আদিম অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নানা বিচার-বিশ্লেষণে প্রমাণিত হয়েছে আমাদের দেশের আদিম অধিবাসীরা প্রাক-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোক। অনেক কাল আগে এই আদিম অধিবাসীরা বাংলাদেশে এসে তাদের আবাস গড়ে তোলে। এরাই বাঙালি জাতির আদি পুরুষ।
বর্তমানে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা রয়েছে। এই ৬৪ জেলার কয়েকটি জেলায় উপজাতিদের বাস। জেলাগুলো হলোÑ রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, সিলেট, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও পটুয়াখালী। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবন জেলাগুলোতে বাংলাদেশের উপজাতিদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এসব জেলায় চাকমা তয্যংগ্যা, দৈংনাক, কুকি, লুসাই, মুরং, টিপরা (ত্রিপুরা), সেন্দুজ, পাঙ্গো, বনজোগী, খুমি, মগ (মারমা), ম্রো, বোম, খ্যাং, চাক, রিয়াং প্রভৃতি উপজাতি বসবাস করে। ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনা ও জামালপুর জেলায় বাস করে গারো ও হাংজং উপজাতি। সিলেট জেলায় বাস করে খাসিয়া, পাঙন ও মণিপুরী উপজাতি। রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী ও বগুড়া জেলায় বসবাস করে সাঁওতাল, রাজবংশী এবং ওরাও উপজাতি। রাখাইন উপজাতি বসবাস করে পটুয়াখালী জেলায়। মুঘল ও ইংরেজ আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতিদের কোনো প্রকার উন্নতি হতে দেখা যায়নি। পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপজাতিদের জন্য তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি করেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ সরকার এই অঞ্চলের উপজাতিদের জন্য ভালো ভালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে। ১৯৭৬ সালে রাঙ্গামাটি জেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ছাড়া রাঙ্গামাটি জেলায় উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড থেকে প্রতি বছর উপজাতি ছাত্রদের বৃত্তি দেয়া হয়। ফলে চাকমাদের শিক্ষার হার বেড়ে যায়। মোট কথা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই এই অঞ্চলে উপজাতিদের যথেষ্ট উন্নতি হচ্ছে।
চাকমাদের জীবন সংগ্রামে কৃষি : চাকমারা কৃষিজীবী। জুম চাষ করে।
তারা প্রধানত জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। এই জুম চাষকে আরাকানিরা ‘টংগ্যা’ বলে অবহিত করে থাকে। প্রতি দম্পতি দুই থেকে চার একর পর্যন্ত জমি জুম করার অধিকার পায়। যে স্থানে এক বছর জুম করা হয়, চার-পাঁচ বছরের মধ্যে সেখানে আর ফসল উৎপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। এ জন্যই দেখা যায়, তারা এক স্থানে খুব বেশিদিন টিকে থাকে না। জুম অর্জিত ফসলেই তাদের সারা বছর চলে। প্রতি দম্পতিকে জুম চাষ করার জন্য জুম কর দিতে হয়। এই টাকার একটি ভাগ পায় গভর্নমেন্ট, একটি ভাগ পায় সার্কেলভুক্ত রাজা ও বাকি টাকা হেডম্যান পেয়ে থাকেন। বেঙ্গল গভর্নমেন্টের আইন অনুযায়ী তালুক ও দেওয়ান প্রথা উঠে যায় এবং সারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিভিন্ন মৌজায় বিভক্ত করা হয়। এই চাকমাদের যারা নদীর তীরে বসবাস করে তারা লাঙল দিয়ে জমি চাষ করে। তারা নদীতে মাছ ধরে। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর বাঁশ জন্মে। বাঁশ ও বেত দিয়ে চাকমারা ঝুড়ি, চিরুনি, বাঁশি, পাখা ইত্যাদি তৈরি করে ও বিক্রি করে জীবিকা চালায়। এরা দেশীয় কৃষক অপেক্ষা বেশি পরিশ্রম করতে পারে। তাদের অপেক্ষা বেশি আয়ও করে। এরা এত পরিশ্রম ও আয় করেও সুখী হতে পারছে না। বছরের ধান জমা থাকে না ঘরে। দিন দিন ঋণজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। কারণ এদের সবাই খুব বেশি মদ্য পান করে। প্রতি ঘরে মদ্য প্রস্তুত হয়। যত ইচ্ছা পান করে। এদের মদের তৃষ্ণা এত বেশি যে, দেখা গেছে ভাত খাওয়ার চিন্তা অপেক্ষা মদ তৈরি করায় বেশি আগ্রহ। যতদিন তাদের ঘরে ধান থাকে ততদিন মদের ভা- খালি থাকে না। দুই-তিন দিনের পরিশ্রমে যা আয় হয় চার-পাঁচজন একত্রে তা এক মজলিসে ব্যয় করে দেয়। এসব অপব্যয়ে চাকমাদের ঘরে ধান জমা থাকে না। বর্ষাকালে কেউ কেউ অনশনেও থাকে।
তঞ্চংগ্যা ও দৈংনাকদের জীবিকায় কৃষি : এরা জুম চাষের মাধ্যমে নানা রকম ফসল ও তরিতরকারি ফলায়। এরা জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল।
মগদের (মারমা) জীবিকায় কৃষি : মগরা সাধারণত জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। এদের পেশা কৃষি। জুম চাষ সহায়তার জন্য মেয়েরাও তাদের অনুগামী হয়। পুরুষদের চেয়ে মেয়েরাই বেশি কর্মঠ।
কুকিদের জীবিকায় কৃষি : কুকিদের প্রধান খাদ্য ভাত। তারা কৃষি কাজ করে। তারা বাড়িঘরের চারপাশে জুম চাষ করে। জমি কৃষির অযোগ্য হয়ে পড়লে তারা অন্য জায়গায় চলে যায়। নতুন জায়গায় গিয়ে তারা কাজ করে।
লুসাইদের জীবিকা ও কৃষি : পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি মাত্রই জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। জুম অর্জিত ফসলের লুসাইদের সারা বছর চলে যায়। জুম অর্জিত ফসলের মধ্যে কার্পাস অন্যতম। গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামেই কার্পাস প্রভূত পরিমাণে উৎপন্ন হয়। এরা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে কার্পাস বাইরেও রফতানি করে।
মুরংদের জীবিকা : মুরংদের জীবিকা কৃষি কাজে। সংসারের যাবতীয় কাজকর্ম ছাড়াও মুরং মেয়েরা জুম কাজ এবং বনজঙ্গল থেকে কাঠ কাটতে পুরুষদের সহগামী হয়। পুরুষদের চেয়ে মেয়েরা অধিক কর্মঠ। এ কারণে দেখা যায়, একজন মুরং নারী দুই-তিনজন পুরুষের চেয়ে অধিক কাজ সমাধান করতে পারে। মুরংরা কৃষিজীবী হলেও কর্ষণের রীতি তাদের মধ্যে অনুপস্থিত, জুম চাষের ওপরেই তারা নির্ভরশীল। জুম অর্জিত ফসলে তাদের সারা বছর চলে।
ত্রিপুরাদের জীবিকায় কৃষি : অপরাপর পাহাড়ি জাতির মতো ত্রিপুরারাও জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। জুম চাষ অর্জিত ফসলেই তাদের সারা বছর চলে যায়। মেয়ে-পুরুষ উভয়েই জুম চাষে শরিক হয়। এই জুম জীবনকে অনাবিল শান্তির ঝরনাধারা বলা চলে, যা পাহাড় প্রান্তর এক অমিয় রসে সিক্ত করে তোলে।
গারোদের জীবনে কৃষি : গারোরা জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। এই জুম চাষ শুধু গারো কেন অপরাপর পাহাড়ি জাতির মধ্যেও দেখা যায়। সাধারণত গারোরা কার্তিক, অঘ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে পর্বত পাথরের গায়ে ঢালু জায়গায় ছোট ছোট বনজঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে। মাঘ-ফাল্গুন মাসে এই জঙ্গল শুকায় এবং চৈত্র-বৈশাখ মাসে তারা সে জঙ্গল আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে সেই জঙ্গলের ছাই মাটিতে মিশে গিয়ে মাটিকে উর্বরা করে এবং শ্রাবণ মাস থেকে তারা বীজ বপন শুরু করে। দা কিংবা কোদাল দিয়ে মাটিতে গর্ত করে একই সঙ্গে লাউ, কুমড়া, তিল, ধান ও অপরাপর ফলমূলের বীজ বপন করে। এ প্রক্রিয়াকেই জুম চাষ বলে। খাসিয়া, সাঁওতাল, ওরাও, খ্যাং, খুমি, রাজবংশী, রাখাইন প্রভৃতি আদিবাসীরাই কৃষি কাজের ওপর নির্ভরশীল।
এদের অনেক গোষ্ঠীতে কার্পাস চাষাবাদ করে থাকে। তা বিদেশে রফতানি করা হয়। মানুষের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা পুরোপুরি নির্ভর করছে এই কৃষির ওপর। বেত, বাঁশের দ্রব্যাদি খুব সুন্দর করে নির্মাণ করে এরা। এগুলো বিদেশে রফতানি করা যায়। অনেক পতিত পাহাড়ি জমিকে এরা আবাদি বানাচ্ছে। আদিবাসী এলাকা থেকেও সম্ভাবনাময়ী কৃষি শস্য উৎপন্ন করা সম্ভব। এটা সরকারকে বোঝাতে হবে লেখালেখির মাধ্যমে, বিভিন্ন দফতরে এর (কৃষি বিষয়ের নানা তথ্য) উপস্থাপন করে। এদের অনেক গোষ্ঠীতে ভুল ধারণা বিদ্যমান যে, বন্ধ্যা রমণীরা কৃষি কাজে সহায়তা করলে অমঙ্গল হবে। এ ধারণা দূর করাতে হবে। কয়েকটি উপজাতিদের মধ্যে পুরুষরা অসল, কৃষির ক্ষেত্রে এটা দূর করাতে সহায়তা করতে হবে। মুরংদের কর্ষণ রীতিকে জ্ঞান সীমিত, এটা বাড়াতে হবে কৃষিবিদদের দ্বারা। তাদের জৈবসার/কম্পোজ তৈরি শেখাতে হবে। হাঁস-মুরগি পালনের প্রতি আগ্রহ বাড়াতে হবে।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor