Saturday, September 13, 2008

কাসলং অরণ্য কোথায় গেল

১৪.০৯.০৮
উপসম্পাদকীয়
পথে পথে
।।সমকাল।।বিপ্রদাশ বড়ূয়া

বাঘাইহাট থেকে আবার যাত্রা শুরু। রোদ ও মেঘ খেলা করছে। আমি বোটের আগায় বসতে চেয়েও পাইনি। ওখানে বোটের সহকারী লগি হাতে সবসময় প্রস্ট‘ত। কখন, কোথায় চর, ডুবো গাছ চোখে পড়ে সে অনুযায়ী সে সংকেত দেয় লগি দিয়ে। হালে বসা মাঝি তখন নৌকো ডানে-বাঁয়ে বা গতি কমিয়ে দেবে ইঞ্জিন দড়ি দিয়ে টান মেরে। তার এক হাতে হাল, অন্য হাতে দড়ি (মাঝে মধ্যে দড়ি ছেড়ে দেয়)। মারিশ্যা থেকে কাসলং নদীর দু’পাশে বিখ্যাত কাসলং রিজার্ভ ফরে¯দ্ব। ১৯০৯ সালে কাসলং ও মায়ানী সংরক্ষিত বন চাকমা রাজার অধীনে পড়ে ৭২৮.৪ বর্গমাইল, সুভলং ৩৪.৫ রুমা, ঠেকা ৭০.০০ ব.মা., বরকল ০.৫ ব.মা. রাইং খ্যাং (কর্ণফুলীর বাঁ পাশে) ২১৫.০ ব.মা. সীতা পাহাড় (কর্ণফুলী নদীর ডান পাশে) ২৮.০ ব.মা.। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা গেজেটিয়ারে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর ডিভিশনে (কাপ্টøাই বাঁধের আগের হিসেবে) বনাঞ্চল ৬৭৯.৫০ বর্গমাইল, দক্ষিণ ডিভিশনে ৩২১.৯৯ ব.মা. এর বাইরে সরকারি বন ৩.৪০০.০ ব.মা.।
কাপ্টøাই বাঁধ হওয়ার পর দেখা যায় সর্বমোট ৩০৪ ব.মা. এলাকা অরণ্য জলের নিচে চলে গেছে। উপরোক্ত হিসাব যদি সত্য হয় অরণ্য ধ্বংস সরাসরি পানির নিচে ডুবে শেষ হয়নি। এর পেছনে অন্য কারণ রয়েছে। সেই কারণ অনুসল্পব্দান করতে গিয়ে চোখে যা দেখলাম তা ভয়াবহ। এর জন্য অদহৃরদর্শিতা, পরিকল্কপ্পনাহীনতাই দায়ী। বাঁধের ফলে উর্বর ভূমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে সরকারই সংরক্ষিত বনে ঢুকিয়ে দিয়েছে আইনসঙ্গতভাবে। অর্থাৎ ১৯৫৫ সালে গঠিত পুনর্বাসন সাব-কমিটির রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে কাসলং, রাইং খ্যাং ও ঠেগা সংরক্ষিত বনের কিছু এলাকা বন বিভাগ থেকে নিয়ে উ™^াস্ট‘দের জন্য মুক্ত করে দেওয়া হয় (সহৃত্র : চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত, বিরাজমোহন দেওয়ান পৃ. ২১৬, ১৯৬৯)।
কাসলং নদী ধরে যত এগিয়ে যাই মন হুহু করতে থাকে। এ কী দেখছি আমি? আমি কি এ কাসলং দেখতে এসেছি? এই আমার দেশের সংরক্ষিত বন? কোথায় বন? আমি কোথাও বন দেখিনি, কোথাও অরণ্যের শোভা নেই, অরণ্যের প্রহরী শতা¦ন্ধীর গর্জন, চুন্দুল, চাল্ফ^া (চ¤ক্সা), গামারি, জারুল, শিমুল, তেঁতুল, নাগকেশর, পদাউক নেই। আমার মনের মধ্যে নিজে নিজে প্রশেুাত্তর চলল।
কোথায় গেল তারা? শতা¦ন্ধীর বনবৃক্ষরা?
নেই।
কেন নেই?
বনের রক্ষাকর্তা কেউ নই বলেই। উ™^াস্ট‘দের জীবিকার কোনো ব্যবস্ট’া করে দেওয়া হয়নি বলেই।
কেন নেই? কেন তাদের সংরক্ষিত বনের উপনির্ভরশীল হতে দেওয়া হলো।
আমি জানি না। আর এখানো সেটেলারদের জীবন ও জীবিকার ব্যবস্ট’া করে দেওয়া হয়নি। এজন্যই পাহাড়ি ও সেটেলারদের মধ্যে নিত্য নীরব ও সরব সংঘর্ষ চলছে। তার ওপর এ বছর বাঁশে ফুল ফোটা শুরু হয়েছে। দশ-বারো বছর বা কয়েক বছর বিরতি দিয়ে বাঁশে ফুল ফোটে। কালিচুরি বাঁশে সাধারণত ফুল ফোটে। এর বীজ ছোট। এ্যাইচ্যা বা যাকে ভাইজ্যা বাঁশ বলে তাতে ফুল ফোটেনি। কেউ কেউ বলে এ বাঁশে ফুল হলেও নির্বংশ হয় না। এর বীজ বড়, মুঠো থেকে ছোট হয়। মিরতিঙ্গা বাঁশেও ফুল আসেনি। কালিচুরি বাঁশে এসেছে, এই বাঁশই তো বেশি। তার ওপর পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলার উত্তর অংশে এ বছরের গোড়ার দিক থেকে। ইঁদুরবন্যা সর্বনাশার আকার নেয়। ছোট হরিণা এলাকায় গত ডিসেল্ফ^রে তা আমি নিজের চোখে দেখে এসেছি। এর একমাত্র প্রতিকার সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে যত পার ইঁদুর নিধন। পাশর্^বর্তী মিজোরাম রাজ্যেও একটি লেজের জন্য এক টাকা দিয়ে ইঁদুরের বিরু™েব্দ সর্বাͧক নিধন চলেছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্টøদের নগদ অর্থ ও খাদ্য সাহায্য করা হয়েছে। এখন বিশ^ খাদ্য সংস্ট’া ইঁদুর বন্যাকবলিতদের মধ্যে খাদ্য সাহায্য দিচ্ছে। কিন্তু বাঁশে ফুল ফোটার বিরু™েব্দ কিছু করার নেই। এটি প্রাকৃতিক। যতদহৃর যাই কাসলংয়ের দু’তীরের কালিচুরি বাঁশের পাতা নেই। মরে গেছে। ফুল থেকে ছোট ছোট বীজ হয়েছে। কালিচুরি, পাইয়া বা গৃহকর্মে নিত্য ব্যবহার্য বাঁশ। শেষ। আবার আপনাআপনি বাঁশের জš§ হবে। প্রকৃতির মাঝে স্ট^াভাবিকভাবে এ মৃত্যু ও জšে§র খেলা চলছে।
চালতাও এখানকার স্ট^াভাবিক গাছ। চলতাকে চাকমারা বলে উরু। নদীতে পানি কম। আবার ঠেকে যায়, আবার গর্জন তুলে ইঞ্জিন চলে। এরই মধ্যে দু’বার ইঞ্জিন বিগড়ে গিয়েছিল। আমাদের থামাতে পারেনি, মাঝি ঠিক করে নিয়েছে। দু’পাহাড় নেড়া অথবা নতুন জুমের ধান ও হলুদ লকলক করছে। মাঝে মধ্যে ভুট্টা ও ঢেঁড়স। কোথাও ঝিঙেলতা, মারফা, চিনার লতা। লাঙল পাড়া পেরিয়ে গেলাম। কত পাড়া ও ছড়া যে পেরিয়ে যাচ্ছি, সবার নাম জানা হয়নি।
হঠাৎ কোনো একটা গাছে দেখি অশোকের মতো ফুল, গুচ্ছব™ব্দ। কেভি বা ককুচ্ছন্দ ভিক্ষু বলতে পারলেন না। এত দহৃর থেকে তোলা ছবি থেকে শনাক্ত করা সল্ফ¢ব নয়। গুটগুইট্টা গাছ পাহাড়ের মহৃল্যবান গাছ। কাসলং বৌ™ব্দ বিহারের গাছ থেকে পেড়ে নিয়ে এর ছবি তুলেছি, চোখে দেখেছি। প্রায় আদি মেইগনির মতো পাতা। গুটগুইট্যায় ফুল আসে গ্রীষ্ফে§, তারপর ফল ভাদ্রে পাকে। ওই লটকনের মতো প্রায়, তেমনি খাওয়া যায়। তবে পাকলে নাকি বেশি টক। চাকমা সাহিত্যে এর সরব উপস্টি’তি রয়েছে।
নদীতে শিশুরা দল নিয়ে আসছে। একাও। নিজে নিজে সাঁতার শিখে নিয়েছে। এত ছোট শিশুকে একা আমরা কখনো এমন নদীতে পাঠাতে পারতাম না। মায়ের কোলে দু¹ব্দপোষ্য শিশু নাইছে। ১১.১০টায় চাঁদনি ছড়া। বোয়া গাছ, নরম কাঠ। ছোট বক, প্রায় কালো একে কি কানাবক বলে? পথে বারো-তেরো জনের একদল সেনা উঠল বোটে। ওরা উজানে গিয়ে ১১.৪৫টায় দক্ষিণ নন্দ বাসে পৌঁছে অবশেষে নামল, ভিক্ষুদের খাওয়ার সময়। পনেরো মিনিটে সারতে হবে। দক্ষিণ নন্দরাম পৌঁছলাম ১২.৩০টায়। আরো কত দহৃর। দুটায় মাসলং পৌঁছলাম। মাইট ভারালা ছড়ায় দেখি বাঁ দিক থেকে চমৎকার ঝরনা। দেখতে দেখতে, ছবি নিতে নিতে চলে গেল। ককুছন্দ বললেন ২০০৩ সালেও এখানে চমৎকার গভীর অরণ্য ছিল। তারপর হঠাৎ বন উধাও। সিন্দুরীর বীজের মতো ফল নিয়ে বড় গাছ। কিন্তু সিন্দুরীর তো এত বড় গাছ হয় না! হাতি ঘাস নদীর কূল দখল করে আছে প্রবল প্রতাপে। সাদা গা জারুল কী সুন্দর!
মাসলং পৌঁছতে এত কিছু দেখা হলো যে কাহন কাহন লিখেও শেষ করা যাবে না। কুকুর দুটি, বানর, নদীর স্রোত ঠিক রাখার জন্য বাঁশের বেড়া, ডুগ বসিয়ে মাছ ধরা, ছোট লোহা কাঠ গাছ। ‘পুগি’ হলো দিনে কামড়ানো উড়šø পোকা, বিষাক্ত নয়। রাতে কামড়ায়, বিষাক্ত। আর আছে ডাইঙ্গা, অর্থাৎ ডেঙ্গু মশা। আমি ম্যালেরিয়ার ওষুধ খাচ্ছি, না হওয়ার জন্য মাসলং বৌ™ব্দ বিহার উঁচু পাহাড়ে। তার পুবে পুরো (পরী) গোলাসুখ পাহাড়। তার আছে পরীর কাহিনীর পাথর। মাসলং বিহারের উঁচু পাহাড় থেকে দেখছি। ওদিকে মাসলং সেনাক্যা¤ক্স। ওদিকে সেতু তৈরি হচ্ছে। রাস্টøা চাই। রাস্টøা হলে জনগণের চেয়ে সরকারের সুবিধা কেন জানেন তো?
হ লেখক : কথাসাহিত্যিক

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor