Saturday, September 13, 2008

শাক সবজি উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তা

১৪.০৯.০৮
।।ইত্তেফাক।। গৌতম কুমার রায়

সমস্ত- পৃথিবীর মানুষ আজ দুটো বিষয়ে বেশ চিন্তিত। তার একটি হল পরিবেশ পরিবর্তন, অপরটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনে খাদ্যশস্য উৎপাদনেও প্রভাব পড়েছে। তারপর ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠির খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য প্রতিযোগিতা ভিত্তিক কৃষিজ উৎপাদনের জন্য গুণগত মাত্রা যাচাই-বাছাই না করেই তার উৎপাদন করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তি থেকে শুরু করে কৃষি ও পরিবেশবাদীরা আজ পরিবর্তিত ধারার সাথে খাপ খাইয়ে মানুষের স্বাস্থ্য অটুট রাখার মত খাদ্য উৎপাদনের বিষয়ে নজর দিয়েছেন। যে জন্য কৃষিজ উৎপাদনে কোনরূপ রাসায়ানিক সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশক, গ্রোথ হরমোন, এন্টিবায়টিক এমনকি অন্য যে কোন কৃত্রিম উপকরণ ব্যবহার না করে প্রকৃতি প্রদত্ত উপকরণ ব্যবহারের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদনে মনোনিবেশ করেছেন। সেই প্রয়োজনে বিকল্প খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে টিকে থাকার প্রয়াস নিচ্ছেন। এজন্য এখন সবখানে উচ্চারিত হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্যকে অটুট রেখে জৈবিক ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ বান্ধব ফসল তৈরিতে অর্গানিক ফার্মিং পদ্ধতির আমন্ত্রণ। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় পৃথিবীতে ৩০.৬ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে জৈব কৃষি বা অর্গানিক ফার্মিং হয়। যা পৃথিবীর চলমান আবাদী জমির ২ শতাংশ। এই পদ্ধতিতে আগত খাদ্যদ্রব্য বিক্রি হয় বছরে ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

হাইব্রিড বা উচ্চফলনশীল খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এবং ভোগ করে মানুষের শারীরিক ধরনটা “ব্রয়লার মুরগির বডি স্ট্রেন্থ” এর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। কেননা খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করতে গিয়ে যে কৃত্রিম সার, ওষুধ বা বিষাক্ত রাসায়ানিক দ্রব্যাদির ক্ষতিকর প্রভাব শুধু মাটি, জল, পরিবেশ পর্যন্তই পৌঁছেনি তা এখন মানব স্বাস্থ্যকেও স্পর্শ করেছে। যে জন্য মানুষের জন্য যেমন নিত্য নতুন রোগ জন্ম নিয়েছে আবার ফসলের জন্যও অদ্ভুদ সব রোগবালাই এসে হাজির হয়েছে। এতসবের পরেও আমাদের প্রতিদিনের ফেলে দেয়া শাক-সবজির উচ্ছিষ্টাংশ, গবাদি পশুর পরিত্যাক্ত মলমূত্র, সহজ উৎপাদনে সক্ষম গাছপালা, খৈল এমনকি প্রকৃতির লাঙ্গল কেঁচো দিয়ে আমরা পরিবেশ ভারসাম্য জৈব সারের ব্যবহার করতে পারি। যাতে একদিকে যেমন প্রয়োজনীয় পুষ্টির উপযুক্ত মাত্রা বিদ্যমান থাকবে, অপরদিকে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ওই সারে উপাদিত ফসলের কোন ঝুঁকিই থাকে না। পৃথিবীর উন্নত দেশেগুলো যেমন আমেরিকার দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, এখানে একসময় মাংসের তৈরি খাদ্য যে দামে বিক্রি হত, আজকে সবজির তৈরি খাদ্য দ্রব্য সেই দামে বিক্রি হয়। মাংসের সেই খাদ্য হতে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে বলা যায়। মানুষের মাঝে এই উপলদ্ধি এসেছে যে, কৃত্রিম কোনকিছু দিয়ে মানুষের স্বাস্থ্য নয়, প্রকৃতির নিয়মে তা চললে মানুষ অনেকদিন বাঁচতে পারবে।

প্রতিনিয়ত কীটনাশক, রাসায়ানিক দ্রব্য বা পেষ্টিসাইড ব্যবহার করাতে আমাদের কৃষিজ রিসোর্সগুলো তার সাবলীল শক্তি হারিয়ে ফেলছে। মাটি, জল, বায়ু, আলো যে স্বকীয়তা নিয়ে কৃষি উৎপাদনে অবদান রাখার কথা, তা না হয়ে এ ক্ষেত্রগুলো আজ ধারাবাহিকভাবেই উর্বরতা বৃদ্ধির নামে শক্তির স্থায়ী শেলগুলো শুধুমাত্র রাসায়ানিক শক্তির কারণে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের বিশাল জলজ সম্পদে সৃষ্ট প্রাণীজ প্রোটিন আমাদের প্রয়োজনের অনেকটাই পূরণ করে থাকে। এ ক্ষেত্রেও যদি যে কোন জলাশয়, পুকুর বা হাওড়-বাওড়ে মাছ উৎপাদনে কৃত্রিম বা রাসায়ানিক উপযোগ ছাড়া প্রাকৃতিক খাদ্যের যোগানের মাধ্যমে তা করা যায়, তবে মনে হয় আমরা অল্প যোগানে পরিপূর্ণ ও অটুট প্রোটিন এখান থেকে পেতে পারি।

পুকুরে রাসায়নিক সারের ব্যবহারে সুবিধাগুলোর বিপরীত ফল পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রকৃতিগত শক্তি স্থায়ী এবং ভাল। আর কৃত্রিম শক্তির প্রভাবে ভাল ফলাফলের আশা ক্ষীণ। এখানে আরও মনে রাখার কথা হল, বছর বছর রাসায়নিক বা অজৈব সার ব্যবহারের ফলে পুকুরের মাটিতে ও পানিতে অ¤¬ত্ব প্রচুর পরিমাণে বাড়ে। আর এই অ¤¬ত্বকে চুন প্রয়োগ করেও রোধ করা সম্ভব হয় না। তবে জৈব সারের ব্যবহারের জন্য যে অ¤¬ত্বের সৃষ্টি হয় তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। এছাড়া রাসায়নিক বা অজৈব সারের ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক কোন খাদ্য সৃষ্টি হয় না। তবে ক্ষুদ্র উদ্ভিদকণা সৃষ্টি হয় ব্যাপকভাবে। যে জন্য পুকুরের জল সবসময় সবুজ থেকে ঘন সবুজে পরিণত হয়। এই জলে ক্ষুদ্র প্রাণীকণার জন্ম হয় না। এক পর্যায়ে তলদেশে শ্যাওলার জন্ম হয় তা থেকে নিঃসৃত রসের জন্য মাছের জীবনধারণ করা সম্ভব হয় না। এভাবে ব্যাপক শ্যাওলা সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র উদ্ভিদকণার জন্ম নেবার ফলে তলদেশে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারে না। যে জন্য এক পর্যায়ে তলদেশের ক্ষুদ্র উদ্ভিদকণা মরে পচে যায়। এভাবে তলদেশে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমতে কমতে শেষ হয়ে যায়। তখন মাছ অক্সিজেনের অভাবে মরে ভেসে ওঠে।

আমরা আমাদের কাঙ্খিত উৎপাদন না পেলেই পরিবেশের পরিবর্তিত ধারাকে দোষারোপ করে থাকি। অথচ রাসায়ানিক সারের ঝক্কিটা গিয়ে ঠেকেছে অনেক দূর পর্যš-। এতে আমাদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ছাড়াও, এর প্রভাবে বিলুপ্ত বা অ¯ি-ত্বের সংকটে অনেক স্থল ও জলজ প্রাণী, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গসহ বনের পাখিরাও অর্থাৎ এই উপকরণ ব্যবহারের ফলে জীববৈচিত্র ধরে রাখতে পারছি না।

যে বিষয়টি স্পষ্টত তা হল জৈব সার দিয়ে চাষ করে লাভবান হওয়া যেমন সহজ, তেমন চাষের ক্ষেত্রও ভাল থাকে। অপর দিকে রাসায়নিক বা অজৈব সারে পুকুরের মাটি, জলের উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়। পক্ষাš-রে ফলন কম আসে। কেননা মানবজাতির ঘূর্ণায়মাণ জীবনচক্রে রাসায়নিক সারের প্রভাব ক্ষতিকর। প্রতিদিনের আহারের প্রয়োজনের মাধ্যমে যে খাদ্যসামগ্রী আমরা শরীরে গ্রহণ করি, তার মাধ্যমে যদি রাসায়নিক সারে উৎপাদিত কোন সামগ্রী শরীরে প্রবেশ করে, তবে ঐ সারের ক্ষতিকর প্রভাবের আমরাও হয়ে যাই অংশীদার। আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষের জীবন নিরাপত্তা এবং সুস্বাস্থ্য রক্ষার বলয় তৈরির জন্য অর্গানিক ফার্মিং এ জৈবসারের ব্যবহার যতটা না সহজ ও সাবলীল, রাসায়ানিক দ্রব্যের ব্যবহারে উৎপাদিত ফসল তার চেয়ে ঢের বেশি হুমকি স্বরূপ। তাই পৃথিবীতে এখন ভেজিট্যাবল ফুড গ্রহণের আন্দোলন ক্রমশ দানা বেঁধে উঠছে এবং তা হতে হচ্ছে যে কোন রাসায়ানিক দ্রব্যের মাধ্যমে উৎপাদনযোগ্য খাদ্য ছাড়া।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor