Wednesday, September 17, 2008

চাষি ক্ষেতে চালাইছে হাল

১৮.০৯.০৮
দৃষ্টিকোন
।।ডেসটিনি।। বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী

সম্প্রতি সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে জানা গেল বাংলাদেশে কৃষি জমির পরিমাণ ক্রমাগত কমছে। যদিও এটা আশঙ্কাজনক তথ্য; কিন্তু পেশাদার রাজনীতিকদের শোরগোলে ঘটনাটি হারিয়ে গেল। ক্ষমতার জন্য ক্ষমতা চাই আর কিছ্রু জন্য নয়Ñ এ মানসিকতায় আচ্ছন্ন এই পেশাদাররা ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের চিন্তায় আসেনি কিংবা আল্লাহ না করুন যদি ক্ষমতা দখল করেন তখনো সম্ভবত তাদের চিন্তায় আসবে না যে বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটির সামগ্রিক আর্থব্যবস্থা হিসেবে কৃষক অর্থনীতিকে গণ্য করতে হবে। তারা ভুলে গেছেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সঠিক অর্থে ছিল বাংলাদেশের কৃষকদের সশস্ত্র অভ্যুত্থান এবং ধারণা করা হয়েছিল এটা হবে ষোলোআনা চূড়ান্ত অভ্যুত্থান। এখন দেখা যাচ্ছে সেটা হয়নি। ইতিহাস থেকে বিশেষ করে শোষকশ্রেণী কোনো সময় শিক্ষা নেয়নি। এখনো নিচ্ছে না। তাদের সচকিত করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের কৃষকদের সংগ্রামের তালিকা যদিও অসম্পূর্ণ দেয়া হলো : কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৩-৬৯)Ñ ইংরেজ গভর্নর জেনারেল হেস্টিংস এই কৃষক বিদ্রোহের নাম দেন সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, ত্রিপুরায় কৃষক বিদ্রোহ (১৭৬৭-৬৮), সন্দ্বীপের বিদ্রোহ (১৭৬৯, ১৮১৯, ১৮৭০), কৃষক-তাঁতি বিদ্রোহ (১৭৭০-১৮০০), নীলচাষিদের বিদ্রোহ (১৭৭৮-১৮০০, ১৮৩০-৪৮, ১৮৫৯-৬১), লবণচাষিদের বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০৪), রেশমচাষিদের বিদ্রোহ (১৭৮০-১৮০০), রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩), যশোর-খুলনা বিদ্রোহ (১৭৮৪-১৭৯৬), বরিশালের দক্ষিণ অঞ্চলে বিদ্রোহ (১৭৯২), মৈমনসিংহে গারো বিদ্রোহ (১৭৭৫-১৮০২, ১৮৩৭-৮২), মৈমনসিংহে কৃষক বিদ্রোহ (১৮১২) ও হাতিখেদা বিদ্রোহ (১৮৩০), মহাবিদ্রোহ যা সিপাহি বিদ্রোহ নামে পরিচিত (১৮৫৭), সুন্দরবন অঞ্চলে বিদ্রোহ (১৮৬১), সিরাজগঞ্জ বিদ্রোহ (১৮৭২-৭৩), তেভাগা বিদ্রোহ (১৯৪৬-৪৭) ইত্যাদি।
হ্যাঁ, এখন গোড়ায় ফিরে বাংলাদেশকে কেন কৃষক অর্থনীতি হিসেবে গণ্য করতে হবে তার পক্ষে যুক্তি দিতে হয়। ড্যানিয়েল থর্নার ইংরেজি ভাষায় লেখা কৃষক এবং কৃষকসমাজ বইটিতে একটি দেশকে কৃষক অর্থনীতি হিসেবে কেন গণ্য করতে হবে তার যে কটি নির্ণয়কের উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে তিনটি প্রধান হচ্ছেÑ এক. দেশটির জনসংখ্যার কমপক্ষে অর্ধেক অংশকে কৃষিনির্ভর কিংবা কৃষক হতে হবে। দুই. দেশটির শ্রমশক্তির অর্ধেকের বেশি অংশকে কৃষিক্ষেত্রে নিয়োজিত থাকতে হবে। তিন. উৎপাদনের ইউনিট হবে কৃষকের পারিবারিক গৃহস্থালি যা প্রধানত পরিবারের সদস্যদের শারীরিক পরিশ্রমে শস্য উৎপাদন করা হয়। কৃষক গৃহস্থালির প্রধান কাজ হচ্ছে নিজস্ব পারিবারিক জমি চাষ করা। যদিও সে কাজে ভাড়া করা মজুর নেয়া হতে পারে, কিন্তু শস্য উৎপাদনে তাদের খরিদা, শ্রমের পরিমাণ পরিবারের সদস্যদের তুলনায় অনেক কম হবে। কৃষক পরিবার চাষের অবসরে অন্য কাজও করতে পারে, যেমন হস্তশিল্প (মাদুর, ঝুড়ি, তালপাখা, কাঁথা সেলাই ইত্যাদি), প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্যবস্তু (তেল, গুড়, আচার ইত্যাদি), এমনকি ক্ষুদ্র ব্যবসা (মুদির দোকান, ফেরিওয়ালা) কৃষি অর্থনীতির এই অতি সরল সংজ্ঞাটি বুঝতে না পারার কোনো হেতু নেই তথাপি পেশাদার রাজনীতিকরা এ যাবৎকাল ‘উন্নয়ন উন্নয়ন’ চিৎকারে কান ঝালাপালা করে দিয়েছেন এবং তাদের উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থ হচ্ছে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে আধুনিক শিল্প তৈরি করে উন্নয়নের জোয়ারে দেশ ভাসিয়ে নিয়ে জনগণের জীবনের মান বাড়াতে হবে। কিন্তু দুনিয়াব্যাপী শিল্প বিস্তারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের কথিত মত উন্নয়নের রাস্তায় হাঁটতে গেলে যত দ্রুতগতিতে চলা যাক না কেন, আগামী দুই শতকেও এক কোটি কৃষক যদি ক্ষেত ছেড়ে আসেন তারা কলকারখানায় কাজ পারেন না। বাদবাকি কয়েক কোটি কৃষককে জমি চাষাবাদেই থাকতে হবে। অন্যদিকে কলকারখানায় পণ্য তৈরির আসল লক্ষ্য লাভে বিক্রি করে মুনাফা করা। সেক্ষেত্রে লাভের অংশের সিংহভাগ মালিকরা নেন আর যত কম দেয়া সম্ভব সেটা শ্রমিকদের দেন কিংবা পণ্যের চাহিদা কমলে শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়। তাহলে কী অবস্থায় আসা গেল! কৃষক তার ক্ষেত হারিয়ে তার আয় হ্রাস হলেও নিস্তার পাবেন না, তিনি শেষমেশ জীবিকাই হারাবেন।
১৯৯৪ সালে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ব্রুসরিচের লেখা ‘মর্টগেজিং দি আর্থ’ (জমিকে বন্ধক দিয়ে) নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। ৩৭৬ পৃষ্ঠার বইটিতে ‘উন্নয়ন’-এর নামে ধ্বংস সাধনের বিস্তর বিশদ বিবরণ, তথ্য ও উপাত্ত আছে। লেখকের প্রধান লক্ষ্য বিশ্বব্যাংক। তিনি লিখেছেন, ‘ঋণ দেয়া ব্যাংকের কাজ, ঋণের চাহিদা না থাকলে ঋণ নেয়ার জন্য আগ্রহী উমেদার না থাকলে ব্যাংকের ব্যবসা চলবে না। বিশ্বব্যাংকের তহবিল বিশাল। স্বাভাবিক অল্পসল্প ঋণের চাহিদা তার পক্ষে যথেষ্ট নয়, ঋণের চাহিদা বানানো নানা রকম চাকচিক্য ও প্রলোভন এবং কিছু ঘুষঘাষ দিয়েও গরিব দেশগুলোর কর্তাদের বিশ্বব্যাংকের দারস্থ করানো ব্যাংকের কাজের মধ্যেই পড়ে।’ ব্রুসরিচ বইটির অন্যত্র লিখেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে, প্ররোচনায় তদারকিতে বিশ্বব্যাংকের লগ্নিকরা ঋণের টাকায় উন্নয়নের নামে বিপুল অপকর্ম করা হয়েছে। যার জন্য হাজার হাজার পরিবারকে বাস্তুভূমি থেকে বিতাড়ন করা হয়েছে। বহু মানুষের জীবিকা সংস্থানের উপায়গুলো কেড়ে নেয়া হয়েছে। দরিদ্র তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ভেতরে আবার দরিদ্রতর এক চতুর্থ বিশ্ব আবির্ভূত হয়েছে। গৃহহীন, জীবিকাহীন, অনাহারক্লিষ্ট, রোগগ্রস্ত মানুষ। যাদের সংখ্যা বাড়ছে (অনুবাদ জ্যোতি ভট্টাচার্য)।’ জনগণের সবার আগে দরকার খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান। নিশ্চয়ই সবার আগে দরকার নেই স্টিল মিল কিংবা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি।
এখন যদি বলা যায় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রাণবান বেগবান করতে হলে সবার আগে কৃষির ক্ষেত্রে হাত দিতে হবে, তাহলে নিশ্চয়ই তা যে কেউ সমর্থন করবেন। তবে এখানেও প-িতরা হাজির হবেন। তারা বলবেন, হালের বদলে ট্রাক্টর আনতে হবে, সেচপাম্প বসাতে হবে এবং তার জন্য লাগবে বিদ্যুৎ। চাষের জমি খ- খ- হওয়ায় বড় সমবায় খামার করতে হবে। এসব তত্ত্ব ভুল, সবই ভুল। চাষে বিরাট যন্ত্রপাতি সেসব দেশে তৈরি হয়েছিল, যেখানে প্রচুর জমি ছিল, অথচ সে তুলনায় কৃষক কম ছিল। আমাদের দেশে যত মানুষ চাষের কাজে নিযুক্ত আছেন, বড় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে দশ ভাগের নয় ভাগ মানুষ বেকার হয়ে যাবেন এবং ইতিপূর্বে বলেছি দ্রুততম শিল্প-উন্নয়নেও তাদের ক্ষুদ্রতম অংশকেও কাজ দেয়া যাবে না। বিদ্যুৎচালিত সেচপাম্প নয়, আমাদের দরকার উৎকৃষ্ট সেচ ব্যবস্থা। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এক স্মারক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য অংশের তুলনায় এটা আমাদের জন্য ছিল স্রষ্টার এক বিশেষ দান, যা আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলাম। এ কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ছিল শ্রমের মধ্যে, যৌথ বা একক শ্রমে নদীকে বেঁধে রাখা, যেখানে প্রয়োজন সেখানে গতিপথকে সাহায্য করা এবং তার পানিকে উপযুক্তভাবে ব্যবহার করা। অসংখ্য গ্রামের যৌথ জীবনযাত্রার এটাই ছিল মূল ভিত্তি। উনিক শতকে বিদেশিরা যখন এ উপমহাদেশের সেচ ব্যবস্থা সম্পর্কে উৎসুক দেখাল, তখন বাংলা কিন্তু নজর দেয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়নি। এখানে পানি এত প্রচুর যে, এর উপযুক্ত ব্যবহারের জন্য বিস্তারিত এবং সযতœ বিবেচনা আবশ্যক, ব্রিটিশ শাসনের শেষ সময়ের আগে কারও মাথায় আসেনি। পাকিস্তানি আমলে এ চিত্রের খুব একটা হেরফের হয়নি। এখন আমরা নিজেরা নিজেদের প্রভু, তবু কি অবস্থার খুব একটা পার্থক্য দেখা যাচ্ছে?’ (অনুবাদ, তানভীর মোকাম্মেল)
শেষ প্রশ্নটি হবে কৃষকদের সহজ কিস্তিতে অল্প সুদে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা কি কোনো সরকার করেছে? হ্যাঁ, সরকারি কৃষি ব্যাংক আছে। কিন্তু তার হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে। সম্ভবত ১০ বছর আগে ব্যাংকটির তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক দুঃখ করে আমাকে এ কথাটি বলেছিলেন। এখন সে রকমই চলছে। সুযোগ পেয়ে ঢাকঢোল পেটানো বেসরকারি ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষকদের পোষণ করছে বললেও আসলে তারা কৃষকদের শোষণ করছে। ঋণের টাকার ওপর তাদের আদায়ী সুদের হার বিবেচনা করলেই এ সত্যটি বের হয়ে আসবে। অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. খলীকুজ্জামান কর্তৃক সম্পাদিত বইয়ে গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্র্যাক, আশা ও প্রশিকা কর্তৃক আদায়কৃত সুদের হার (অর্থনীতির সংজ্ঞায় রেট অব অ্যাফেক্টিভ কস্ট অব ক্রেডিট) যথাক্রমে ৩০.৫ শতাংশ, ৪৪.৮ শতাংশ, ৪৪.৮ শতাংশ এবং ৪২.৩ শতাংশ। আমার লেখাটির এ জন্য শিরোনাম রবীন্দ্রনাথের ‘ঐকতান’ কবিতাটির একটি পঙক্তি যার সঙ্গে যোগ করতে হবে কবিতাটির আর একটি পঙক্তিÑ ‘তারি পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।’ অর্থাৎ কৃষকদের বাঁচাতে হবে, নতুবা বাংলাদেশের উন্নয়ন নেই। য়
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিমকোর্ট

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor