Wednesday, September 17, 2008

নারিকেল বীজ বপনের এখনই সময়

১৭.০৯.০৮
কৃষি ও পরিবেশ
।।ডেসটিনি।। নৃপেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী

বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসলগুলোর মধ্যে নারিকেল অন্যতম।
চাষ পদ্ধতি
আবহাওয়া : উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ায় নারিকেল ভালো জন্মে। চাষের জন্য বছরে ১০০ থেকে ৩০০ সেন্টিমিটার সুষম বৃষ্টিপাত দরকার।
বার্ষিক গড় তাপমাত্রা প্রয়োজন ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সমুদ্র উপকূলে দিন ও রাতের তাপমাত্রার তারতম্য কম থাকায় এবং আবহাওয়া উষ্ণ ও আর্দ্র থাকে বলে নারিকেলের উৎপাদন ভালো হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৫০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত এর চাষ লাভজনক। নারিকেল চাষে প্রচুর সূর্যালোক প্রয়োজন। বছরে অন্তত ২ হাজার ঘণ্টার অধিক সূর্যালোক খুবই জরুরি। ফল পরিপক্ব হওয়ার শেষে ৪ মাস সূর্যের আলোর সঙ্গে নারিকেলের শাঁস তৈরির একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
মাটি : পানি নিকাশের সুবিধাযুক্ত প্রায় সব ধরনের মাটিতেই নারিকেল চাষ করা যায়। তবে দোআঁশ ও পলি দোআঁশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। যে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি এবং পানির স্তর কাছে সে জমি নারিকেল চাষের জন্য ভালো। পানির উৎস ও নিকাশের সুবিধার কারণে নদী বা পুকুরের কাছের জমিতে নারিকেল ভালো হয়। নারিকেল চাষের জন্য মাটির উপযুক্ত পিএইচ মান হচ্ছে ৫.৫ থেকে ৭.০।
নারিকেলের জাত : প্রধানত গাছের আকৃতি হিসেবে নারিকেলকে লম্বা ও বেঁটে এ দুই জাতে ভাগ করা হয়েছে। দেশের নাম অনুসারে এগুলোকে আবার বিভিন্ন জাত নামকরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে মালয়ান লম্বা, মালয়ান বেঁটে, মালয়ান সিমিটল, মিলনি বেঁটে ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ফলের রঙ অনুসারে আবার এগুলোকে সবুজ, হলদে, লাল ইত্যাদি নামকরণ করা হয়ে থাকে। অধিক ফলনশীল ২টি জাত হচ্ছেÑ বারি নারিকেল ১ এবং বারি নারিকেল-২, এগুলো আকারে বড় হয়।
বৈশিষ্ট্য : লম্বা জাতের নারিকেল গাছ রোপণের ৭ থেকে ৮ বছর পর থেকেই ফল দিতে শুরু করে এবং ৭০ থেকে ৮০ বছর পর্যন্ত ফল দেয়। এরা সাধারণত পর পরাগায়িত ও বড় আকারের ফল দেয়। এ জাতের নারিকেল গাছ প্রতিকূল আবহাওয়া সহ্য করতে পারে।
আর বেঁটে বা খাটো জাতের নারিকেল গাছ রোপণের ৪-৫ বছর পর থেকেই ফল দিতে শুরু করে ও ৪০ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত ফল দেয়। এরা স্বপরাগায়িত এবং অপেক্ষাকৃত কম প্রতিকূলতা সহ্য করতে পারে। বেঁটে জাতের নারিকেল গাছ দেখতে সুন্দর।
বংশ বিস্তার : নারিকেলের বীজ থেকেই এর বংশ বিস্তার করা হয়। সুস্থ সব মাতৃগাছ বাচাই করে তা থেকে চারার জন্য বীজ নারিকেল নির্বাচন করতে হয়। মাতৃগাছের বয়স হতে হবে ১৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে এবং যে মাতৃগাছ বছরে ৬০ থেকে ৮০টি ফল দেয় এসব গাছ থেকেই বীজ সংগ্রহ করা যেতে পারে।
১১ থেকে ১২ মাস বয়সের পরিপক্ব নারিকেল যার ব্যাস ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার এবং ওজন ১ কেজির ওপরে, ছোবড়া ২.৯ সেন্টিমিটার পুরু এবং যথেষ্ট পানি থাকে, এসব নারিকেল বীজের জন্য উত্তম।
আমাদের দেশে সাধারণত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বীজ নারিকেল সংগ্রহ করা হয়। এ সময়ে অনুকূল তাপমাত্রা, মাটির আর্দ্রতা সর্বাধিক থাকায় বীজের ভ্রƒণ গজানোসহ চারার বর্ধন ভালো হয়। বীজ নারিকেল গাছ থেকে বস্তায় ভরে বেঁধে পাড়তে হবে। বীজ সংগ্রহের পর কয়েকদিন ভালোভাবে শুকিয়ে ছায়াযুক্ত, শুষ্ক ও ঠা-া স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। এসব নারিকেল অন্তত ৩০ দিন বালির মধ্যে স্তরে স্তরে সাজিয়ে সংরক্ষণ করার পর শুধু অঙ্কুরিত নারিকেল বীজতলায় বপন করা যেতে পারে।
গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলে জানা গেছে, অঙ্কুরিত বীজ নারিকেল থেকে শতকরা ৯৫-৯৭ ভাগ চারা উৎপন্ন হয়।
চারা উৎপাদন : ছায়াযুক্ত, খোলামেলা, সুনিষ্কাশিত, সেচের সুবিধাযুক্ত হালকা বুনটের মাটি বীজতলার জন্য উপযুক্ত। মাটির উর্বরতা সাপেক্ষে জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। বীজতলার মাটি অন্তত ৩০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার গভীর করে চাষ করতে হবে। বীজতলার বেডের দৈর্ঘ্য প্রয়োজন মতো দেয়া যাবে।
প্রস্থ দিতে হবে ২.৫ থেকে ৩.০ মিটার। বেডে সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার এবং বীজ থেকে বীজ ২৫ সেন্টিমিটার দিতে হবে।
বেডের চারপাশে ২৫ সেন্টিমিটার নালা রাখতে হবে। বীজতলার বেডে ৪০ সেন্টিমিটার গভীর নালা করে বীজের চ্যাপ্টা বা চওড়া অংশ ওপর দিকে রেখে মাটির সমান্তরালে এমনভাবে বসাতে হবে যেন বীজটির এক-চতুর্থাংশ মাটির উপরে ভেসে থাকে। খুব বেশি ভাসিয়ে কিংবা মাটির গভীরে বীজ বপন করা ঠিক নয়। শুষ্ক মৌসুমে ২ সপ্তাহ পর্যন্ত বীজ পানিতে চুবিয়ে কিংবা অঙ্কুরিত করে তারপর বেডে বপন করা উচিত।
উইপোকার আক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে ০.২ শতাংশ (২ গ্রাম প্রতি লিটার পানিতে) এলড্রিন/বিএইচসি হেপ্টাক্লোর দ্রবণে বীজ চুবিয়ে নিতে হবে।
বীজতলার মাটি শুকনো হলে বীজ বপনের আগে সেচ দিয়ে জমিতে জো অবস্থা আনতে হবে।
বীজতলার পরিচর্যা : বীজতলায় চারা গজানো ও বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সেচ দিতে হবে। শুকনো কচুরিপানা/খড় দিয়ে মালচিং করা যেতে পারে। এতে মাটির রস সংরক্ষিত হয় এবং আগাছামুক্ত থাকে বীজতলা।
চারা বাছাই : বীজতলায় বীজ বসানোর পর যেসব বীজ ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে গজায় সেগুলো থেকে ভালো চারা উৎপাদিত হয়। ৩ মাসের অধিক সময়ে যে চারা গজায় তা ভালো হয় না। বীজ বসানোর পর যেসব চারা খুব তাড়াতাড়ি গজায় এবং দ্রুত বাড়ে, গোড়া মোটা হয়, পাতা ও শেকড় বেশি হয় এমন চারা বাছাই করা যেতে পারে। এক বছর বয়সের চারায় কমপক্ষে ৬টি পাতা থাকবে এবং গোড়ার বেড় হবে ১০ সেন্টিমিটার। সুস্থ-সবল চারা সোজা এবং খাঁড়াভাবে বেড়ে ওঠে। এসব চারার পাতাগুলো গাঢ় সবুজ বর্ণ ও প্রশস্ত হয়। আকার-আয়তনে খাটো হয়। শিরাগুলো স্পষ্ট হয় এবং পাতার বোঁটা খাটো থাকে। পাতাগুলো ওপরের দিকে মুখ না রেখে পাশের দিকে বিস্তৃত হয়।
চারা রোপণের সময় : জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত নারিকেল চারা রোপণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
চারা রোপণের দূরত্ব : নারিকেলের জাত ভৌগোলিক এলাকা ও রোপণ স্থানের ওপর ভিত্তি করেই রোপণ দূরত্ব দেয়া যেতে পারে। পুকুর পাড়ে কিংবা রাস্তার পাশে এক সারি গাছ রোপণের জন্য লম্বা জাতের ক্ষেত্রে চারা থেকে চারার দূরত্ব ৬ মিটার হতে হবে। বর্গাকার বা ত্রিকোণাকার পদ্ধতিতে রোপণ করার ক্ষেত্রে চারা থেকে চারা এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব ৮ মিটার দেয়া যেতে পারে। খাটো-বেঁটে জাতের চারা ৫ থেকে ৬ মিটার দূরত্বে রোপণ করা যায়।
চারা রোপণের পদ্ধতি : সাধারণত বর্গাকার ও ত্রিকোণাকার পদ্ধতিতে নারিকেলের চারা রোপণ করা হয়। বর্গাকার পদ্ধতিতে চারা ও সারির দূরত্ব সমান দিতে হয়। ত্রিকোণাকার পদ্ধতিতে সমবাহু ত্রিভুজের তিন কোনায় ৩টি চারা রোপণ করা যায়। বর্গাকার পদ্ধতির তুলনায় এ পদ্ধতিতে শতকরা ১৫টি গাছ বেশি রোপণ করা যায়।
রোপণ নিমিত্ত গর্ত তৈরি : মাটির বুনটের ওপর গর্তের আকার নির্ভর করে। মাঝারি বুনটের মাটির ক্ষেত্রে ৫০ সেন্টিমিটার চওড়া ও গভীর গর্ত করা যেতে পারে। আর ভারী বুনটের মাটির ক্ষেত্রে ৯০ সেন্টিমিটার চওড়া ও গভীর গর্ত করতে হবে। মাটি উত্তোলনের পর গর্তে শুকনা খড়কুটা পোড়ালে রোগ-জীবাণু ও উইপোকার আক্রমণ রোধ হয়। এতে কিছুটা পটাশের জোগান হতে পারে।

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor