Saturday, September 13, 2008

ভূমি বিবাদের কারণ অনুসন্ধান এবং কিছু সুপারিশ

যায়যায়দিন । ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৮

চরাঞ্চলসহ দেশের সর্বত্র কোন এলাকায় কী পরিমাণ খাস সম্পদ আছে সরকারিভাবে তার তালিকা প্রকাশ করা, সেগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়া এবং জেলাভিত্তিক সঠিকভাবে বণ্টনের উদ্যোগ গ্রহণ করাসহ খাল-বিল, জলা, জঙ্গল, নদীনালা, চর, অর্পিত এবং পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে অবৈধ ও জবরদখলকারীদের উচ্ছেদ করা প্রয়োজন।

জাহিদ রহমান
ভূমি বিবাদ আমাদের সবার কাছে খুবই পরিচিত বিষয়। এর ফলে প্রতিবছরই বহু লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন চরাঞ্চল ও খাস জমিতে বসবাসরত ভূমিহীন কৃষক ও মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠী, বিভিন্ন পেশাভিত্তিক ক্ষুদ্র সম্প্রদায়, দরিদ্র আদিবাসী জনগোষ্ঠী এই বিবাদের করুণ শিকার হয়ে আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এক গবেষণায় দেখা যায়, দেশে প্রতিবছরে গড়ে ত্রিশ হাজারেরও বেশি ছোট বড় ভূমি বিবাদের ঘটনা ঘটে। যার মধ্যে প্রত্যক্ষ ভূমি বিবাদের ঘটনাও রয়েছে। গবেষণায় এও দেখা গেছে প্রতিবছর গড়ে ৫০ জনেরও বেশি মানুষ ভূমি বিবাদের ফলে নিহত হয়। এর পেছনের কারণগুলোর মধ্যে খাস জমি ও জলমহালের ওপর অবৈধ দখলদারদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টি অন্যতম। সমাজের ভূমিগ্রাসী জোতদার বা দখলদার রাজনৈতিকভাবে আশ্রিত শক্তিশালী যে শ্রেণী রয়েছে মূলত তারাই এই দ্বন্দ্বের মূল কুশীলব। অন্যদিকে এই দ্বন্দ্বের ফলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারা হলো সমাজের দরিদ্র ভূমিহীন জনগোষ্ঠী। গবেষণা বলছে তুলনামূলক বিচারে ভূমি বিবাদের সবচেয়ে মাত্রা বেশি চরাঞ্চলসহ যে কোনো ধরনের খাস জমিতে। বিবাদ, সংঘর্ষ এখানে নিত্যসঙ্গী। সব ধরনের খাস জমিতে ভূমিহীনদের নিরঙ্কুশ অধিকারের কথা বলা হয়েছে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। কিন্তু নিরঙ্কুশ অধিকারের কথা বলা হলেও সরকারি কর্মকর্তাদের অবিরাম গাফিলতি, দুর্নীতিবাজ ভূমি কর্মকর্তাদের চরম অসহযোগিতা এবং রাজনৈতিক ছদ্মাবরণে জবরদখরকারীদের আস্ফালনের কারণে খাস জমিকে কেন্দ্র করে ভূমিবিবাদ বেড়েই চলছে। আর এই বিবাদে কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে দরিদ্র ভূমিহীনদের।
পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের তথ্যানুযায়ী গত বছরও বিপুল পরিমাণ সরকারি ও বেসরকারি জমি বিভিন্নভাবে বেদখল হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় দেখা গেছে সরকারের কাছ থেকে একজন ভূমিহীন যতোটুকু খাস জমি পেয়েছেন তার বিপরীতে আইনি লড়াই করতে গিয়ে সেই ভূমিহীনের তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে। সঙ্গতকারণেই বলা প্রয়োজন ভূমিহীনদের তার অধিকার ও লড়াই থেকে নিবৃত্ত করতে ভূমিগ্রাসীদের প্রধানতম একটি অস্ত্র হলো ভূমিহীনদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া, যাতে আর্থিকভাবে দুর্বল ভূমিহীন আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ভূমি অধিকারের হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে ভূমিগ্রাসীদের কাছে কোনো শ্রেণী বা ধর্মীয় ভেদাভেদ নেই। জমি দখল করার কোনো ন্যূনতম সুযোগ থাকলেই তারা সেটা দখল করে। দেশে ভূমি নিয়ে দুর্নীতির যে মহোৎসব তা টিআইবির পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি তৃণমূল পর্যায়ের গবেষণায় দেখানো হয়েছে।
দেশের দুটি মন্ত্রণালয়ের (আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়) তিনটি অধিদপ্তর সমগ্র ভূমিসংক্রান্ত বিষয় দেখাশোনা করে থাকে। কিন্তু এদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। জরিপ, নামজারি, রেকর্ড, পর্চা প্রদান প্রভৃতি ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতি বিরাজ করছে বিভিন্ন ভূমি অফিসে।
ভূমির মালিকানা বা স্বত্ব লাভে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে থাকে। প্রভাবশালীরা তাদের প্রভাবকে এক্ষেত্রে কাজে লাগিয়ে খুব ভালোভাবেই সফল হচ্ছে এবং বঞ্চিত করছে ব্যাপক ভূমিহীন জনগোষ্ঠীকে। কিন্তু ভূমিতে অভিগম্যতার ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষের সুযোগ খুবই কম। খাস জমিতে ভূমিহীনদের অভিগম্যতা আইন স্বীকৃত। কিন্তু প্রভাবশালী ও ভূমিগ্রাসীদের কারণে সেখানে তাদের অভিগম্যতা নেই বললেই চলে। খাস জমি সে চর এলাকায় হোক বা অন্য যে কোনো স্থানে হোক ভূমিহীনদের বা দরিদ্র মানুষের পক্ষে সেখানে অধিকার পাওয়া বা তা দখলে নেয়া খুবই কষ্টসাধ্য বিষয়।
ভূমি বিবাদ নিরসন করা দরকার। সব বিরোধ মিটিয়ে ভূমিহীন, দরিদ্র মানুষকে খাস সম্পদে তাদের আইনসম্মত ও সংবিধান স্বীকৃত অধিকার আদায়ের পথে সহায়তা করা প্রয়োজন। বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য দরিদ্রমুখী নীতিমালা প্রণয়নে সরকারকে গবেষণালব্ধ তথ্য প্রদান, ভূমি বিবাদের নেতিবাচক দিক সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারণা কার্যক্রম, বিরোধ নিষ্পত্তির বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ ইত্যাদির মাধ্যমে দরিদ্র, ভূমিহীন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা যেতে পারে। কিন্তু তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা, উদ্বুদ্ধ করা এবং অধিকার আদায়ের পথকে সুদৃঢ় করার কাজটি করলেই শুধু হবে না। তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতির হাত থেকে তাদের রক্ষা করতে হলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ, বিভিন্ন উন্নয়ন সংগঠন এবং উন্নয়নকর্মী সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও তার বাস্তবায়নের পাশাপাশি ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় সহজ ও স্বচ্ছ আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে হবে।
ভূমিতে বিরাজমান বিবাদ কমিয়ে আনতে মানুষের মধ্যে যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এর জন্য গবেষণালব্ধ তথ্যের সরবরাহও প্রয়োজন। গবেষণার মাধ্যমে চিহ্নিত করা সম্ভব ভূমি বিবাদের প্রকৃত কারণগুলো। কারণ এবং তার অব্যবহিত ফলাফল চিহ্নিত করা গেলে তা সমাধানের পথ বের করা সহজ হবে। ভূমিকে কেন্দ্র করে বিরাজমান বিবাদ নিরসনে এবং তা মোকাবেলার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। যথা- ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা ও মানুষের ভোগান্তি কমিয়ে আনতে ভূমি ব্যবস্থাপনার জন্য যে দুটি মন্ত্রণালয় (আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয়) রয়েছে তাদের মধ্যে সমন্বয় করা এবং ভূমির ব্যবস্থাপনার বিষয়টি এককেন্দ্রিক করা যেতে পারে। নিয়মিত দিয়ারা জরিপ করা প্রয়োজন; এটি দেশের নদী এলাকার মোট ভূমির প্রকৃত পরিমাণ এবং মালিকানার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি এটি সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত জটিলতা হ্রাস করবে। ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও সঠিক জরিপ পদ্ধতির প্রণয়ন করা প্রয়োজন, যাতে মানুষ ঘুষ ও জাল দলিলের বলয় থেকে মুক্ত হয়ে একটি সুষ্ঠু নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে চলে আসতে পারে। স্থানীয় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণমূলক জরিপ পদ্ধতির প্রণয়ন করার পাশাপাশি জরিপ চলাকালীন মাঠ আদালত গঠন করা যাতে এসব মাঠ আদালত তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ভূত ভূমি সমস্যার সমাধান করতে পারে। ভূমি রেকর্ড ও জরিপকারীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বন্ধ করে স্থায়ীভাবে নিয়োগ প্রদান করা এবং তাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কেননা জরিপ এবং রেকর্ডে গড়মিল ভূমি বিবাদের সূত্রপাত করে থাকে। পাশাপাশি এসব কর্মকর্তার আধুনিক প্রশিক্ষণ প্রদান করে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ পদ্ধতির আধুনিকীকরণও বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আশু প্রয়োজন। ইউনিয়নসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ভূমি অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতি মোকাবেলায় প্রশাসনিক পর্যায় থেকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। দরিদ্র, ভূমিহীন মানুষের মাঝে খাস জমি সরকারি নিয়মানুযায়ী বণ্টন করা এবং এসব ভূমিতে তাদের মালিকানা সুনিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।
জেলা স্তরে ভূমি বিবাদসংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি করতে জেলা আদালত গঠন করা এখন সময়ের দাবি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এতে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা কমবে এবং দীর্ঘস্থায়ী বিরোধের কারণে যেসব বিবাদের সৃষ্টি হয় সেগুলোও কমে আসবে। ভূমিগ্রাসী এবং অবৈধ চর দখলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং শিকস্তি ও পয়স্তি আইন সংশোধন করার মাধ্যমে ভূমি বিবাদ কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। চরাঞ্চলসহ দেশের সর্বত্র কোন এলাকায় কী পরিমাণ খাস সম্পদ আছে সরকারিভাবে তার তালিকা প্রকাশ করা, সেগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেয়া এবং জেলাভিত্তিক সঠিকভাবে বণ্টনের উদ্যোগ গ্রহণ করাসহ খাল-বিল, জলা, জঙ্গল, নদীনালা, চর, অর্পিত এবং পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকে অবৈধ ও জবরদখলকারীদের উচ্ছেদ করা প্রয়োজন। ভূমি বিবাদসংক্রান্ত সমস্যা মোকাবেলায় সামাজিক সংহতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে; তাই সামাজিক সংহতি সুদৃঢ় করতে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
তথ্য প্রযুক্তি আর যোগাযোগ ব্যবস্থার বদৌলতে সমাজ-সংস্কৃৃতিতে অনেক ধরনের পরিবর্তন এখন চোখে পড়ে সত্যি কিন্তু ভূমি বিবাদ আমরা এখনো কমাতে পারিনি। এখনো এই বিবাদে পড়ে অসহায় দরিদ্র মানুষ নিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেড়ে নেয়া হচ্ছে তাদের বেঁচে থাকার সর্বোত্তম অবলম্বনটুকু।


জাহিদ রহমান: সাংবাদিক, কলাম লেখক।
zahidrahman67@yahoo.com

No comments:

About Me

My photo
প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্র কৃষি বিষয়ে নানান সংবাদ প্রকাশ করে থাকে। এ সকল তথ্য কাজের জন্য খুবই সহায়ক। কিন্তু একজনের পক্ষে প্রতিদিন সবগুলো সংবাদপত্র পড়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অথচ এ সকল বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য কম-বেশি দরকারি। এ চিন্তা থেকে আমরা বিভিন্ন সংবাদপত্র নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও কৃষি বিষয়ক সংবাদসমূহ তথ্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছ্।ি আশা করছি সংবাদ তথ্যায়নের এ প্রকিৃয়াটি আমাদের কাজের জন্য সহায়ক হবে। পার্টিসিপেটরি রিসার্চ এন্ড অ্যাকশান নেটওয়ার্ক- প্রান এ কাজটি সঞ্চালনের কাজ করছে।

Krishi Khobor